রেজা তানভীর
২৮ শে ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করা হয়, যার নাম ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। ইংরেজিতে ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি। সংক্ষেপে এনসিপি।
এর আগে ৮ ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে একটি সংগঠন গঠন করা হয়। যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো, ‘জুলাই গণহত্যার বিচার নিশ্চিতকরণ ও নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সংবিধান সভা নির্বাচনে জনমত গঠন।’ সংগঠনটির আহবায়ক ছিলেন নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারি, সদস্য সচিব ছিলেন, আখতার হোসেন। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পরই তারা বিভিন্ন জেলা ও থানায় কমিটি দিয়েছে।
তবে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের দিন তারা জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টি হয়ে যায়।
নাগরিক শব্দটি নিয়ে অনেকের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ কেউ বলছেন, এই শব্দটিতে শহুরে এলিট ভাব আছে। আবার কেউ মনে করছেন, যেদেশের জনগণ এখনো নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি, সেদেশে নাগরিক শব্দ দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল তৈরী হয়েছে এটা ভালো সংবাদ।
এনসিপির আত্মপ্রকাশের কয়েকদিন আগে থেকেই রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে দলটি নিয়ে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে। জনগণ মনে করছে, কেমন হবে নতুন রাজনৈতিক দলটির কার্যক্রম? কোন আদর্শকে ধারণ করে দলটি এগিয়ে যাবে?
এনসিপির আত্মপ্রকাশ নিয়ে জনগণের মধ্যে এত আগ্রহের কারণ, এই দলটির নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা পনের বছর ফ্যাসিস্ট কায়দায় শাসন করা আওয়ামী লীগকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে। এই দলটির প্রধান নাহিদ ইসলামই আওয়ামী লীগ পতনের এক দফা ঘোষণা করেন। নাহিদের এক দফার কথা শুনেই জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন। সে হিসেবে তরুণদের এই দলটির প্রতি জনগণের আগ্রহ তুঙ্গে।
তবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে বলা হচ্ছিলো, দলটির কার্যক্রম কিংস পার্টির মতই। তবে, এই অভিযোগকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একদিকে এই দলটির শীর্ষনেতৃবৃন্দকে ডিবি গুম করে ফেলেছিল, নাহিদ ইসলামকে বেঁধড়ক পেটানো হয়েছিল। একটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে হটিয়েছে। আবার আরেকদিকে বলা যায়, নতুন রাজনৈতিক দলেরা লোকেরা থানায় গেলে ওসি সম্মান দেয়। পুলিশ নিজে থেকে থানায় চা নাস্তা খাওয়ার দাওয়াত দেয়। প্রশাসনও সহযোগিতা করে। এ কারণে এখানে কিছু সুবিধাবাদী লোক ভিড় করেছে। আবার দলটির গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনজন মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা আছে। তারা বিভিন্নভাবে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
তবে, তাদের এই রমরমা অবস্থা থাকবে আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত। নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা প্রবল। বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে পুলিশ তাদের আর প্রটোকল দিবে না। তখনই দলটি থেকে অনেক লোক ঝরে যাবে এবং ক্ষমতাহীন দলটির কার্যক্রমের উপরই নির্ভর করবে তাদের ভবিষ্যত।
ছাত্রদের পক্ষ থেকে তিন জন ইন্টেরিম সরকারে আছে। তার মধ্যে নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করেন। সে হিসেবে আরো দুজন রয়ে গেছেন। বিএনপি বারবার বলছে, নতুন রাজনৈতিক দলটি সরকারের আনুকুল্য পাচ্ছে। যদিও বিএনপিও কিংস পার্টি হয়ে পরবর্তীতে ব্যাপক জনপ্রিয় দল হয়ে উঠে।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের দিন আওয়ামী লীগ ও জাপা বাদে অন্যান্য দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ও জামাত নেতাদের পাশাপাশি দেখা গেছে।
তবে, ছাত্রদের এতদিন ফ্যাসিবাদ বিরোধী এক্টিভিস্টরা সমর্থন দিলেও এখন যেহেতু তারা এখন রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে সেহেতু তাদের কার্যক্রম নিয়ে ভবিষ্যতে সমালোচনা হবে, এটাও তারা বলছেন।
এনসিপির আত্মপ্রকাশের দিন মানুষ যেভাবে আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল বলে আসেনি বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে। তবুও অনেক লোকের সমাগম হয়েছে।
এনসিপির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কেমন হবে তা নিয়ে নাহিদ ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।’
এনসিপি কেমন হবে তা নিয়ে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী রিফাত হাসান লেখেন, ‘এই রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা ও এসেট হল, একটি সর্বাত্মক জনঅভ্যুত্থানে এর নেতারা নেতৃত্ব দিছেন। এর কর্মীরা সবাই তরুণ ও মাঠের লড়াকু। এর চেহারা বাংলাদেশের ট্রেডিশনাল পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে আলাদা ও বৈচিত্রময়। এদেরে না ইসলাম না সেকুলার না বাম দিয়ে চিত্রায়ন করতে পারবেন আপনি। কিন্তু এইসবগুলোর মহত্বর মর্মগুলো এরা ধারণ করার কথা বলে প্রায়ই। ফলে, নানান সীমাবদ্ধতা সত্বেও, এই মুহূর্তের সবচেয়ে সেন্সিবল রাজনৈতিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছেন ও প্রভাবশালী হযে উঠেছেন এই গ্রুপ।’
এনসিপি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যারা জড়িত হয়েছেন, শীর্ষ পদগুলোতে যারা আসীন হয়েছেন তাদের বয়স খুবই কম। তরুণরা এই দলটির সাথে সহজেই নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে। তাদের চাওয়া পাওয়াকে তুলে ধরতে পারবে এনসিপির নেতাদের সামনে, কারণ তারাও তরুণ। তরুণরা তরুণদের মনের অবস্থা ভালো বুঝবে।
এনসিপির আদর্শ কী হবে সেটা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেও আমি মনে করি, বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া পাওয়া ধারণ করতে পারলে, জনগণের বিপদে আপদে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারলে এবং ধর্মীয় অনুুভূতিতে আঘাত না দিলে এসসিপির বড় দল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেন্টার রাইট, সেন্টার লেফট, সেন্ট্রিস্ট এসব কোনো বিষয় না।
মাত্র ২৭ বছর বয়সে নাহিদ ইসলাম একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হলেন। চব্বিশের বিপ্লবের প্রধান নায়ক নাহিদ ইসলাম এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। এমন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ইতিহাসে সবসময় আসে না। অতীতে এমন জনপ্রিয়তা ছিলো শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের। তাঁরা তাদের জনপ্রিয়তা দিয়ে তাঁদের দলকে সবচেয়ে বড় দলে পরিণত করেছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ পলাতক। তারা আর স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কি না কেউ জানে না। ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে নাহিদ ইসলামের সামনে সুযোগ এসেছে, যে ৩০-৪০% মানুষ কোনো রাজনীতি করে না তাদের দল হওয়ার এবং আওয়ামী লীগের জায়গাটা দখল করার। নাহিদ ইসলাম যদি তাঁর ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব দিয়ে নতুন দলটিকে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পৌঁছে দিতে পারেন তাহলে এই দলটি হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটো রাজনৈতিক দলের একটি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির উপর দেশের আপামর জনগণের নজর থাকবে। তারা আগামীদিনে কেমন রাজনীতি করছে তা সবার আগ্রহের বিষয়।