আনিসুর রহমান
পিনাকী ভট্টাচার্যকে বাংলাদেশের আপামর জনতা এক্টিভিস্ট ও ইউটিউবার হিসেবে জানলেও তিনি একজন লেখক। তিনি বিচিত্র সব বিষয়ে লিখেছেন। তার বইয়ের বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, রাজনীতি, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ।
পিনাকী ভট্টাচার্যের জন্ম ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৬৭ সালে, বগুড়ায়। পড়াশোনা করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে।
পিনাকী ভট্টাচার্যের বাবার নাম শ্যামল ভট্টাচার্য। যিনি ছিলেন বগুড়া জেলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। শ্যামল ভট্টাচার্য বগুড়া জেলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিকট একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন।
পিনাকী ভট্টাচার্য ছিলেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা। বিভিন্ন বাঁকবদলের মাধ্যমে তিনি আজ কমিউনিস্ট বিরোধী একজন তাত্ত্বিক।
তিনি শাহবাগ আন্দোলনেরও একজন সংগঠক ছিলেন কিন্তু তিনি পরে সেটা ভুল বুঝতে পেরে জনতার কাছে ক্ষমা চান এবং পরে শাহবাগ বিরোধী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেন।
পিনাকী ভট্টাচার্য আওয়ামী লীগ বিরোধী এক্টিভিজমের কারণে ২০১৮ সালে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং ফ্রান্স গমন করেন। ফ্রান্সে বসেই তিনি লীগ বিরোধী ভিডিও ও এক্টিভিজম শুরু করেন পুরোদমে।
পিনাকী ভট্টাচার্যের অডিয়েন্স কারা?
দেখা গেছে, পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁর ইউটিউব ভিডিওর কারণে সমাজের একেবারে গভীরে পৌঁছে গেছেন। একজন টেইলার্স কাপড় সেলাই করতে করতে তারঁ ভিডিও শুনছে। একজন মুদি দোকানি ব্যবসা করার ফাঁকে ফাঁকে পিনাকী ভট্টাচার্যের ভিডিও শুনছে অথবা অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারী চাকুরীজীবী অবসরে তাঁর ভিডিও শুনছে। তিনি তাঁর এক্টিভিজমের মাধ্যমে পৌঁছে গেছেন বড় লোকের এসি রুমে কিংবা শ্রমিকের কাঠের ঘরে। তাঁর এক্টিভিজমের অডিয়েন্স হচ্ছে তারাই, যারা রাজনীতির অলি গলির খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করছেন।
পিনাকী ভট্টাচার্য মাঝে মাঝে স্ল্যাং শব্দ ব্যবহার করে দর্শকদের উদ্দীপিত করার চেষ্টা করেন। তাঁর অডিয়েন্স হচ্ছে তারাই যারা সরাসরি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মাঠে অথবা অনলাইনে সরব থেকেছেন।
পিনাকী ভট্টাচার্যের এক্টিভিজম কীভাবে জনগনকে আকর্ষণ করেছে?
আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী আমলে পিনাকী ভট্টাচার্যের ভিডিও বক্তব্যে উঠে আসত আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনার নানা অপকর্মের তথ্য। শেখ হাসিনা কী বলেছেন, কোন মন্ত্রী কী বলেছে, আওয়ামী লীগের কোন নেতা কী বলেছে সেসবের উপর নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থাকত এবং তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর ও বিভিন্ন বই থেকে রেফারেন্স সংগ্রহ করে একেকটা ভিডিও বানাতেন। তাঁর একেকটা ভিডিও হত ১০ থেকে ৩০/৩৫ মিনিট করে। দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য একটা ভিডিওতে যা যা বলা দরকার তাই তিনি করতেন। প্রতি দুই বা তিনদিন পরপর তিনি একেকটা ভিডিও ছাড়েন, দর্শক সন্ধ্যার সময় হলে তার ভিডিও দেখার জন্য বসে যায়। ফ্যাসিবাদী সময়ে মানুষ যখন কথা বলতে ভয় পেত, পত্রিকা টেলিভিশন কিছু লেখত না বা লেখার সাহস করত না সেসময়ে তিনি জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে ভূমিকা রাখেন।
আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী আমলে জনগণ পিনাকী ভট্টাচার্যের ভিডিও বিরোধী রাজনীতিবিদদের থেকেও বেশি শুনত, কারণ তাঁর ভিডিওতে তথ্য উপাত্ত থাকত। অন্যদের ভিডিও ৫/১০ মিনিট শুনলেই যদি বিরক্ত চলে আসত, তাঁর ৩০ মিনিটের ভিডিও শুনতেও তেমন ক্লান্তি লাগতো না। কারণ, তাঁর ভিডিওতে থাকতো দর্শককে উদ্দীপিত করার ক্ষমতা।
পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁর ভিডিওতে কথা বলেন বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায়। তার সেসব কথা মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। দর্শক সেসব ভিডিওতে নিজেকে আরো সম্পৃক্ত করতে পারেন।
পিনাকী ভট্টাচার্যের বর্তমানে ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার তিন মিলিয়নের চাইতেও বেশি। এত বেশি সাবস্ক্রাইবার বর্তমান দেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক এক্টিভিস্টের নাই। এটাই পিনাকী ভট্টাচার্যের সফলতা। তাঁর ভিডিওতে গড় ভিউ হয় এক মিলিয়ন। কখনো কখনো সেটা দেড় বা দুই মিলিয়নও ছাড়িয়ে যায়। যেটা দেশে রাজনৈতিক এক্টিভিস্টদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলনে পিনাকী ভট্টাচার্যের ভূমিকা ছিলো অসাধারণ। ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে ভারত আওয়ামী লীগকে একতরফাভাবে সমর্থন করে, সেজন্য তিনি ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলনের ডাক দেন।
তিনি তখন ঘোষণা দেন, ‘আমরা ১৮ কোটি জনগণ, আমরা কিনতে পারি, আমরা ক্রেতা আমাদের কেনার শক্তিতে ইন্ডিয়া শক্তিশালী হইতেছে, সে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হইয়া আমাদের অধিকার হারা করিছে, সে হাসিনাকে সাপোর্ট করিচ্ছে, আমাগির টাকা নিয়া হাসিনাকে সাপোর্ট করি। আমরা আজ থিকা, এই মুহূর্ত থিকা, ইন্ডিয়ার পণ্য বয়কটের ঘোষণা দিলাম। আমরা মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট বয়কট করব। মিছিল করতে হবে না, মিটিং করতে হবে না, রক্ত দিতে হবে না, জেলে যাইতে হবে না, শান্তিপূর্ণ বয়কট ইন্ডিয়া মাইনকে চিপা পড়বে শুধু আও আও করবে, কিছু বলবার পারবে না।’
পিনাকী ভট্টাচার্যের সেসময়কার ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক জনগণ দারুণভাবে সাড়া দিয়েছিল।
পিনাকী ভট্টাচার্য বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাস করছেন এবং এক্টিভিজমের পাশাপাশি একের পর এক বই লিখে চলেছেন। তাঁর সর্বশেষ বইয়ের নাম ‘ফুলকুমারী’। যেটি একটি আত্ম-চরিত।
তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৯ টি।
পিনাকী ভট্টাচার্যের প্রকাশিত বইগুলো হলো-
মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম, মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ, রবি বাবুর ডাক্তারি, সোনার বাঙলার রূপালী কথা, ধর্ম ও নাস্তিকতা বিষয়ে বাঙালি কমিউনিস্টদের ভ্রান্তিপর্ব, ভারতীয় দর্শনের মজার পাঠ, ডিসকোর্স অন মেথড : জ্ঞানের পদ্ধতি বিষয়ে পর্যালোচনা, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ: সাফল্যের তত্ত্ব-তালাশ ,মন ভ্রমরের কাজল পাখায়, বালাই ষাট, ওয়েদার মেকার, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ: অন্য আলোয় ঈশ্বর আত্মা কারণ, ইতিহাসের ধুলোকালি, এনলাইটেনমেন্ট থেকে পোস্ট মডার্নিজম: চিন্তার অভিযাত্রা।