মহিবুর রহিম
তিতাসপাড়ের গৌরব বাংলা ভাষার মহত্তম যুগস্রষ্টা কবি আল মাহমুদকে দেয়া হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পদক। এ পদক আল মাহমুদ জীবদ্দশায় প্রাপ্য ছিলেন কিন্তু নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে এ পদক থেকে বঞ্চিত করা হয়। এখন আমাদের দাবি ছিল কবি আল মাহমুদকে মরণোত্তর এ পদক দেয়া হোক। বর্তমান সরকার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে এ পদক দিয়ে জাতিকে ধন্য করেছে। এ উপলক্ষে আমরা কবিকেও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি।
আল মাহমুদ ছিলেন ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি প্রতিভা। তিনি একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার , শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। তাঁকে বলা হয় পরিপূর্ণ কবি প্রতিভা। সাহিত্যে একটি নিরঙ্কুশ নতুন যুগের নির্মাতা তিনি। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এনং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা উত্তর কালে বাম ভাবাপন্ন সরকার বিরোধীদের পরিচালিত দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনা করে বিতর্কিত ও গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ ছাড়া পান এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সহ পরিচালক পদে যোগ দান করেন। আল মাহমুদ সাহিত্য অঙ্গনেও সর্বদা আলোচিত বিতর্কিত ছিলেন। কিন্তু যতটা তিনি সমালচিত হয়েছেন গৃহীত হয়েছেন অনেক বেশি। কারণ তিনি অভিনব এক গীতল কাব্য ধারার জন্ম দিয়েছিলেন যা আবহমান বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যকে নতুন ভাব ও আঙ্গিকে তুলে ধরেছে।
এই প্রতিভাবান ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। পিতা মীর আবদুর রব। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়, কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলের পড়াশোনা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু।
আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষি নির্ভর লোকায়ত পরিবেশে। এখানে প্রায় শৈশবেই সাহিত্য রচনায় তার হাতেখড়ি ঘটে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে একটি লিফলেট প্রকাশের দায়ে কবির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে তিনি পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। যা তার সাহিত্য জীবনকে ত্বরান্বিত করে। আত্মপ্রত্যয়ী কবি ঢাকায় আসার পর সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সাধনা করে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য কবিতার বই- ‘লোক লোকান্তর'(১৯৬৩), ‘কালের কলস'(১৯৬৬), ‘সোনালি কাবিন'(১৯৭৩), ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো'(১৯৭৬), ‘বখতিয়ারের ঘোড়া'(১৯৮৫),’এক চক্ষু হরিণ'(১৯৮৯),’মিথ্যাবাদী রাখাল'(১৯৯৩),’আমি দূরগামী'(১৯৯৪),’দোয়েল ও দয়িতা'(১৯৯৬),’দ্বিতীয় ভাঙ্গন'(২০০০),’নদীর ভিতরে নদী'(২০০৩),’সেলাই করা মুখ'(২০০৮) প্রভৃতি।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’,’উপমহাদেশ’,’যে পারো ভুলিয়ে দাও’,’নিষিন্ধা নারী’,’আগুনের মেয়ে’,’মোহিনীর জীবন ঝংকার’। আল মাহমুদের গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত'(১৯৭৫),’সৌরভের কাছে পরাজিত'(১৯৮৩),’গন্ধবণিক'(১৯৮৮),’ময়ূরীর মুখ’১৯৯৪),’নদীর সতীন'(২০০৪) প্রভৃতি।
আল মাহমুদ তাঁর সৃষ্টিশীল অবদানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে ‘একুশে পদক ‘(১৯৮৬), ‘ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার'(১৯৮৭), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার(১৯৮১),অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার(১৯৭৪), সুফি মোতাহার হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক(১৯৭৬), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক(১৯৯৩)সহ অসংখ্য সাহিত্যপদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। কলকাতা থেকে আল মাহমুদ পেয়েছেন জয় বাংলা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭২),কাফেলা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪) এবং সমান্তরাল কর্তৃক গৌরবময় দ্বিতীয় ভানুসিংহ সম্মাননা পদক(২০০৪)।
১৯৫৪ সাল থেকে আল মাহমুদের কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। এ সময় তিনি ঢাকা ও কলকাতার পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিতে পুরোদমে মনযোগী হন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে প্রবল আলোচনার সূত্রপাত হয়।
তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তাঁর কবিতায় নতুন ব্যঞ্জনায় ধারণ করেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সফল প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালি কাবিন’। তবে আল মাহমুদ প্রতিটি গ্রন্থে অনন্য সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি জসীমউদদীন ও জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এক কাব্য ধারার প্রবর্তক।
১৯৯০-এর দশক থেকে তাঁর কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এর জন্য তিনি প্রগতিশীলদের চরম সমালোচনার মুখোমুখি হন। তবে ঈশ্বরানুগত্যের কারণে তার কবিতার কাব্যগুণ ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি । বরং তা বাংলা কবিতার নতুন টার্ন বা বাঁক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যেও আল মাহমুদের অবদান একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে দেশের খ্যাতনামা পত্র-পত্রিকায় আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘কালানৌকা’, ‘জলবেশ্যা’, ‘মীর বাড়ির কুরসিনামা ‘, ‘বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা’ প্রভৃতি গল্প প্রকাশিত হলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেন তিনি আমাদের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিই শুধু নন, অপ্রতিদ্বন্দ্বী গল্পকারও। উপন্যাস, প্রবন্ধ, আত্মচরিত রচনায় তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। বাংলা সাহিত্যের এই বহুমুখী প্রতিভার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মান স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তিতে কবিকে জানাই গভীর গভীরতর শ্রদ্ধা।