আবু তাহের সরফরাজ
শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে
এবার নিষ্কৃতি পেলে, শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে
গিয়ে, দু’টুকরো লোহা ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দেব
অসহ অসীম শব পুড়ে হোক ছাই পুড়ে ছাই।
(কালো মেয়ে)
মৃত আপনজনের স্মৃতি কত যে দুঃসহ সেই অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই আছে। মৃত্যু যেন কুয়াশা-ঘেরা হিমশীতল হিমালয়। কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মৃতের স্মৃতিসম হিমালয় কাঁধে বহন করে যাওয়াই যেন মানুষের নিয়তি! স্মৃতি মানেই তো গল্প। টুকরো-টুকরো গল্প। সময়ের অসংখ্য ছাপচিত্র। মানুষ যদিও বিস্মৃতিপ্রবণ, এরপরও কোনো কোনো মানুষ সংসারে থাকেই যারা কোনোভাবেই প্রিয় কোনো মানুষের মৃত্যু সহ্য করতে পারে না। হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতি তাকে পর্যুদস্ত করে দ্যায়। আর তাই, স্মৃতির ছাপচিত্র বুকের ভেতর ধারণ করে তাকে বেঁচে থাকতে হয়। এই অবস্থা থেকে যেন নিষ্কৃতি নেই। কিন্তু কেউ কেউ নিষ্কৃতি চান। চাওয়াই স্বাভাবিক। জীবন তো মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গ নয়। মহাকলের স্রোতে মানুষের জীবন তাৎপর্যপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই উপলব্ধি থেকেই কারো কারো উপলব্ধি, পৃথিবীর জীবনকে ছাড়িয়ে অসীম ঊর্ধ্বে উঠে গেলেই সম্ভবত শান্তির খোঁজ পাওয়া যাবে। পৃথিবীর দুঃসহ জীবনের ভার মহাকাশে গিয়ে নির্ভার হয়ে যায়। নিউটনের মহাকর্ষীয় বল সেই সূত্রই আমাদেরকে জানায়। অস্তিত্ব মানেই ওজন। এই ভার অসহনীয়। তাই নির্ভার অস্তিত্বের বোধকে উপলব্ধি করতেই নিজের মৃতদেহকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতেই তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এক্ষণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত পঙক্তি স্মরণে আসতেই পারে, ‘দেহ চিতাভস্ম পুড়ে হোক ছাই/শান্তি, ওগো শান্তি।’
শান্তির এই আকাঙ্কা বুকের ভেতর লালন করে নিঃসীম মহাশূন্যে মিলিয়ে গেলেও সত্যিই কি শান্তির খোঁজ পাওয়া সম্ভব? গূঢ় এই রহস্য আমরা কোনোদিনই উদ্ঘাটন করতে পারবো না। এই ব্যর্থতার দায় বহন করেই হয়তো আশির দশকের কবি বিষ্ণু বিশ্বাস নীরবে-নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এই চলে যাওয়া তার স্বেচ্ছা-নির্বাসন। পাঠক হিসেবে আমরা এমন ধারণা করতেই পারি ওপরে উল্লিখিত তার রচিত পঙক্তিগুচ্ছ পাঠশেষে।
আশির দশকের নিভৃতচারী ঘোরগ্রস্থ কবি বিষ্ণু বিশ্বাস। প্রত্যেক কবিই কমবেশি ঘোরগ্রস্থ। কিন্তু বিষ্ণু বিশ্বাসের বেলায় ঘোর শব্দটির দিকে বিশেষ নজর নিয়ে আমাদেরকে তাকাতেই হয়। যেমন তাকাতে হয় জীবনানন্দ দাশের জবুথবু হয়ে থাকা নীরিহ জীবনটার দিকে। জাতকবিদের এই এক নিয়তি! জীবনানন্দ যাকে বলেছেন, ‘নিজেরই মুদ্রাদোষে হতেছি একাকী’। অনুভূতির গোপন দহনে কী যেন এক ক্ষরণ তারা প্রতিমুহূর্তে টের পান অন্তর্করণে। চারপাশের জীবনের কলরোল, সমাজ ও রাষ্ট্রের শঠতা, জীবিকার দরকারে সবসময় নিজের মুখ লুকিয়ে মুখোশ পরে থাকা— এসব কর্ম-তৎপরতায় তাদের গাত্র খুব একটা উত্থিত হয় না। অন্তর্গহনের গূঢ় জগতেই তারা নিয়ত বিচরণশীল। সামাজিক প্রতিষ্ঠা কিংবা বৈষয়কি ভাবনা তাদের কাছে খুচরো পয়সার মতো। পথে যেতে যেতে যা ভিখিরিকে ছুড়ে দেয়া যায়, বেশি সময় নিজের সাথে বহন করা যায় না। বাংলাদেশের প্রত্যেক দশকেই এ-রকম দু’একজন কবি আমরা দেখতে পাই।
বিষ্ণু বিশ্বাস ছিলেন আশির দশকের ঘোরগ্রস্থ কবি। তার জীবনযাপন ও তার লেখা কবিতার ভেতর কোনোই তফাৎ নেই। একটি আরেকটির সাথে একীভূত। সাধারণত দ্যাখা যায়, আমাদের দেশের কবিরা বৈষয়িক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে কবিতা লেখেন। কোনোমতে ‘কবি’ হিসেবে একটু পরিচিতি জুটে গেলে সেই নাম ভাঙিয়ে জীবিকার উপায় তৈরি করে নেন। ফলে কবিতায় নানাবিধ চেতনা ও দর্শনের কথাবার্তা বললেও ব্যক্তিজীবনে তার কোনো আমরা খুঁজে পাই না। প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায় বঙ্গের কবিকুল জীবিকা-নির্বাহ করে। এরই ভেতর দিয়ে কোনো কোনো কবি (প্রকৃত প্রস্তাবেই কবি) ঘটমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ছিটকে যান। নিজের ব্যক্তিদর্শন কিংবা চেতনার প্রতিকূলে গিয়ে সমাজে ঠিকঠাক জায়গা করে নিতে তাদের কোনো প্রচেষ্টা থাকে না। আশির দশকে বিষ্ণু বিশ্বাস এমনই একজন ছিটকে পড়া কবি। যেহেতু তার জীবন ও কবিতা একাত্ম, সেহেতু তার কাব্যিক জীবনের দিকে চোখ রাখলে তার কবিতার বৈশিষ্ট্যও বুঝতে আমাদের সহজ হবে।
১৯৬২ সালের ২৯ মে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বিষয়খালীতে তার জন্ম। নলডাঙ্গা ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৭৯ সালে এস.এস.সি. ও ঝিনাইদহ সরকারি কে.সি. কলেজ থেকে ৮১ সালে এইচ.এস.সি. পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। এখানে পড়ার সময় তিনি ভিড়ে যান ছোটকাগজ ‘পেঁচা’ সম্পাদনায়। ৮৫ সালে অনার্স উত্তীর্ণ হয়ে ডেরা বাঁধেন রাজধানী ঢাকার বুকে। সেই সময়ের রাজধানী কাঁপানো কবিদের সঙ্গে এখানে-সেখানে চলতে লাগলো তুমুল আড্ডা। আর, কবিদের আড্ডা মানেই তো কবিতার কথকতা, বৈশ্বিক কবিতার পাশাপাশি বাংলা কবিতাকে বুঝে নেয়া। গাণ্ডীব, প্রসূন, নদী ও দ্রষ্টব্যসহ সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজগুলোতে প্রকাশিত হতে থাকে বিষ্ণুর কবিতা। আমরা জানি, আশির দশকের কবিরা দৈনিকের বাজারি সাহিত্যপাতা বর্জন করে ছোটকাগজেই তাদের কাব্যকীর্তি প্রকাশ করতেন। এক্ষেত্রে বিষ্ণুও ব্যতিক্রম নন। তিনি দৈনিকের সাহিত্যপাতা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতেন। এই সময়ে তার জীবনযাপন উন্মূল হয়ে ওঠে। জীবিকার কোনো স্থায়ী প্লাটফর্ম না-থাকায় বেশির ভাগ সময়ই আর্থিক টাপাপড়েনে জেরবার থাকতেন। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন ভারতে বাবরি মসজিদের ওপর হামলা হলো। ক্ষোভে ফুঁসে উঠল বাংলাদেশের মানুষ। ধর্মীয় হিংসার এই ডামাডোলে সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ বিষ্ণু বিশ্বাস দুমড়ে মুচড়ে গেলেন। তার ভেতর কাজ করতে শুরু করল আতঙ্ক। ভীতির চাবুক মাঝে-মধ্যেই তাকে তাড়া করে ফিরতো। আর তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন। এই সময়ের অবস্থার ছবি পাওয়া যায় তার কবিতার একটি বাক্যে, ‘একটা সাদা গাড়ি অথবা ছুরি হাতে কেউ তাড়া করে ফিরছে।’
বন্ধুরা বিষ্ণুকে নিয়ে গেলেন মনোচিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক সবসময় তাকে দেখভাল করতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু বন্ধুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিষ্ণু হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যান। আবার ফিরে এলেন, আবার উধাও…। জানা গেছে, এখন তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কোথাও রয়েছেন। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত একজন মানুষ নামের কাঠামো। বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার বই মাত্র একটি, ‘ভোরের মন্দিরা’। একটি মাত্র কবিতার বইয়ের জন্যই বিষ্ণু বাংলা কবিতায় অক্ষয় কীর্তি হয়ে রবে যাবেন। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, নিজের কবিতাকীর্তি জীবনকে তিনি আলাদা সত্তা হিসেবে কখনোই মনে করেননি। সেই শঠতা তার অন্তর্জগতে ছিল না। ফলে বিষ্ণুর জীবনদর্শন ও তার সৃষ্টিসত্তার শিল্পসৌকর্য ধারণ করে রয়েছে ‘ভোরের মন্দিরা’র প্রতিটি কবিতা। প্রকৃত কবি বলতে যা বোঝায়, বিষ্ণু ছিলেন সেই দলে। বিষ্ণু তার কবিতার বিষয় কিংবা বলা যেতে পারে উপাদান, আহরণ করেছেন তার জীবন-যাপনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে। সমাজের আরসব মানুষের ভেতর দিয়েই যেহেতু তার বেঁচে থাকা, ফলে চারপাশের সমাজ ও রাষ্ট্র-বাস্তবতাও তার কবিতার ভেতর শিল্পের রসায়নে জারিত হয়েছে নানা উপায়ে-কৌশলে। এই কৌশল বিষ্ণুর প্রকৃত কবিসত্তার প্রকাশ। তার কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হবে, শব্দেরা যেন ভাষা প্রকাশের প্রাণহীন নিছক কোনো চিহ্ন নয়। তার কবিতার শব্দগুলো জীবন্ত হয়ে অব্যক্ত কোনো বিষয় পাঠকের কাছে ব্যক্ত করে। শব্দের এই কারুকাজ এতই নিপুণ যে, পাঠক শব্দের পর শব্দ পড়ে যান কোনো রকম বিরক্তি ছাড়াই।
জায়গা ছিল না কোনো কথা বলবার, শুনবার।
সমুদ্রের ধারে যেতে পথের বাদাম গাছগুলি
মিহি কথার কৌতুকে পাথর ফুলের ধাক্কা দিল
আমি কি বলেছিলাম, তোমরা যারা শুনেছো বেশি
শোনাবে— একটুখানি। আমি ভুলে গেছি জন্ম আছে।
কিছু যন্ত্রণার কথা যেভাবে বলেছি মনে নেই
একটু আনন্দ কথা, গোলাপি স্তম্ভে স্থির রয়েছে
অন্ধ থেকে চোখে জেগে সমুদ্র দেখি বালির স্তূপে।
(বলবার ছিল)
মানুষ মূলত একা। এই সত্য খুব প্রগাঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বিষ্ণু বিশ্বাস। তার চারদিকে কত কত মানুষ। জীবনের কত যে ঢেউ প্রতিমুহূর্তে বয়ে যাচ্ছে, সেসব যে কোনো আত্ম-সান্ত্বনা নয়, বিষ্ণু তা জানতেন। আর তাই তিনি বলবার কথা বলে দেয়ার কোনো জায়গা খুঁজে পাননি এই ধরিত্রীর বুকে। সমুদ্রের ধারে গিয়ে বলতে চেয়েছেন বলবার কথা। কিন্তু তিনি নিবিষ্ট শ্রোতা পাননি। তার বলবার কথাকে মিহি কথার কৌতুক হিসেবে নিয়ে তারা পাথরের আঘাত দিয়ে গেছে। যদিও সাধারণ চোখে সেই পাথরকে দেখাবে বাদাম গাছের ফুল। কিন্তু কবি জানেন, মানুষের ছলচাতুরি এভাবেই দিকে দিকে প্রসারিত। মুখ ও মুখোশের দুনিয়ায় ফুল ও পাথরের ভেতর মৌলিক কোনো তফাৎ আসলে নেই। কবি যা বলতে চেয়েছেন মানুষ তারচেয়েও বেশি বুঝে নিয়েছে ওই কথার মানে। ফলে কবি দ্বিধান্বিত হয়ে জানতে চাইছেন, সেসব কথা তাকে আমরা একটুখানি শোনাবো কিনা। জন্ম যে আছে, অস্তিত্বের এই সত্য কবি ভুলে গেছেন। অকপটে তিনি তা স্বীকারও করে নিচ্ছেন। তার এই স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়েই আমরা জেনে যাই, মনুষ্য-জন্মের প্রতি কী যেন এক বিরাগ কবিমনে সঞ্চারিত হয়েছিল। অবশ্যি এর দায়ভার কবির নয়, সামাজিক শঠ ও প্রবঞ্চক মানুষদের। তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন মনুষ্য-জন্মের যন্ত্রণার কথা। এই জন্ম তো আনন্দের। ফলে, জন্মের কথা যন্ত্রণার না হয়ে হয়ে উঠতে পারতো আনন্দ কথা। বিষ্ণুর জীবনে তা কিন্তু হয়নি। হয়নি বলেই তিনি অসংলগ্নভাবে যেভাবে পেরেছেন বলে গেছেন যন্ত্রণার কথা। হয়তো একইসঙ্গে আনন্দের কথাও। যা-যা তিনি বলেছেন সেসব কথা তেমনভাবে তার মনে নেই। মনে না থাকলেও বিষ্ণু বিশ্বাস করেন, তার সব কথা গোলাপি কোনো স্তম্ভে স্থির হয়ে আছে। এখানে গোলাপি স্তম্ভ কি বিষ্ণুর অন্তর্জগতের নির্ভরতার কোনো আশ্রয়? জাগতিক জীবনে যা নেই অথচ কোথাও তা আছে বলেই কবি বিশ্বাস করেন! স্বীকার করতেই হবে, ‘গোলাপি স্তম্ভ’ বিষ্ণু বিশ্বাসের অভিনব একটি চিত্রকল্প। শেষ বাক্যে তিনি লিখছেন, ‘ অন্ধ থেকে চোখে জেগে সমুদ্র দেখি বালির স্তূপে।’ মানে, চারদিকের জীবনের স্রোত থেকে তিনি নির্বাসনে থাকতে চান। চক্ষুষ্মান হয়েও অন্ধ থাকতে চান। কিন্তু জাগিয়ে রাখতে চান তার চোখ দুটোকে। সেই চোখেই তিনি চারদিকের বালির স্তূপে সমুদ্র দ্যাখেন। বলে দিতে হয় না যে, বালির স্তূত এখানে প্রতীকী। বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতায় প্রতীকীকের ব্যবহার পাঠককে চমৎকৃত করে। সোনা-রূপার অলঙ্কার যেমন নারীর সৌন্দর্য বর্ধিত করে, একইভাবে কাব্য-অলঙ্কার কবিতাকে শিল্প-সৌন্দর্যে রাঙিয়ে তোলে। কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার তেমনই একটি অলঙ্কার। কিন্তু বিষ্ণুর কবিতায় প্রতীক যেন আরও কিছু। কবিতার সৌন্দর্যই কেবল বাড়ায় না, একইসঙ্গে বলার কথাকে বিস্তৃত করে দ্যায়। আরও কোনো অর্থময়তার দিকে পাঠককে দৃষ্টি দিতে ইঙ্গিত দ্যায়।
আশির দশকের কবিতায় পুরাণ ও ঐতিহ্যের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। বিষ্ণুর কবিতাতেও এই ধারা আমাদের চোখে পড়ে। তবে ওই দশকের আরসব কবিদের থেকে বিষ্ণুর কবিতায় পুরাণ ও ঐতিহ্য আলাদা ব্যঞ্জনায় অনুরণিত হয়েছে। হয়তো বিষ্ণুর স্নায়বিক বৈকল্যের কারণেই এই ভিন্নতা। কবি লিখছেন:
গাজনের ঢোলের রুদ্র নৃত্য
লৌকিক প্রতিবিম্বের যেন বজ্রকণ্ঠ
উঠে পড়ো,
বেঁধে নাও দড়াদড়ি
স্বর্গ-মর্ত্য
স্বর্গের-মর্ত্যরে দেবী ও দেবতা
থাকো জাগ্রত।
পৌরাণিক অনুষঙ্গে যাপিত জীবনের ক্লেদকে শৈল্পিক রূপে প্রকাশ ঘটেছে ওপরের পঙক্তিগুচ্ছতে। গোটা কবিতা পড়ার পর এই মাহাত্ম পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন। গাজনের উৎসবে ভক্তরা নিজেদের শরীরকে নানা উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে খুশি করতে চেষ্টা করে। আর, ঢোল বাজিয়ে নৃত্য করে। লৌকিক এই আচারকে কবি প্রতিবিম্ব হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, যাপিত বাস্তবতায় যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা মানুষের বজ্রকণ্ঠই যেন গাজনের রুদ্র নৃত্যে প্রকাশিত হচ্ছে। কবি আহ্বান করছেন দড়াদড়ি বেঁধে নিয়ে তৈরি হতে। ধরার ধূলির বুকে স্বার্থের সংঘাত ছাড়া স্বস্তি নেই। তবে কোথাও নিশ্চয়ই শান্তি আছে। কবি সেই গন্তব্যে যেতেই উদ্গ্রীব। এই আকাঙ্ক্ষার সাথেই কবি জানাচ্ছেন, মানুষই আসলে স্বর্গ ও মর্ত্যরে দেব-দেবি। তাই নর-নারীকে জেগে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিষ্ণু। পৌরাণিক চরিত্রের এই রকম নব রূপায়ণ বিষ্ণুকে আশির দশকের কীর্তিমান কবি হিসেবে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
আকাশে বিশাল এক সূর্যের বিপরীতে
চাঁদের স্তন, হলদে পাখির ডানা
সূর্যের আঁধারে জ্বলে, ঝরে পড়ে
শূন্য, এবং শূন্যের ছায়া।
মৃত্যুর বহু আগে সে ছিল
ধরা যাক আছে নীল ঘাসের দিন ও রাত
সূর্য নিভে গেলে সপ্তর্ষি পুকুরের জলে
রৌদ্রাভ জলের ফুল, স্বপ্ন উঠে যায় চাঁদের চোখে।
(জল)
চিত্রকল্প ব্যবহারে বিষ্ণুর নান্দনিক মেধা যে প্রকৃতির কবির সেই সত্য বুঝতে ওপরের কবিতার কয়েকটি শব্দের ওপর আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। চাঁদের স্তন, সূর্যের আঁধার, শূন্যের ছায়া, জলের ফুল, চাঁদের চোখ। এসব শব্দ আসলে যে চিত্রভাষ্য তৈরি করছে তা বিষ্ণুর কল্পজগতের বাস্তবতা। যাপিত বাস্তবতায় আমরা যাকে বলতে পারি, ইল্যুশন। বিষ্ণুর ইল্যুশনের মজা হচ্ছে, কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠকও বিশ্বাস করতে শুরু করেন শব্দগুলোর চিত্ররূপ। বিশাল অন্তহীন এক শূন্যতার গহ্বরে বিষ্ণু বিশ্বাস হঠাৎ-হঠাৎই কবিতার সান্নিধ্যে এসে আশ্রয় খুঁজে পেতেন। এই আশ্রয়ে কিছুক্ষণ ঠাঁই নিয়েই তিনি জীবনের শূন্যতাকে একটি বিচিত্র রূপে এঁকে তুলেছেন ‘জল’ কবিতায়।
আপাতপাঠে মনে হতেই পারে, বিষ্ণুর কবিতা তার জীবন-যাপনের মতোই বুঝি অসংলগ্ন। একটু নিবিড় পাঠে পাঠকের সেই ভুল ভেঙে যাবে। বিষ্ণুর কবিতা নানা প্রতীকে, উপমায় ও চিত্রকল্পে সুসজ্জিত হয়ে শেষ বাক্যে পৌঁছে একটি কিংবা একের বেশি কাহিনির ভেতর দিয়ে এনে পাঠককে ছেড়ে দ্যায়। ‘জল’ কবিতাটির বিষয়ই ধরা যাক না কেন। একটা কাহিনিসূত্র কি পাঠক হিসেবে আমরা পাচ্ছি না? ছোট্ট একটি কবিতা। অথচ কী গূঢ় অন্তর্বোধ! আর, যে কাহিনির আভাস পাঠক পাচ্ছে তা যেন সত্যি সত্যিই কোথাও ঘটে চলেছে— এমনই মনে হতে থাকে।
‘ভোরের মন্দির’ বইয়ের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমাদের মনে হবে, বিষ্ণু বিশ্বাস যেন নীলকণ্ঠ। জীবনের গরল তিনি একাই কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন। তীব্র হলাহলে যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন আর সেই যন্ত্রণা উগড়ে দিয়ে গেছেন শব্দের ভেতর দিয়ে কবিতার অবয়বে। কিন্তু সবকিছুর একটা শেষ থাকে। নিবৃত্তি থাকে। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, কর্মফল হিসেবে বারবার জন্ম ও বারবার মৃত্যু হয়। তাহলে শেষ তো কোথাও হচ্ছে না। অথচ বিষ্ণুর কাছে জন্ম-মৃত্যুর এই প্রক্রিয়ার একটা পরিসমাপ্তি জরুরি। খুবই জরুরি। সেই আকুলতা তার কাতর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়:
শব্দ নাচের মুদ্রায় দেখেছ
ঝরে পড়া পাখির স্বর, বহুবার
বহু মৃত্যুর পরে পুর্নজন্ম চিতাগ্নির
ভিতর; আজ গল্পের অবশেষ
ধূপ-ঘৃত-গন্ধের সাথে পোড়া মাংস এখুনি শেষ হবে।
বিষ্ণু যেন শব্দের পাখি। জীবনের গরল নিঃশেষে পান করে নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠা শব্দের এক পাখি। পাখিদের কোনো মানচিত্র নেই। বিষ্ণুরও নেই। তাই হয়তো পাখির মতোই বিষ্ণু বিশ্বাস বাংলা কবিতার আকাশ থেকে উড়ে চলে গেছেন অজানায়, অচেনায়। কিন্তু কবিতার পাঠক হিসেবে বারবার আমাদেরকে তার কাছে, তার অনুভূতির শৈল্পিক অন্তর্বোধের জগতে ফিরে আসতেই হয়। না-হলে যে আমাদের কাব্যতৃপ্তি ঘটে না।