মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন
ধর্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে গত কয়েকদিন বেশ হৈ চৈ এবং এর বিচার চেয়ে সারাদেশে সবাই মোটামুটি উত্তাল হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রও এ বিষয়ে সোচ্চার। কিন্তু এর শেষ কোথায়? ধর্ষণ প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীর সকল জায়গায় চলছে। কোনো কোনো জায়গায় এর মাত্রা অসহনীয়, আবার কোনো জায়গায় ধর্ষণের চেয়ে প্রপাগাণ্ডা বেশি। কিন্তু ধর্ষণ ধর্ষণই। একে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের বিচার বা প্রতিকার বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। কেননা যে প্রক্রিয়ায় একে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং আইনের সুনির্দিষ্ট দুর্বলতার মাধ্যমে দীর্ঘ বিচারহীনতার প্রেক্ষাপটে ধর্ষকরা স্বাভাবিক বা তুচ্ছ ঘটনা হিসেবে একে বিবেচনায় নিয়ে নিয়মিত এই অপকর্মটি চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কমে কোনো নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।
সংবিধানের এই সংজ্ঞায়নে বেশ কয়েকটি অস্পষ্ট দিক আছে, যা ধর্ষকদের অনুকূলে যায়। এক, দেশের আইন অনুযায়ী আঠারো বছরের নিচে কোন নারীর বিবাহ করার অধিকার নেই। সেখানে ষোল বছরের বিধান রাখায় এটি সাংঘষিক এবং কিছু প্রক্রিয়াকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি কারো হয়রানি হওয়ার রাস্তাটিও উন্মুক্ত থেকে গেল। দুই, বিবাহিত জীবনে কোনো নারী যদি স্বামীর সাথে প্রতারণা করে এবং পরপুরুষের সাথে মিলিত হয়, সে প্রক্রিয়ায় কোনো স্বামী জোর করলে কী হবে তা স্পষ্ট নয়। কেননা, অবাধ ইন্টারনেটের যুগে পরকীয়া সম্পর্কের আসক্তি অনেক বেশি। তিনি, ষোল বছরের নিচে কোনো নারীর সাথে সম্মতিক্রমে কোনো পুরুষ যৌন মিলন করলে সেটি ধর্ষণ হলে তার শাস্তি কেবল পুরুষকেই কেন পেতে হবে! অর্থাৎ এ ধরণের আইনি দুর্বলতা একজন ধর্ষককে বাঁচিয়ে দিচ্ছে।
ধর্ষণের কারণগুলোর দিকে। এর সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। অঞ্চল ভেদে মানুষের জীবনাচারের প্রেক্ষাপটের উপর ভর করেই ধর্ষণের কারণসমুহ পরিবর্তিত হয়। তবে মোটা দাগে বলা হয় পুরুষের যৌন কামনার অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছার ফলে এবং বিচারহীনতার ফলে ধর্ষণ বেশি হয়। এখানে প্রথম অংশটি আংশিক সত্য। কেননা একটি নির্দিষ্ট বয়সে নারী ও পুরুষ উভয়েই যৌন কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য সঙ্গী খুঁজতে থাকে। আর এ প্রক্রিয়ায় মানুষ মনুষত্ব্যহীন হয়ে উঠলেই যেকোন একপক্ষ ধর্ষণের শিকার হতে পারে বা হয়।
তবে একথা স্বীকার করতে হবে বাংলাদেশে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ ব্যবহার অন্যান্য প্রাচীন কারনের পাশাপাশি ধর্ষণের মাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে। যুদ্ধ চলাকালীন বিষয়গুলোকে এ প্রক্রিয়ার সাথে বিবেচনা করা ঠিক নয়। একথা স্পষ্টতই স্বীকার করতে হবে, এদেশের নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বেশ প্রবল। ফলে, পুরুষ সহজেই তার পশুশক্তির ব্যবহার করে এবং নারী তার দুর্বলতা প্রকাশ করে প্রতারণার শিকার হয়। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার কারণে যেকোন ধর্ষণের পর আওয়াজ উঠে নারীর পোষাক নিয়ে। অথচ পোষাকের বিষয়ে ধর্মীয় বিধান নারী ও পুরুষের জন্য সমান প্রযোজ্য এবং যেকোন প্রেক্ষাপটে এটি পুরুষতান্ত্রিক মনেবৃত্তিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কাজে লাগানো হয় এবং নারীর উপর দায় চাপানো হয়। তিনি কোনোভাবেই পুরুষ নন যিনি নারীর অশালীন পোষাক দেখে যৌনবাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাকে আবার কেউ পশু বলেন, যা পশুর প্রতি অবিচার, কেননা পোষাকহীন পশুদের মধ্যে এমন আচরণ নেই। তারা অমানুষ ও জানোয়ার ছাড়া কিছু নয়। উল্লেখ্য, ধর্মীয় আলোচনাগুলোতে এসব নিয়ে অরুচিকর কিছু কথা বলা হয়, যা পুরুষদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্ধুদ্ধ করে।
আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে এখন সেভাবে পশ্চিামা সংস্কৃতির আদতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, অবাধ স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন নাটক ও সিনেমায় যে প্রক্রিয়ায় নায়ক-নায়িকার মেলামেশা এবং তাদের ব্যক্তি জীবনের খোলামেলা ছবি বা কাহিনী প্রদর্শন করা, লিভটুগেদারের মতো জঘণ্য কাজকে নরমালাইজেশনের উদ্যোগ্যে কিছু মিডিয়ার কাণ্ডজ্ঞানহীন ভূমিকা পালন, পর্ণ সাইটগুলোকে অবাধ করে দেওয়া, অরুচিকর কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে যৌন সুরসুরি দেওয়ার বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ আনতে না পারলে ধর্ষণের এ মাত্রা শেষ হবে না। কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে উন্মুক্ত স্থানে প্রেম নিবেদন করার নামে একে অন্যের কাছে আসে তা প্রতিহত করার জন্য নৈতিক শিক্ষার প্রচলন খুব জরুরি।
বর্তমান বিশে^ আধুনিকতার নামে নগ্নতার প্রদর্শনী চলছে খুব সস্তায়। প্রকাশ্য দিবালোকে বয়োজেষ্ঠরা যখন ধুমপান করে তখন উঠতি বয়সীরা তাদের সম্মানের জায়গাটা হারিয়ে ফেলে এবং ধীরে ধীরে বেহায়পনায় লিপ্ত হতে সাহসী হয়ে উঠে। ক্যারিয়ার গড়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বলার মাধ্যমে নারী ও পুরুষ উভয়কে বিকৃত যৌনাচারের দিকে ঠেলে দেওয়ার যে প্রবণতা তা দূর করাও আবশ্যক।
উল্লেখিত সবগুলো কারনের বাহিরে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রিয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও স্থানীয় বিচার-সালিশের নামে যে অনাচার ঘটে চলেছে তা এসব ধর্ষণকে উদ্ধুদ্ধ করছে। ধর্মীয় আইন এদেশে চালু নয় দু’টি কারনে: এক. যারা ধর্মীয় আইন কায়েম চান তারা ধর্মীয় রীতিনীতি বা আইনগুলোর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সাধারণ জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারননি। বরং যে প্রক্রিয়া তুলে ধরেন তা আম-জনতাকে আতঙ্কিত করে তোলে। দুই. যারা ধর্মীয় আইনের বিরোধীতা করেন তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ হয় ধর্মীয় আইন সম্পর্কে কোন ধারণা নেই অথবা তারা পশ্চিমা অপসংস্কৃতিকে চরিত্রার্থ করে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থকে বাস্তবায়ন করে এবং এ দু’পক্ষই এসব অপব্যাখ্যা বা দুর্বলতাকে প্রতিষ্ঠিত করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরবে নিজেরাই ধর্ষণ করেন। যার অনেকাংশই প্রকাশ পায়না বলে, সমাজে হৈ চৈ হয় না।
সমাজের বিত্তবানদের জোরপূর্বক সম্পর্ক স্থাপন বা তাদের প্রলোভনে পড়ে যেসব যৌন বিকৃতির ঘটনা বিগত দিনগুলোতে ঘটেছে সেগুলো কখনো বিচারের মাধ্যমে শেষ হয়নি। আনভির কর্তৃক মুনিয়ার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক, ধর্ষণ ও হত্যার বিচার যেমন হয়নি, তেমনি তনু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ ছিলনা। হয়নি বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় মধ্যবিত্ত মেয়েদের নানা পার্টি বা অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে কৌশলে যৌনসঙ্গম করে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার পর তাদের বিচার না করা তেমনি গ্রামীণ সালিশের নামে যেসব অনাচারের মাধ্যমে ধর্ষককের বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিচারও না করা।
আরেকটি ভয়ানক বিষয় হলো কর্মস্থলে ধর্ষণের যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলির কোনো বিচার হয় না। যেমন পুলিশ বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সেগুলোর বিরুদ্ধে কেবল বিভাগীয় ব্যবস্থা তথা বদলি করা হয়। ফলে, এসব ঘটনা থামানো কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক যে বিষয়টি নিয়ে আমরা উদাসীন তা হলো সংঘবদ্ধ হয়ে ধর্ষণ করা। বিশেষ করে জুলাই-২৪ অভ্যূত্থানের পরবর্তী সময়ে এ ঘটনাটি বেশ কয়েকবার ঘটেছে। অথচ এগুলো কারণ বের করা এবং শাস্তি দ্রুত ও প্রকাশ্য করা খুব জরুরি ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রক্রিয়া হিসেবে এই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পার। হাসিনা সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আইন না মানার প্রবনতা আগের চেয়ে বেড়েছে এবং তারাও অনেক ক্ষেত্রে ইভটিজিং করছে, নারী তথা সহপাঠীর প্রতি কামনার দৃষ্টিতে অপকর্ম করছে এবং এমনকি সমযোতার মাধ্যমে অনেকটা প্রকাশ্যে যৌনমিলনের লিপ্ত হচ্ছে, যা সমাজ কাঠামোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
দেশে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো মাগুরার আছিয়া ধর্ষণকাণ্ড ও তার মৃত্যু। বোনের শশুর এই ধর্ষণকাণ্ডটি ঘটিয়েছে ভগ্নিপতির সহায়তায় এবং তাদের রক্ষা করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল বোনের ভাশুর তথা অভিযুক্তের আরেক ছেলে। অর্থাৎ এটি একটি পারিবারিক সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যা। এখানে প্রশ্নহলো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণ থাকার পরও তাদের যখন প্রচলিত আইনের দোহাই দিয়ে দীর্ঘদিন জেলে রাখা হবে তখন আরেকটি ঘটনা সামনে এসে এটির অপমৃত্যু ঘটবে এবং আসামীরা একদিন সবার অজান্তে বেরিয়ে আসবে। এখানে আইনের বিচারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্তান বাবাকে দিয়ে ধর্ষণটি কেন করিয়েছে! কেনো পুরো পরিবারটি এর সাথে জড়িয়ে গেল! হতে পারে যৌতুক সংক্রান্ত বিষয়, বা পারিবারিক কোনো বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব বা অন্য কোন কারণ।
এভাবে প্রতিটি ঘটনার পিছনে কেবল পুরুতান্ত্রিক চিন্তাকে দায়ী করলে সত্য কখনো বেরিয়ে আসবেনা এবং ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র উদ্ঘাটিত হবে না। এক্ষেত্রে করণীয় হতে পারে: অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ প্রমাণ হলে দ্রুত প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এবং ধর্ষণের কারণ উদ্ঘাটন করা । বিচার কার্যকর হওয়ার পরও এটি চলমান রাখতে হবে। কেননা পরবর্তী কারণসমুহ যেন দ্রুত চিহ্নিত করা যায়। ধনী ও গরিব সবার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগের নিশ্চয়তা করতে হবে। স্থানীয় বিচার-সালিশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। কেননা, ধর্ষণের মামলা তাদের মাধম্যে হলে প্রকৃত বিচার যেমন সম্ভব নয় তেমনি ধর্ষিতা ব্যক্তি বা পরিবার ভয়ে সত্যকে সামনে আনবে না। ধর্মীয় আলোচনায় নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ একপাক্ষিক বক্তব্য বন্ধ করতে হবে। বিত্তবানদের বিচার যতদ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করে তা প্রকাশ্যে কার্যকরার মাধ্যমে আইনের প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। যেসব বিচার পুলিশ, ডাক্তার ও বিচারক বা অন্যকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় আছিয়াদের ঘটনা সময়ের সাথে হারিয়ে যাবে এবং মনুষ্যত্বহীন এক সমাজ আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।
………….
(লেখক সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।)