আবু তাহের তারেক
তিনটা কিতাব পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদি আপনে পুব বাংলার মানুষের রাজনীতির স্বরূপ বুঝতে চান। প্রথমটা হইল মহা বিখ্যাত হজরত রিচার্ড ইটনের, ‘দ্য রাইজ অব ইসলাম এন্ড দ্য বেংগল ফ্রন্টিয়ার’। এইটা একটা রূপকথার মত বই। যারা ইতিহাস বলতে তথ্য উপাত্ত বুঝেন, বইখানা তাদেরকে হতাশ করবে। ইতিহাস তারিখের চাইতেও বেশী কিছু। আসল কথা, এই কিতাব অনুসারে, আমরা হাজার বছরের ট্রাডিশনাল বাংগালি না! আমার মনে হয়, এইটা একটা বড় ধাক্কা হইতে পারে, যেকোন পাঠকের জন্য। পরের যেই ইলিম, তা হইল, পীর ফকিরদের শ্রম, কাম, ঘাম- তাদের মেহনতের কারণেই, আজ পুব বাংলা এই রূপে আসতে পারছে। এইখানে আইসা এই প্রশ্ন করা সম্ভব- হজরত এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীরা নিজেদেরকে এই পীর ফকিরদের রক্তের মানুষ বইলা দাবী করলেও, তারা কি উনাদের আইডিওলজি ধারণ ও বহন করেন! কতটুকু!
দুই নম্বর যেই কিতাবের কথা বলব, তার আগে একটা কথা বইলা রাখা ভালা। আমরা হজরত আহমদ ছফার ‘বাংগালি মুসলমানের মন’ পইড়া বেহুশ হই। নিজেদের অতীত লইয়া অনুতাপ করি। কিন্তুক, আহমদ ছফারই অনুকরণে, পুথি সাহিত্যকে বিগ রেফারেন্স বানাইয়া, হজরত রাফিউদ্দিন আহমেদ লেখছেন, বিখ্যাত কিতাব, ‘বেংগল মুসলিমস, এ কোয়েস্ট ফর আইডেন্টিটি’। রাফির কিতাব ইটনের কিতাবেরই আধুনিক রূপ। ব্রিটিশ কলোনাইযেশনের একটা ভাল মানের সামারি। আর, তার ভিত্তি হইল পুব বাংলার মানুষ। এই কিতাব সাকসেসফুলি দেখাইতে পারছে, কলোনির আমলে কিভাবে মুসলমানদের পরিচয়ের লড়াই করতে হইছে। মজার কথা, এই বই, পুব বাংলার মুসলমানদের সবগুলা সংগ্রামের ফসল হিসাবে; আজাদিরে লোকেট করতে পারছে। দেখা গেল, পার্টিশনে আসার আগের যে লড়াইটা আমাদেরকে করতে হইছে, তার লগে কৃষক, মজুর, আলিম উলামা, চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদরা জড়িত।
বিশেষ করে, আলিম উলামাদের অবদানের স্বরূপ বুঝার জন্য, রাফিউদ্দিনের উক্ত কিতাবের পাশাপাশি, হজরত বারবারা মেটকাফের, ‘ইসলামিক রিভাইভাল ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ কিতাবখানা পড়া দরকার। আলিমদের অবদান, ত্যাগ আর লড়াই নিয়া আমরা যতটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি, এই বই পড়লে, সেইটা আর এইভাবে করতে পারব না।
এই তিন কিতাবের মূল সুর একই- পুব বাংলার কৃষক মজুরদের একটা লড়াই আছে। আলিম উলামারা সেই লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অনেকেই এখন ‘শাপলা আর শাহবাগ বাইনারী’ কথাখান খুব আওড়ান। তাদেরকে বলব, বাইনারী বলেন, আর লড়াই বলেন, তা মোটেও মিথ্যা নয়। শাহবাগে যারা জড়ো হইছিলেন, তাদের মেজরিটির আইডিওলজির খোজ করলে, ইতিহাসের গেইজ দিয়া পর্যালোচনা করলে, দেখবেন যে- শাহবাগপন্থীরা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক জালিমদেরই উত্তরসুরী। এরা নব্য কলোনাইজার। এদের মনোভাব জমিদারসুলভ। তারা অত্যাচারী। দমনের খাসিয়ত তাদের অংগে অংগে। হজরত ফ্রাঞ্জ ফানোর জবানে, এরাই সেই ‘ব্লাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক’। এদের ভাষা কলকাতার। এদের স্পিরিটের জায়গা কলকাতার তথাকথিত রেনেসা। এরা ইউরোপীয় চেরাগায়নের বরকন্দাজ। খিয়াল করবেন, তাদের অনেকেই চব্বিশের লাল জুলাইয়ের অংশ হইলেও, এদের মধ্যকার রিয়াল ফেইসগুলা জুলাইয়ের নায়ক হইতে পারে নাই। কারণ, লাল জুলাই পুব বাংলার কৃষক-প্রজার আইডেন্টিটি তৈয়ারের রাফিউদ্দিন কথিত সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা। এইখানে জমিদারশ্রেণীর নয়া বরকন্দাজরাই ভিলেইন থাকবে, স্বাভাবিক!
তো, শাপলা কি! আমাদের ইয়াং উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সাম্প্রতিক লেখা হইতে ভাল কইরা বুঝতে পারবেন, শাপলা কি। তার আগে বলি- ব্রিটিশ পিরিয়ডে আলিম উলামারা, ও মুসলমান পরিচয়ধারীরা চরম নিপীড়নের শিকার হইছিলেন। তাদেরকে, এমনকি, দাঁড়ি রাখার কারণেও ট্যাক্স দেওয়া লাগত! তো, ‘১৩ সনে এইরকম একটা কলোনিয়াল বন্ডেজ তৈয়ারের মহড়া বসছিল শাহবাগে। যার স্বরূপ এত নোংরা আর ভয়াবহ আছিল যে, একজন তরুণ মাহফুজ আলম শাপলার আন্দোলনে জড়ো হইছিলেন, নবীর শান-মান রক্ষার খাতিরে। কার্ল মার্ক্সরে ধার কইরা বলি, ধর্ম মানুষের পরিচয় তৈয়ার করে। ধর্ম ধার্মিকরে সুরক্ষা দেয়। শাহবাগ ধর্মরে আঘাত করার মাধ্যমে, ধার্মিকদেরকে, অর্থাৎ, মুসলমান বডিরে আঘাত করছিল। শাপলা মূলত প্রত্যাঘাত। শাপলা একটা প্রতিরোধ।
এই প্রতিরোধে নিয়ম নীতি সর্বোতভাবে রক্ষা করা গেছে, তা আমরা বলব না। নাস্তিক নামধারী কারো কারো জান নাশ করা হইছে। কে বা কারা করছে, সরকার তার খোজ নেয় নাই। যেইটা জরুরী আছিল। নাস্তিক মানেই ঘৃণ্য- এই আইডিয়াও জেনারেট করা হইছে। আর, শাপলার আলিমরা তো, মুঘল আমলের ইটন কথিত পীর দরবেশ নন! অথবা, রাফিউদ্দিন বর্ণিত ব্রিটিশ কলোনির সেই আলিমও তারা নন। শাপলার আলিমদের নিজস্ব সংকট আছে। দুর্বলতা আছে। তদুপরি, লাল জুলাইয়ে তাদের সিগনিফিকান্ট আত্মত্যাগের ঘটনা তাদেরকে ঐতিহাসিক মজলুমের কাতারেই শামিল করে। তাদের পদচ্যুতি অনেক হইছে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির স্বরূপ, সেই অর্থে, বুঝতে পারতেছেন না। তার পরেও, শাপলার আলিমদের জেনেটিকসে নিপীড়িতের ক্রন্দন রোলই আপনে শুনতে পাইবেন, অনেক বেশী করে।
শাপলা আর শাহবাগ কুনু তথাকথিত বাইনারী না। এইটা পুব বাংলার কৃষক-মজলুমদের লড়াই- নব্য জমিদার, আর তাদের আন্ডা বাচ্ছাদের লগে। লাল জুলাইকে সেই দার্শনিক জায়গা হইতে পাঠ করা জরুরী। আর জরুরী, একেবারের মিনিমাম হইলেও, উপরের তিনটা কিতাবরে মন দিয়া রিড করা।