ফরিদ উদ্দিন রনি
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বইটি মাত্র পড়ে শেষ করলাম। গতকাল বইটির মোড়ক উন্মোচনের পর থেকে যে পরিমাণ সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে জাতীয় সরকার গঠন নিয়ে তারেক রহমানের সাথে ভার্চুয়াল মিটিং, সারজিস-হাসনাতদের বঙ্গভবনে যাওয়ার খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ হওয়া এবং হাসিনা পতন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের গ্রুপ ছবিতে শিবির নেতা সাদিক কায়েমকে কাট করে বাদ দেয়া নিয়ে যেভাবে তুলোধুনো করা হচ্ছে তাকে, আমি একপ্রকার ধারণা করেছিলাম এই বইতে প্রচুর ভুজংভাজাং কথাবার্তা থাকবে। যেসব আদতে তৃতীয় পক্ষের লেখা, শব্দের খেলা!
পুরো বইটি পড়া অবস্থায় আমার একবারও মনে হয়নি, তাঁর ভেতর এ অসততা কাজ করেছে। ইতিহাসতো নিরেট বস্তু না যে আপনি তার এক্সাক্টলি বর্ণনা দেবেন। ঘটনায় যে যেভাবে সম্পৃক্ত তার ওপর সে ন্যারেটিভ উপস্থাপন করবে, ইতিহাস এভাবেই হাজির হয় মানুষের সামনে।
একাত্তর দেখেন। ঘটনা সত্য; কিন্তু হাজার রকমের বয়ান। যে যেভাবে অবজারভেশন করেছে সে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেভাবে বয়ান হাজির করছেন। সম্মুখসারির যোদ্ধারাই।
এই বই নিয়ে ‘বিকৃতি’ শব্দে যে সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, তা অমূলক মনে হচ্ছে। সম্ভবত এর একটি কারণ হতে পারে, বইটি প্রথমা থেকে বের হওয়া।
লেখার শুরুতেই তিনি ক্ল্যারিফিকেশন দিছেন, তাঁর লেখাই যে জুলাইয়ের ইতিহাস তা নয়, তাঁর দিক থেকে অভিজ্ঞতা এই বইতে তুলে ধরেছেন। জুলাইয়ের অসংখ্য ঘটনা তাঁর অজানা, বিশেষ করে আয়নাঘরে বন্দি সময় ও মিন্টু রোডে ডিবি কার্যালয়ে থাকা অবস্থায় বাইরের ঘটনা তিনি কিছুই জানতেন না। সবাই যখন যার যার জায়গায় থেকে জুলাই নিয়ে লেখবেন, তখন মানুষের কাছে অনেক কিছু পরিস্কার হবে।
ভূমিকায় এই ধরনের ক্ল্যারিফিকেশন দেওয়ার পর ছোট খাটো দু-একটা বিষয় ছাড়া সমালোচনা করার মতো বইয়ে বড় কোনো ইস্যুজ আছে বলে মনে হয় নাই।
৫ জুন থেকে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) এবং পরবর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত তিনি তাঁর সাইড ভার্সনের একটা ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়েছেন গল্পের মতো করে। এই বর্ণনায় তাঁর সমালোচনা করার মতো যে জিনিস আমার চোখে পড়ছে তা হলো, তিনি যেখানে স্বয়ং উপস্থিত, কর্মসূচি গ্রহণে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেখানে ডিটেইলসে গেছেন, আর যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা কম বা নাই, সেখানে খুব একটা ডিটেইলসে যান নাই। দু-এক বাক্যে শেষ করে গেছেন। যেমন: বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি, হল থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা, ৯ দফা… ইত্যাদি।
বইয়ে তেমন কোনো এক্সক্লুসিভ তথ্য ছিল না, যা এখনো জনপরিসরে আসে নাই। তারেক রহমানের সাথে ভার্চুয়াল মিটিং হইছে এটা সবার জানা ছিল, বাট এখানে ডিটেইলস জানা গেল কারা এটা এ্যারেঞ্জ করছেন, তারেক রহমানের সাথে তাদের আলাপ কী ছিল, তাঁর রিঅ্যাক্ট কী ছিল, এটা আরেকটু ক্লিয়ারভাবে জানা গেল। এতটুকুই এক্সক্লুসিভ।
কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনবল সাপোর্টের জন্য দু’চারটা বাক্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার কথা আসলেও স্পেসিফিকভাবে কারো ভূমিকা নিয়ে আলাপ করেননি তিনি। তবে একাধিক বাক্যে বলেছেন, শিবির এবং ছাত্রদলের কাছে যখন সহযোগিতা চেয়েছেন তারা করেছেন, কিন্তু বিএনপি এবং জামায়াত নিজেরা কর্মীদের কোনো দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন কিনা তা তিনি জানেন না। ৩০ জুলাইও ফখরুল সাহেবের সাথে তাদের কথা হয়, তাঁরা সরকার পতনের ইংগিত দিলেও ফখরুল সাহেব বলছেন, ‘আমরা তো বড় দল। সরকার পতন নিয়ে এখনো ভাবছি না।’
তবে বইয়ে দুইটা তথ্য ইন্টারেস্টিং মনে হইছে, তাঁরা পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আখতারকে শুরু থেকে দৃশ্যপটের বাইরে রেখেছেন। যাতে করে শিবির ট্যাগ না দিতে পারে। তিনি নিজে পূর্বের সরকারবিরোধী সব পোস্টও অনলি মি করে দিয়েছিলেন। নাহিদ খুব একটা পরিচিত ছিল না বলে তাকে নিয়ে সমস্যা হয় নাই। আরেকটি তথ্য হলো, আন্দোলনে পরিসর বাড়ার পর সমন্বয়কদের নির্দিষ্ট গ্রুপের বাইরেও নির্দিষ্ট ২৫ জনের আরেকটা সিক্রেট গ্রুপ করছিলেন কমিউনিকেশন করতে, যাতে পলিসি নির্ধারণ অন্যদের হাতে না যায় এবং তাদের কথা অন্যখানে ফাঁস না হয়।
বইয়ে কয়েক জায়গায় সারজিস-হাসনাতের ওপর ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দু’জন একাধিক সিদ্ধান্তে তাদের পলিসির বাইরে গিয়েছেন এ কারণে। ডিজিএফআইয়ের সাথে মিটিং করে আন্দোলন প্রত্যাহার করার কথা শোনার পর থেকে তাদের বিশ্বাস করা নিয়ে সন্দেহও পোষণ করেছেন৷
পুরো বইটিতে ৫০টির মতো ছবি ইয়ুজ করেছে জুলাইয়ের। সবগুলো ছবিই প্রথম আলোর ফটোগ্রাফারদের তোলা। সাদিক কায়েমকে গ্রুপ ছবি থেকে কাট করে বাদ দেয়ার ঘটনা বোধহয় তারা ইনটেনশন্যালি করেছে, যা আসিফের দৃষ্টিগোচর হয়নি৷ আমি প্রথম আলোর ওয়েবসাইট চেক করেছি ৫ আগস্ট তাদের নিউজে যে ছবি ইয়ুজ করেছিল সেখানে সাদিক কয়েম ছিলেন কিনা। দেখলাম তাদের ইউটিউব সংবাদ সম্মেলনের ভিডিওতে থাম্বনেইলে ছবিতে সাদিক কায়েম আছেন। তখনো তাঁর পরিচয় সামনে আসেনি। তার মানে যে এঙ্গেল থেকেই ছবিটি তোলা হোক, মূল ছবিতে তিনি ছিলেন। তাকে কাট করে বইয়ের ছবি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, যে সাইড থেকেই করা হোক। এটা ইনটেনশন্যালি করা হয়েছে। এই কাজটা মোটেও উচিত হয়নি। আমি আসিফ মাহমুদকে রিকোয়েস্ট করব, পরবর্তী সংস্করণে তিনি যাতে নির্দেশ দেন প্রকাশনীকে, ওয়াইড ছবি পুরোটা যেন ব্যবহার করে।
যাই হোক বর্ণনা যে টিউন ছিল, তাতে আমার কাছে মনে হইছে আসিফের লেখা/জবানবন্দি থেকে শ্রুতিলেখন করতে প্রকাশনী তথ্য যোগ-বিয়োগ করেন নাই। কিংবা আসিফ সে সুযোগ দেন নাই। তাঁর বর্ণনার ওপরই সম্পাদনা করেছে।
অন্যান্য যাঁরা লিড করেছে জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের উচিত নিজেদের অভিজ্ঞতা মানুষের সামনে হাজির করা। এমনকি অংশীজন সকল রাজনৈতিক নেতাদেরও জুলাইয়ে ইতিহাস লেখা উচিত। সব সাইডের বয়ান মানুষ জানুক। তাহলে মানুষের কাছে আরও পরিষ্কার হবে জুলাইয়ের ইতিহাস।