spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকিংবদন্তি চলমান সাহিত্য আড্ডার নায়ক ও 'পূর্বাভাস' পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম

লিখেছেন : তৈমুর খান

কিংবদন্তি চলমান সাহিত্য আড্ডার নায়ক ও ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম

[এইমাত্র ইহলোক ত্যাগ করলেন পূর্বাভাস পত্রিকা তথা কিংবদন্তি চলমান সাহিত্য আড্ডার নায়ক আবুল কালাম। তাঁর মৃত্যু সংবাদে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। পরিবার-পরিজনদের সমবেদনা জানাই। আবুল কালাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৫৫ সালের ১লা জানুয়ারি, বিদায় নিলেন ২০২৫ এর ৪ মার্চ, সময়: সকাল ১১:৫৫ মিনিট।]

তৈমুর খান

মাটির ঘর। দু-তলা। কিছুটা খড়, কিছুটা টালি। সেই ঘরেই আমরা সন্ধ্যায় এসে দু-তলায় উঠলাম। কোঠার ওপর তালাই পেতেই বসলাম মাটির মেঝেতেই।আবুল কালাম অর্থাৎ আমাদের শুধু কালামদা কয়েকটা বালিশ এনে দিলেন। সাদা ওয়াড়ের ওপর লাল নীল গোলাপি সুতোয় গোলাপ ফুলের ছবি আঁকা। তার নিচে নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গানের দুটি পংক্তি: “নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল/ ফুল নেব না অশ্রু নেব, ভেবে হই আকুল।” গানের তলায় একটি নাম লেখা ছিল: ‘নুরজাহান’। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম কালামদার স্ত্রী অর্থাৎ ভাবিজানের নাম এটি। সেই বালিশ মাথায় দিয়েই আমরা গল্পে কথায় মশগুল হয়ে উঠেছিলাম। কখন ঘুমে দুই চোখ বুজে এসেছিল তা আর মনে নেই।
যখনকার এই কথাগুলি বলছি, তখনও আমি ছাত্র। সময়টা ১৯৯০ সাল হবে।খড়গ্রাম থেকে কালামদা বের করতেন ‘পূর্বাভাস'(প্রথম সূচনা ১৩৮২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ) পত্রিকা। আর এই ‘পূর্বাভাস’ নামটিকে কেন্দ্র করেই ‘পূর্বাভাস ভ্রাম্যমান সাহিত্য আড্ডা’ শুরু হয়।প্রথম আড্ডাটি হয় ১৯৮৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। আড্ডার সম্পূর্ণ উদ্যোক্তা ছিলেন কালামদা-ই। আড্ডার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা ছিল না। মাসে দুবার তিনবার অথবা তারও বেশি অনুষ্ঠিত হত তবে অবশ্যই ছুটির দিন। মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও আড্ডার আয়োজন হত কখনো কারো বাড়িতে অথবা বিদ্যালয়ে। চলমান এই আড্ডার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, চাষি, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, হাটুরে, শিক্ষক, ছাত্র প্রমুখ সব শ্রেণির মানুষকেই সাহিত্যে সংযোগ ঘটানো। যাদের মনে নানা ভাব জাগত, লিখতে পারত না, অথবা লিখলেও নানা সংশয় থাকত, তাদেরও ডাকা হত এবং উৎসাহিত করা হত। আড্ডার স্থানে উপস্থিত কোনো শিক্ষককে সভাপতি করা হত। তাঁর অভিজ্ঞতা না থাকলেও সাহিত্য সম্পর্কীয় কিছু বক্তব্য রাখার জন্য বলা হত। যাঁরা আসতেন তাঁদের কাছ থেকে লেখাও সংগ্রহ করা হত। এইসব অনুষ্ঠানের আয়োজকরা হতেন নতুন লিখতে আসা মানুষজনেরাই। তাঁরাই সেদিনের জলখাবার এবং ভাতেরও ব্যবস্থা করতেন। জলখাবারে চপ-মুড়ি অথবা ঘুঘনি-মুড়ি থাকত। অনুষ্ঠান শেষ করতে প্রায় সারাদিন কেটে যেত।
আবুল কালাম দরদী মন নিয়ে সাহিত্য সেবার পথে নেমেছিলেন। তাই নিজের লেখা, নিজের গ্রন্থ , নিজের সাহিত্য পাঠে ততটা মনোযোগী ছিলেন না, যতটা অন্যের জন্য সময় দিতেন। চলমান এই আড্ডাগুলিতে ডাকার জন্য তিনি ১৫ পয়সার পোস্টকার্ড ব্যবহার করতেন। এক একটা অনুষ্ঠানে প্রায় ৪০ জনকে ডাকতেন। প্রতি সপ্তাহেই তাঁকে এই আমন্ত্রণপত্র লিখতে হত। সুন্দর হস্তাক্ষরে উল্লেখ করতে হত, আড্ডার তারিখ, স্থান এবং পথনির্দেশ।সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো কলেজছাত্র আমি এই আমন্ত্রণ পত্র অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। বাস-ট্রেনে পয়সা খরচ করে যাওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও একখানা পুরোনো সাইকেলই আমার বাহন ছিল। তাই বীরভূম জেলার বিভিন্ন প্রান্ত এবং মুর্শিদাবাদ জেলারও নবগ্রাম, কান্দী, কর্ণসুবর্ণ, খড়গ্রাম অনায়াসে পৌঁছে যেতাম। খড়গ্রামে ‘আলিম সুইটস’ নামে কালামদার ভাইয়ের মিষ্টির দোকান ছিল। সেখানে গিয়ে দোকানে বসতাম। মাঝে মাঝে চা-মিষ্টি-সিঙাড়াও পেয়ে যেতাম। যেদিন বাড়ি আসতে পারতাম না, সেদিন কালামদার ওই মাটির ঘরে গিয়ে রাত কাটাতাম। রাত্রে রুটি অথবা ভাত এবং তার সঙ্গে কালামদার জীবন সংগ্রামের গল্প শুনতাম। চাকরি পাওয়ার লড়াইয়ের কথা শুনতাম। শান্তিনিকেতনে বি-এড ট্রেনিং করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনতাম। শুনতে শুনতে নিজেও সাহস পেতাম। কোমর বেঁধে তৈরি হতে শিখতাম। কালামদাকে তখন নেতা বলে মনে হত। মনে মনে স্যালুট জানাতাম।
সত্যিই কালামদা ছিলেন স্বপ্নের কারিগর। তাঁর মাটির কোঠায় একসঙ্গে ঘুমোতে গিয়ে দেখতাম তাঁর হাতে লেখা কবিতার কত পাণ্ডুলিপি। মাঝে মাঝে পাণ্ডুলিপির ফাঁকে ফাঁকে ফুল-পাখি এবং মানুষের মুখের ছবিও। হ্যাঁ, তিনি মাঝে মাঝে ছবিও আঁকতেন। শান্তিনিকেতনে বি-এডে ভর্তি হতে গিয়ে এক্সট্রা কারিকুলার হিসেবে এই অংকনটাকেই সেদিন প্রজেক্ট করেছিলেন। স্যারদের চোখের সামনেই এঁকে দিয়েছিলেন উড়ন্ত পাখির ঝাঁক। এর ব্যঞ্জনার্থ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন গতি ও ঐক্যবদ্ধতাকেই। ভাগলপুরে এম-এ ভর্তি হয়ে বিভিন্ন রেফারেন্স বই থেকে কিভাবে নোটস্-পত্র তৈরি করেছিলেন সে কাহিনিও শুনিয়েছেন। তাঁর তৈরি করা নোটস্-পত্রগুলি এতটাই উচ্চমানের হয়েছিল যে, সেখানকার স্যাররা পর্যন্ত পরবর্তীকালের ছেলেমেয়েদের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। সব শুনতে শুনতে অনেক ভরসা পেতাম। কৃষক পরিবারের নিম্নবিত্ত একটি সন্তান হয়ে জীবন সংগ্রামে কখনো পিছিয়ে আসেননি। একদিকে সাহিত্যের আবেগকে অন্তরে লালন করেছেন, অন্যদিকে সচ্ছলতার মুখ দেখতে চেয়েছেন।
কালামদা বারবার কাজী নজরুল ইসলামের ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি আবৃত্তি করতেন। কখনো ভরাট কন্ঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিও। সাহিত্য আড্ডাগুলিতে গেলে প্রাণ ফিরে পেতাম । সর্বদা মনে হত ‘আমরা করব জয়’। নতুনদের লেখাপত্র অনেক সময় নিজেও পাঠ করে শোনাতেন। কোথায় কী পরিবর্তন হবে বা ছন্দ ঠিক আছে কিনা তা বুঝিয়ে দিতেন। কখনো মেজাজ হারাতেন না। বিরক্তি বোধ করতেন না। একবার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মানোয়ার হোসেনের বাড়িতে সাহিত্য আড্ডার আসর বসেছিল। সারাদিন সারারাত ধরেই সেই আড্ডায় আমরা উপস্থিত ছিলাম। উঠোনে তালাই ও শতরঞ্জি পেতে বসেছিলাম। মানোয়ার সাহেব নিজে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন এবং হারমোনিয়াম নিয়ে গানও গেয়েছিলেন। স্থানীয় কয়েকজন বাউল গায়কও ছিলেন। মনে আছে, ত্রিপল টাঙিয়ে রাত্রিবেলায় আমরা উঠোনেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আরেকবার আলিনগর থেকে ড. শম্ভুনাথ সরকারের বাড়ি সিঙাড়ি পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম।
বীরভূম জেলার প্রান্তিক এলাকা রাজগ্রাম থেকে ‘চরৈবেতি’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালের ১লা মার্চ এই পত্রিকার ২৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। সেই অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম।
বীরভূম জেলার নলহাটির উত্তরে কুখুড়া বলে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামের মাধ্যমিক পড়ুয়া এক ছাত্র দাউদ আলি মুদির দোকান চালিয়েও কবিতা লিখতে আসে। একটি পত্রিকা বের করবে বলে তার আয়োজনও সম্পন্ন করে। পত্রিকাটির নামকরণ করা হয় ‘নক্ষত্র’। তখন ন’য়ের দশকের গোড়ার দিক। তাদেরই আমন্ত্রণে কালামদা অনেক দলবল নিয়ে উপস্থিত হন। সেই আড্ডায় তিনি একটি প্রেরণাদায়ক বক্তৃতা করেছিলেন। সাহিত্য আমাদের কী দিতে পারে, কেন আমরা সাহিত্য করব, কেন সাহিত্যকে ভালোবাসব তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে। জীবনকে ভালোবাসা, মানুষকে ভালোবাসা, দেশ-জাতি-ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ভালোবাসার নামই সাহিত্য। মানুষে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখা, হৃদয়ের তাগিদে হৃদয়কে কাছে ডাকা একমাত্র সাহিত্যেরই কাজ। যে জাতির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা নেই, যে জাতির ইতিহাস চর্চা নেই, সে জাতি পৃথিবী থেকে মুছে যাবে, সে জাতির কোনো গৌরব নেই। কলমদার এই বক্তব্য শুনে সেদিন আমিও গর্বিত হয়েছিলাম। সাদামাটা কালামদার মধ্যে আগুনের স্পর্শ পেয়েছিলাম। যে আগুন আলো দিতে পারে,যে আগুন বিদ্রোহ করতে পারে। সেদিনই বুঝেছিলাম, কালামদাকে ভালোবাসা যায়, শ্রদ্ধা করা যায়,পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা যায়।
কালামদার মুখেই শুনেছিলাম ১৯৮৭ সালে তিনি গোকর্ণ প্রসন্নময়ী হাই স্কুলে সহশিক্ষকের পদে যোগদান করেন। বাংলা সাহিত্যের নামকরা শিক্ষক হিসেবে অল্পদিনেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তারপর ২০০৩ সালে ভবানীনগর জুনিয়র হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ পান। সেখান থেকেই ২০১৪ সালে ডিসেম্বরে অবসর গ্রহণ করেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তাঁর কবিতায় হাতেখড়ি। সেই সময়ের খড়গ্রামের পল্লিমঙ্গল নামক লাইব্রেরির উদ্যোগে প্রকাশিত ‘নয়ামিছিল’ দেয়াল পত্রিকায় একটি কবিতা লিখে আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তী সময়ে খড়গ্রামের মনোয়ার হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘নৈবেদ্য’ পত্রিকায় এবং বীরভূমের কুনুটিয়া গ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘ঝরাপাতা’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। কালামদা বলেছিলেন, ছাত্রজীবনে কাজী নজরুল ইসলামই তাঁকে বেশি প্রভাবিত করেন। তাই কবিতার মধ্যে সরাসরি বিদ্রোহ ফুটে ওঠে। আধুনিক কবিতার বাঁক ও রহস্য এবং জটিলতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। শুধু মানবদরদী মন নিয়ে সমাজের অসাম্য শোষণ নিপীড়নকে তিনি নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও প্রীতি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যা সুন্দর, যা মানবিক, যা ঐশ্বরিক, যা চিরন্তন তারই সাধনা ছিল তাঁর। সহজাত কাব্য প্রতিভাকেই তিনি প্রশ্রয় দিতেন। তাই আড্ডাগুলিতে তিনি পরশপাথর খুঁজতেন। প্রত্যেকটা আড্ডার উপস্থিত কবি-লেখকদের স্বাক্ষর ও ঠিকানা সযত্নে রক্ষা করতেন। তাঁর মোট সাহিত্য আড্ডার সর্বশেষ সংখ্যা ছিল ৩৮৯। এই সর্বশেষ আড্ডাটি হয়েছিল খড়গ্রাম চৌরাস্তার মোড়ে ডাক্তার কামরুজ্জামান সাহেবের বাড়িতে ২০২২ এর ১৮ সেপ্টেম্বর। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিন অসুস্থতার কারণে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি।আড্ডাটি সঞ্চালনা করেছিলেন সুব্রত পাল এবং সভাপতি ছিলেন অনিলকুমার প্রামাণিক। তবে ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল বীরভূম জেলার রামপুরহাট থেকে প্রকাশিত ‘কাঞ্চিদেশ’ পত্রিকা তাঁকে সম্মাননা জানায়। রোগগ্রস্ত হলেও তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
হৃদয় কারবারি কবি আবুল কালাম খুব বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করেননি। তিনটি কাব্যগ্রন্থের নাম আমার জানা আছে:
১) হৃদয়ের বর্ণমালা
২) প্রত্যয়
৩) দি ড্রিবলেট
সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু সংকলন, যেমন:
১) পানসি
২) অর্ঘ্য
৩) বিনায়ক
৪) ধুলিমুঠি
৫) সোনা
তাঁর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজে ঘটে যাওয়া নানা কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অনাচার, শোষণ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ। একমাত্র মানবতাবাদের কাছেই কবি দায়বদ্ধ হতে চাইতেন। সব শ্রেণির মানুষই তাঁর আত্মীয়। বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে তিনি সবকিছু গ্রহণ করতে চাইতেন। অন্ধ আবেগের দ্বারা পরিচালিত মোল্লা-পুরোহিতের সমাজ তিনি পছন্দ করতেন না। যে সমাজ় মানুষকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ঈশ্বর-আল্লাহকে ভালোবাসার কথা বলে, সেই সমাজকে দিশেহারা বলে মনে করতেন। তাই তাঁর কবিতার আক্রমণ ছিল সরাসরি, ছলনা বা কৃত্রিমতাকে তিনি একেবারে বরদাস্ত করতেন না। ‘এসো ভেঙে ফেলি’ নামে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:
“দাঙ্গাবাজরা
কান খুলে শোনো—
তোমাদের খুন-খারাবির চেয়ে
অনেক বড় মানুষ এবং
মানুষের ভদ্রাসনও
হিন্দু মুসলিম খৃষ্টান
বৌদ্ধ জৈন গ্রন্থসাহিব
এসবের চেয়ে হৃদয়ের নির্যাস
পূতঃসলিলা গঙ্গা
সুতরাং এসো—
ভেঙে ফেলি বেড়া
মনুষ্যত্বের ফল্গুধারায়
ধুয়ে ফেলি
দেহ ও মনের তাপ।”
এরকমই প্রতিবাদ,এরকমই হুঁশিয়ারি এবং জাগ্রত বিবেকের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল তাঁর কবিতা। তিনি নিজের সুনাম, যশ-খ্যাতি কিংবা ‘ভালো কবি’ হওয়ার জন্য কবিতা লিখতে আসেননি। চেয়েছিলেন পরিশুদ্ধ মানবিক পৃথিবী তথা মানবিক সমাজ। তেমনি ভাবেই চেয়েছিলেন মানবিক অনুভূতিকে ফিরিয়ে আনতে। তাই সাহিত্য আড্ডা, পত্রিকা প্রকাশ এবং সংযোগের মধ্যে দিয়ে সকলের মননভূমি উর্বর হোক এটাই ছিল লক্ষ্য। আর একটি কবিতায় নিজের চারিপাশে দারিদ্র্য অনাহারক্লিষ্ট অশিক্ষিত মানুষের ভিড় দেখে কবি ব্যথিত হয়েছিলেন। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সেইসব মানুষদের কথা লিখতেই কবিতার নামও দিয়েছিলেন ‘এখানে অন্ধকার’। এই অন্ধকারের কবিতায় লিখেছিলেন:
“এখানে অন্ধকার বড় জমে আছে;
সবুজ ঘাসে, দুধেল কাশবনে, ধানশিষে—
জমাট শ্লেষা হয়ে আছে।
জারুলের বনে খটাখট্ মাথা ঠোকে আঁধার পেঁচক;
এখানে আলোও বড় অসহায়
মরুর নিঃস্বতা এখানে মণিপুরী নাচে;
এখানে অন্ধকার বড় জমে আছে।…”
এই অন্ধকার আজও দূর হয়নি। কবি হৃদয়ের শূন্যতা নিয়ে বধির হয়ে গেছেন। কিছু কিছু কবিতায় প্রকৃতি ও প্রেমের রোমান্টিক ভাবনার কথাও আছে। যেমন ‘তুমি’,’আহ্বান’,’তোর ডাক’ ইত্যাদি। তবে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরই বেশিরভাগ কবিতাতেই জোরালো। বিশেষ করে ‘মুষ্টিবদ্ধ হাত’, ‘কালাহাণ্ডির মা’ প্রভৃতি কবিতাগুলি। বাংলা ভাষা, ফেব্রুয়ারি ২১ নিয়েও কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন। ৪৭ বছর ধরে ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখা কম কথা নয়। তাঁর ‘কবিতাসমগ্র’ বের করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক এই আবেদন থাকবে সকলের কাছেই। ১৯৫৫ সালের পহেলা জানুয়ারি এই কিংবদন্তি সাহিত্য আড্ডার নায়ক জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রাম থানার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম কাঁন্দুরিয়ায়। পিতা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র চাষি আনোয়ার তৌহিদ, মাতা তোজেমা বিবি গৃহকর্ত্রী। সারাজীবন সাহিত্য সাধনা করে এবং সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সাংসারিক জীবনকেও অবহেলা করেছেন বলে শোনা যায়। শেষজীবনে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে অসহ্য কষ্টের মধ্যে কবির দিনযাপন। আমরা কি কবিকে ভুলে যাব? এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত করে আজও কেউ দেয়নি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
শামসুল হক এস এইচ নীর on নাকাবা কিংবা বিপর্যয়ের দিনগুলো