spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকতারেক রহমান এবং বাংলাদেশের রাজনীতি

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

তারেক রহমান এবং বাংলাদেশের রাজনীতি

কাজী জহিরুল ইসলাম 

গত কয়েক বছর ধরে তারেক রহমানের বক্তব্য, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। তাতে আমার মনে হয়েছে তিনি একজন যোগ্য এবং প্রজ্ঞাবান নেতা হয়ে উঠেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসনিক অবকাঠামো, কূটনৈতিক দূরদৃষ্টি, বাজার অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে গত দেড় দশক ধরে তিনি পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে, শুধু গ্রন্থপাঠই নয়, দূরে থেকে হলেও, তিনি বাংলাদেশের মানুষকেও নিয়মিত পাঠ করছেন। এখন তাকে একজন যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক বলা যায়। 

আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জয়লাভ করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারেক রহমান হবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি যদি মহাত্মা গান্ধীর মত কিংবা সোনিয়া গান্ধীর মত দেশের প্রধানমন্ত্রী না হন, দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং দলের অন্য কোনো নেতাকে সরকার গঠন করতে বলেন তাহলে শুধু নিজেই বড়ো হবেন না, একই সঙ্গে বাংলাদেশও সভ্যতার দৌড়ে পৃথিবীর অনেক উঁচুতে উঠে যাবে। পৃথিবীর সকল মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়বে তার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য। এমন কী তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ক্ষমতালোভীদের নিবৃত্ত করার রোল মডেল হবার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেতে পারেন। অন্যদিকে তখন প্রকৃতপক্ষে দেশে একজন প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্বেও তিনিই হবেন দেশের মূল রাষ্ট্রনায়ক, ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্র। আমি আশা করবো দীর্ঘদিন পশ্চিমে অবস্থান করে তিনি রাজনীতির এই নির্মোহ অবস্থানের কৌশলটিও শিখে নিয়েছেন। 

যদি তিনি লোভ সামলাতে না পারেন, যদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি কেমন প্রধানমন্ত্রী হবেন? ড. ইউনূসের অব্যবহিত পরে যিনিই তার স্থালাভিষিক্ত হন না কেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হঠাৎই একটা ছন্দপতন ঘটবে। দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়-আশয় তিনি খুব ভালোভাবেই সামলাবেন এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু বহির্বিশ্বে ড. ইউনূসের কারণে বাংলাদেশ যে উচ্চতায় উঠে গেছে সেখান থেকে হঠাৎ কয়েক ধাপ নিচে পড়ে যাবে। যোগ্য কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী  এবং একদল কূটনৈতিক পেলে হয়ত তিনি কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সরকার প্রধান ছিলেন শেখ হাসিনা। তার শাসনামলে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, শিক্ষা, সততাসহ সকল সফট অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। এইসব তিনি রিপ্লেস করার চেষ্টা করেছেন কিছু সিমেন্টের অবকাঠামো দিয়ে, সেগুলোও দেশের জন্য নয়, অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। মেরুদণ্ডহীন, পরনির্ভরশীল বিদেশনীতি বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় হাসি-কৌতুকের পাত্রে পরিণত করেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিকে তিনি দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে বৈধ কার্যপ্রণালি করে তুলেছেন। ধর্ষক, খুনি, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের পুরস্কার-সম্মাননা, পদোন্নতি দিয়ে এইসব অনৈতিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। 

দুর্বল শাসকদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও শেখ মুজিবুর রহমান। ভালো শাসকদের মধ্যে ড. ইউনূস ও জিয়াউর রহমান সবার ওপরে, এরপরেই ফখরুদ্দিন আহমদ ও খালেদা জিয়ার সরকার। 

তো এই সকল রাষ্ট্রনায়কদের যদি একটা গড় করি তাহলে আমার বিচারে তারেক রহমানের অবস্থান হবে স্ট্যান্ডার্ড লাইনের কিছুটা ওপরে। তিনি ড. ইউনূসকে পুরোপুরি রিপ্লেস করতে না পারলেও একজন ভালো শাসক হিসেবে ইতিহাসে নিজের নাম লেখাতে পারবেন। 

বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করবে এবং তারেক রহমান বাংলাদেশের পরবর্তী সরকার প্রধান হবেন, একথা নিশ্চিত জেনেই আমি দল হিসেবে বিএনপিকে সমর্থন করছি না। কেন করছি না? কারণ বিএনপিও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং আরো কিছু দলের মত নিজের দলের মধ্যে রাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

বিএনপিতে একটি রাজপরিবার আছে। দলের দ্বিতীয় প্রধান থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত সকলের মুখে এই রাজপরিবারের স্তুতি। তাদের একজন রাজা ছিলেন, একজন রাণি আছেন, একজন যুবরাজ আছেন, রাজকন্যা আছেন। কার পরে কে দলের সিংহাসনে আরোহন করবেন সব ঠিক করা আছে। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না। তারেক রহমান মারা গেলে তার স্ত্রী জোবায়দা দলের প্রধান হবেন, তিনি না থাকলে তাদের কন্যা জাইমা রহমান হবেন। দলের অন্য নেতাদের যত যোগ্যতাই থাক শীর্ষ পদে বসার সুযোগ আর কারো হবে না। এই পদে বসার একমাত্র যোগ্যতা রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করা। বিএনপির সকল সভায় রাজা-রাণি এবং যুবরাজের ছবি দিয়ে ব্যানার তৈরি করতে হয়। এই দলের  দ্বিতীয় প্রধানের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক সহকর্মীর মত হলেও প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় প্রধানের সম্পর্ক প্রভূ এবং ভৃত্যের মত। তারেক রহমান তার বক্তব্যে ‘প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ’ বলে দলের কর্মীদের সম্বোধন করেন বটে, হয়ত তিনি তা আন্তরিক ভাবেই করেন, কিন্তু দলের মধ্যে যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তাতে কোনো কর্মীই তাকে তাদের সহকর্মী ভাবার দুঃসাহস করেন না। তাদের অন্তরে আছে, তিনি আমাদের প্রভূ, তার হুকুমই আমাদের জন্য আইন। আপনি যদি বিএনপির কোনো কর্মীকে দুটো অপশন দেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ রাখবে নাকি তারেক রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী চলবে? বিনাবাক্যব্যায়ে বলবে, তারেক রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী চলবো। একই চিত্র আমরা দেখেছি, এখনও দেখছি আওয়ামী লীগের মধ্যেও। যারা বিএনপি বা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন তাদের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য রাজ-পরিবারের প্রধান ভৃত্য, অর্থাৎ দলের মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদক হওয়া। দলের প্রধান হবার কথা তারা কেউ কখনো চিন্তাও করে না। তারা ভুলে কখনো তা স্বপ্নেও দেখে না। 

রাজতন্ত্রের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো, দলের বড়ো পদগুলোতে কে বসবেন তা কোনো গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্ধারিত হয় না, এইসব বিষয়ে রাজপরিবারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। হাসিনার আমলে আমরা দেখেছি কে মন্ত্রী হবেন, কে দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন তা ঠিক করেন হাসিনা ও তার বোন রেহানা এবং তাদের পুত্রকন্যারা মিলে। দলের পদ নির্বাচনের জন্য লোকদেখানো একটা কাউন্সিল হত বটে কিন্তু কে কোন পদ পাবে তা হাসিনা ও তার পরিবারই ঠিক করত। একই ঘটনা বিএনপিতেও ঘটে। 

শুধু জাতীয় পর্যায়ের কমিটিই না, ছোটো ছোটো ইউনিট কমিটিও, অঙ্গসংগঠনের কমিটিও রাজপরিবারের আশির্বাদ ছাড়া হয় না। 

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কিন্তু এইসবের বেশ উর্ধেই ছিলেন। তিনি তার পরিবারের কাউকে রাজনীতিতে টানেননি। তিনি চাননি তার মৃত্যুর পরে পরিবারের কেউ তার স্থালাভিষিক্ত হোক। কিন্তু তার মৃত্যুর অল্প কিছুকাল পরেই একদল চাটুকার বেগম খালেদা জিয়াকে টেনে এনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলের ভেতরে রাজতন্ত্রের পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে ফেলেন। এর কিছুকাল আগেই ভারতে প্রশিক্ষিত মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। বাংলাদেশে শুরু হলো দ্বিধারার রাজতন্ত্র। একই পদাঙ্ক অনুসরণ করলো জাতীয় পার্টি।

পারিবারিক ডাইন্যাস্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে রাজনীতি হয়ে গেছে মেধাশূন্য। মেধাবীরা তো আর কোনো রাজপরিবারের দাস হতে চাইবে না। একটি শিশু বা কিশোর তার স্বপ্নের রাজ্যে সবসময় প্রথম হতে চায়, পারুক বা না পারুক কক্ষনো সে দ্বিতীয় হতে চায় না। যখন কৈশোরেই জেনে যায় রাজনীতিতে প্রথম হবার কোনো সুযোগ নেই তখনই সে তার গন্তব্য অন্যত্র ঠিক করে ফেলে। এই ব্যবস্থা ভাঙতে না পারলে মেধাবী নেতৃত্ব আসবে না এবং দেশের প্রকৃত কোনো অগ্রগতিও হবে না। 

ঠিক এই সময়টাতে জুলাই বিপ্লবের নায়কেরা একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে, তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তাদের কাছে মানুষের এই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে যে অতীতের দলগুলো যেসব ভুল করেছে, দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে, তারা সেইসব ভুল থেকে শিক্ষা নেবে এবং সঠিক পথে অগ্রসর হবে। দেশপ্রেম, সততা এবং গণতন্ত্র এই তিনটিকে কেন্দ্রে রেখে তারা যদি উন্নয়নের রাজনীতি করে, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখে, তাহলে তাদের মধ্যেই জ্বলে উঠবে সম্ভাবনার উজ্জ্বল আলো, তারাই হবে আমাদের বাতিঘর।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১১ মার্চ ২০২৫

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
শামসুল হক এস এইচ নীর on নাকাবা কিংবা বিপর্যয়ের দিনগুলো