রেজা তানভীর
১৩ ই মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাত বছরের মাথায় দ্বিতীয় দফায় চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এলেন। তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য ছিলো রোহিঙ্গা সংকট ও মানবাধিকার প্রসঙ্গ।
১৪ ই মার্চ আন্তোনিও গুতেরেস ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করলে ইউনূস তাঁকে বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যেগের কথা জানান। আন্তোনিও বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগের প্রতি তাঁর সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন এবং যেকোনো সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলে জানান। গুতেরেস বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি তার সহানুভূতির কথা জানান, তবে এও জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভুলতে বসেছে।
ড. ইউনূস বৈঠকে আন্তোনিও গুতেরেসকে আগের সরকারের ভঙ্গুর অর্থনীতির কথা এবং খুব দ্রুতই যে দেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে বলেন। গুতেরেস আগের সরকারের সঙ্গে ১৯৭৪ সালের পর্তুগাল বিপ্লবের দিনগুলোর কথা তাঁকে বলেন।
ওইদিন ১৪ ই মার্চ আন্তনিও গুতেরেস কক্সবাজারের উখিয়ায় গিয়ে রোহিঙ্গাদের সাথে ইফতার করেন। ওই ইফতারে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা উপস্থিত ছিলো। তিনি প্রতি বছর একটি মুসলিম দেশকে বেছে নেন ইফতার করার জন্য। এবার বাংলাদেশে এসেছেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই ইউনূসের আমন্ত্রণ আছে। গুতেরেস ইফতার করার পূর্বে পাঞ্জাবি পরিধান করে আসেন এবং জানা যায়, রোহিঙ্গা রোজাদারদের সম্মানার্থে তিনি সারাদিন রোজা রাখেন।
তিনি রোহিঙ্গা শিবিরও পরিদর্শন করেন। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের সময় সেখানে শিশু, তরুণ, ইমাম ও নারী শিক্ষকদের সঙ্গে আলাদাভাবে মতবিনিময় করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
ইফতার পূর্ব বক্তৃতায় আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘স্থিতিশীলতা ফিরে না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা একটা মানবিক সংকটের মধ্যে আছি। বিভিন্ন দেশের মানবিক সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে আছি। রোহিঙ্গাদের খাদ্য রেশনের পরিমাণ আরও কমিয়ে আনার ঝুঁকিতে আছে। এ ধরনের দুর্যোগ আমরা প্রত্যাশা করি না। কারণ, মানুষের দুর্ভোগ হবে এবং মারাও যেতে পারে।’
তিনি আরো বলেন,‘যতক্ষণ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পাশে না দাঁড়ায়, আমি এই ইস্যুতে কথা বলেই যাব। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। বাংলাদেশের মানুষের জমি, বন, সম্পদ রোহিঙ্গাদের জন্য উৎসর্গ করে দেওয়ার কৃতিত্ব তাদের দিতেই হবে।’
১৫ ই মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ের নতুন অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় তিনি অফিস প্রাঙ্গণ পরিদর্শন করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোকচিত্রী প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। পরে সেখানে তিনি জাতিসংঘের পতাকা উত্তোলন করেন।
১৬ ই মার্চ দুপুরে জাতিসংঘ মহাসচিব ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন। আয়োজন করে জাতিসংঘ ঢাকা কার্যালয়। এতে সরকারের প্রতিনিধি, সংস্কার কমিশনের প্রধানেরা এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।
গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া সূত্র বলছে, বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচনের আগে কতটুকু সংস্কার হবে, এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব শেষে তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশের অংশীজনেরাই সংস্কার বাস্তবায়ন করবে। কতটুকু এবং কীভাবে করবে, সে বিষয়ে তাদেরই ঠিক করতে হবে। জাতিসংঘ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কারে সহায়তা দিয়ে যাবে।
ওইদিন বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথেও তিনি একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি বলেন,
‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে।’
ওইদিন সন্ধ্যায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস’র সম্মানে প্রধান উপদেষ্টা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক ইফতার পার্টির আয়োজন করেন।
ইফতার পার্টিতে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন,
‘দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বজুড়ে অনেক সীমান্তই বন্ধ। আপনারা যে অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অনুসরণ করা উচিত। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা যে আতিথেয়তার সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের জীবনে এর অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।’ বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করে গুতেরেস বলেন, ‘এটি দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম নিখুঁত গণতন্ত্রে পরিণত করতে সাহায্য করবে।’
ওইদিন রাতে তিনি কয়েকজন তরুণ প্রতিনিধির সাথেও বৈঠকে অংশ নেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর বেশ ইতিবাচক। তিনি রোহিঙ্গাদের সাথে আগামী বছর তাদের দেশে ইফতার করতে চান।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের কোনো অন্তর্নিহিত স্বার্থ রয়েছে কি না! যদি তা–ই থাকে, তাহলে সেটিও মাথায় রেখে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। কেননা, ভারত ও চীন তাদের নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।’