spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকজয় বাংলা, জয় পাকিস্তান?

লিখেছেন : মীর সালমান শামিল

জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান?

মীর সালমান শামিল

এক– ❝ একটা কথা বলি, শেখ সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে “জয় বাংলা”র সাথে সাথে “জয় পাকিস্তান” শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন। এখন এই ভাষণ নিয়ে নানা বিতর্ক-বিতন্ডা চলছে। আমি ছােট্ট মানুষ। আমাকে কেউ সাক্ষ্য দিতে ডাকবে না। আমি যেমন শুনেছি, তেমনি বললাম। ❞

— আহমদ ছফা, বেহাত বিপ্লবঃ ১৯৭১ ॥ আগামী প্রকাশনী, পৃ: ৮৪

দুই– ❝ ৭ই মার্চের বক্তৃতার শেষে “জয় পাকিস্তান বলা এদিক দিয়ে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এটা এখন আওয়ামী লীগের লােকেরা অস্বীকার করে কারণ তার কোন রেকর্ড নেই। ৭ই মার্চের পর রেডিও তাদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকার সময় তারা জয় পাকিস্তান শব্দদ্বয় মুছে ফেলেছিল। ❞

— বদরুদ্দীন উমর, আমার জীবন (৩য় খন্ড)॥ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, পৃ: ১৪২

তিন– ❝ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, জয় পাকিস্তান। ❞

— এ.কে খন্দকার, ১৯৭১: ভেতরে বাইরে ॥ প্রথমা, পৃ: ৩২

চার– ❝ ৭ মার্চের মিটিং-এর বিশেষ বর্ণনা দেব না। লক্ষাধিক লােকের সমাগম হয়েছিল, মাথায় লাল ফিতা বাঁধা ও হাতে লাঙল নিয়ে কৃষকেরাও সমবেত হয়েছিল। বন্ধু বান্ধবের সাথেই উপস্থিত ছিলাম। সকলেই আশা করছিলাম যে সেদিন স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়া হবে। আসলে আমাদের এ ধারণা ছিল আবেগপূর্ণ এবং বিতর্কিত।

৭ মার্চের সভায় তাঁর বক্তব্য পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে শেষ করেছিলেন। তাতে তিনি তাে কোনাে অন্যায় করেন নি। পাকিস্তান অবিভক্ত ছিল রাজনৈতিকভাবে। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চলছিল জনমতের দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। সুতরাং রাজনীতিক হিসেবে তিনি তার ভাষণ সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত করেছিলেন। লক্ষাধিক লােক থেকে সেদিন কোনো প্রতিবাদ আসে নি। অবশ্য তার বক্তব্য শেষ করার পরমুহূর্তে ছাত্রনেতৃবৃন্দের পরামর্শে তিনি মাইকে ফিরে এসে জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন, যা সেদিন সমবেত জনগণকে উল্লসিত করেছিল। পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলাতে কোনাে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় নি এবং তাঁর ভাষণ রাজনৈতিকভাবে সুষ্ঠু ও সঙ্গতিপূর্ণই ছিল।

অথচ আজকাল ৭ মার্চের এই ভাষণ থেকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ কথাটি মুছে ফেলা হয়েছে। কেন? কী কারণে? এতে আমি মনে করি মুজিবুর সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে খাটো করা হয়েছে। আরও বড় ক্ষতি হয়েছে, যে সম্প্রদায় এই কাজটি করেছেন তার প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে। ❞

— কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধঃ একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা || অবসর প্রকাশনা, পৃ: ১২-১৩

পাঁচ– ❝ ৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে বক্তৃতা দিলেন, তা যেমন ছিল ঐতিহাসিক তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বললেন বটে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, কিন্তু ঘোষণা দিলেন না আনুষ্ঠানিকভাবে। শেষ করলেন ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে। ❞

— শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, (ছাত্রলীগ সভাপতি,
৭২ সালের সংসদের চীফ হুইপ), বলেছি বলছি বলব ॥ ঐতিহ্য, পৃ: ৩৭

ছয়– ❝… তবে একথা সত্য, শেখ সাহেব ৭ মার্চের বক্তব্যের শেষদিকে বলেছিলেন, জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান। আমি জানি, আমার এ বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক আছে, কানাডা থেকে একদল ছেলে লিখে জানিয়েছেন, আপনি মিথ্যা লিখেছেন। কানাডা কেন? ঢাকারও অধিকাংশ লােকের বিশ্বাস আমি মিথ্যা বলেছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত করেনি।
শেখ সাহেব যে জয় পাকিস্তান বলেছিলেন তার অন্যতম সাক্ষী আমার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক লন্ডন প্রবাসী আবদুল গাফফার চৌধুরী। আমি জানি না, সে কথা আজ তার মনে আছে কিনা। তবে তিনি আমার সঙ্গে জনসভায় প্রথম সারিতে বসে ছিলেন৷ ❞

— নির্মল সেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ “জয় পাকিস্তান” বিতর্ক’ ॥ (সংগৃহীত) আমার জীবনে একাত্তর || বর্তমান সময়। পৃ: ১১

সাত– ❝ ৭১-এর ২৫শে মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ইয়াহিয়ার সাথে আপােষ আলােচনা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতেই ছিল। ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য যতই স্বাধীকারের পটভূমিতে বিশ্লেষিত হােক না কেন তাও ‘জয় বাংলা’ আর জয় পাকিস্তানে’র উচ্চকিত শ্লোগানে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আপােষ মীমাংসার ধুম্র জালে আবদ্ধ ছিল।

‘৭১-এর ২৫শে মার্চের আলােচনা শেষে যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাক বাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালী জনতার উপর সশস্ত্র আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে ভূট্টোসহ তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে করাচির পথে ধাবমান তখন রাত ৮.৩০ মিনিটে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের সাংবাদিকদের নিকট প্রদত্ত বক্তব্য ‘আলোচনা ফলপ্রসু হয়েছে আর মাত্র ঘােষণা বাকি-এই বক্তব্যের তাৎপর্য আর যা-ই হােক রাত ১২টায় শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণার কোন প্রেক্ষাপটের সাক্ষ্য বহন করে না। ❞

— অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫ || বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সােসাইটি – অক্টোবর, ২০১২ (পঞ্চম সংস্করণ)। পৃ: ১৭ (তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা)]

আট– ❝ কবি শামসুর রহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকন্ঠে ‘কালের ধূলোয় লেখা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিল ‘জিয়ে পাকিস্তান’। আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের কথা শুনেছি, যারা আওয়ামী ভাবধারার মানুষ। ❞

— হুমায়ূন আহমেদ, জোছনা ও জননীর গল্প ॥ অন্য প্রকাশ, পৃ: পূর্ব কথা অংশ

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (১৯৯৬) প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘বাংলাদেশের তারিখ’ (১৯৯৮) গ্রন্থের ৩৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের শেষে ‘জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছিলেন।


বিচারপতি হাবিবুর রহমান, জেনারেল এ.কে খন্দকার এবং কবি শামসুর রাহমান এই তিনজন দ্বিতীয় বা তৃতীয় সংস্করণে জয় পাকিস্তান অংশ বাদ দিয়েছেন এবং ক্ষমা চেয়েছেন অথবা ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছেন। এতে সমস্যার সমাধান হয়নি বরং বেড়েছে। কারন তাদের মত এত বড় মাপের মানুষের এত স্পর্শকাতর অংশে এত বড় ভুল করবে এটা স্বাভাবিক না। আর উনারা ক্ষমা চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শাসন আমলে, আওয়ামী লীগের রোশানলের পরার পরে। বাকীরা নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন নাই।


এখানে প্রশ্ন চলে আসে ১৯৬২ সালের আগে থেকে ভারতের টাকায়, ভারতের প্রেসক্রিপশনে রাজনীতি করা মুজিব কেন জয় পাকিস্তান বললো?

……….
লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. আলোচনা ভালো লাগলো।
    ইতিহাস এভাবেই আলোর মুখ দেখে‌।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ