মীর সালমান শামিল
একাত্তরের যুদ্ধ শুরুর পর কোলকাতায় আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থন চেয়ে ইজরাইলের কাছে চিঠি লেখে এবং ইজরাইলের মানুষ এবং ইজরাইলের সরকার আকুন্ঠচিত্তে দাঁড়ায়, সব ধরনের সমর্থন জানায়। মার্চ মাসেই ইজরাইলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এব্বা এবেন নেসেটে (ইজরাইলের সংসদ) পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে দীর্ঘ আবেগময় ভাষণ দেন।
ইজরাইলের মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে কোলকাতার সরকারের কাছে সাহায্য পাঠাতে শুরু করে। তখনো ভারতের ইজরাইলের সাথে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার কূটনৈতিক রীতি ভঙ্গ করে ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনামূল্যে বিভিন্ন ভারী অস্ত্র-শস্ত্র দেবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি আরো প্রতিশ্রুতি দেন বাংলাদেশকে যেন পশ্চিমা দেশগুলো স্বীকৃতি এবং সমর্থন দেয় সে জন্য বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের শক্তিশালী ইহুদি লবি কাজ করবে। সব ইহুদি এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে সে ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতি দেন।
আমেরিকান সাংবাদিক গ্রে ব্যাস(Gray Bass) The Blood Telegram বইতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সচিব পিএন হাসকারের বরাত দিয়ে লিখেছেন ১৯৭১ এর জুলাই মাসে গোল্ডা মেয়ার ইজরাইলের অন্যতম সমরাস্ত্র উৎপাদক Shlomo Zabludowicz কে আদেশ দেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যতটা সম্ভব অস্ত্র পাঠাতে। Shlomo Zabludowicz মুক্তিবাহিনীর জন্য বিপুল অস্ত্র পাঠায়। পুরো প্রক্রিয়াতে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
লন্ডনের কিংস কলেজের সাবেক গবেষক এবং বর্তমানে ভারতের থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান Carnegie India এর ইতিহাসবেত্তা শ্রীনাথ রাঘাবান তার ‘1971: A Global History of the Creation of Bangladesh’ বইতে এই ব্যাপারে আরো বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। ইজরাইল জুন মাসের ৬ তারিখ ফ্রান্সে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ইজরাইল অস্ত্রের পাশাপাশি যুদ্ধের প্রচারের কাজে অর্থ সহয়তা করে। পরবর্তীতে ইজরাইল, ইজরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (IDF) এর উচ্চ পর্যায়ের চৌকস প্রশিক্ষক দল পাঠায় মুক্তি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে। IDF এর এই প্রশিক্ষক দল ছিল গেরিলা যুদ্ধের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। তারা মুক্তিবাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়।
তবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় আরো আগে৷ ১৯৬৮ সালে ‘র’ গঠিত হওয়ার পরপরই ভারত সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে তার একটি আউটপোস্ট প্রতিষ্ঠা করে। এই অফিসটি ব্যবহৃত হতো মূলত বিদেশে পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। এই লিয়াজোতে ‘র’কে সহায়তা করে ‘মোসাদ’।
IDF সাথে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের এত ভাল সম্পর্ক হয়ে যায় যে তারা ভারতের চেয়ে ইজরাইলকে বেশি বিশ্বাস করা শুরু করে। মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী তাঁর বই ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং মুজিব বাহিনী’ তে এমন ইঙ্গিতই করেছেন। এক জায়গায় লিখেছেন,
❝ এক পর্যায়ে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ও অস্ত্রসম্ভার কমিয়ে দেওয়ায় আমরা তাদের (ভারতের) মতিগতি সম্পর্কে আরও সন্দিহান হয়ে পড়লাম। এমতাবস্থায় আমরা বিকল্প উৎস হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করি। ❞
আলতাফ পারভেজের মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী বইতে উল্লেখ করেছে ইসরায়েল দুই শত যোদ্ধাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিতে তেল আবিব নিয়ে যেতে চেয়েছিল- কিন্তু ভারতীয়রা তাতে রাজি হয়নি। শেষতক গিয়েছিলো কিনা সেটা জানা যায়নি।
একাত্তরে ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধের মূল নায়ক ছিল জেনারেল জ্যাকব ফারজ রাফায়েল। তিনি জেএফআর জ্যাকব নামেই বিখ্যাত। জাতিসংঘ এবং চীনের প্রবল চাপের মুখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণে আপত্তি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু সিনিয়রদের কমান্ডের বাইরে গিয়ে জ্যাকব সব ধরনের চাপের উর্দ্ধে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সচেষ্ট ছিলেন।
দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে জ্যাকবের ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে হটাতে সফল হয়। দখলের পর তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সকল যোগাযোগ মাধ্যম ধ্বংস করেন। এছাড়া জেনারেল নিয়াজিকে ভুল তথ্য দিয়ে, ব্লাকমেইল করে দ্রুততম সময়ে আত্নসমর্পণে বাধ্য করেন। জেনারেল জেএফআর জ্যাকব ছিলেন ইহুদি। আর সকল ইহুদিই(যে দেশেই জন্ম হোক না কেন) ইজরাইলের নাগরিক।
ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার তার বই ‘Beyond the Lines’-এর ২১৮ নম্বর পাতায় উল্লেখ করেছেন, একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্রসমর্পণের জন্য প্রস্তুত ছিল এবং সেভাবে প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু তারপরেও আত্নসমর্পণ হয় ২৪ ঘণ্টা পরে এবং নজিরবিহীনভাবে খোলা মাঠে। কেন এই বিলম্ব? এ প্রশ্নের জবাবে জেনারেল জ্যাকব নায়ারকে বলেছিলো,
❝ New Delhi wanted to humiliate Islamabad by showing that MUSLIM COUNTRY had laid down arms before a JEW ❞
জেনারেল জ্যাকবকে সম্মাননা দিয়ে ইজরাইল সরকার জেনারেল জ্যাকবের সামরিক পোশাকটি বিশেষ মর্যাদায় ইজরাইলের জাতীয় সামরিক জাদুঘর ‘Latrum’-এ সংরক্ষণ করে রেখেছে।
তার মৃত্যুর পরে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ইজরাইল দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের স্কোপাস পাহাড়ের অ্যামিউনিশন হিলে অবস্থিত ইহুদিদের জাতীয় বীরদের সম্মানে বানানো ওয়াল অব অনারে জ্যাকবের নাম খোচিত করে। এই পাহাড়ে মাত্র ৩৬০ জন জাতীয় বীরের নাম খোদাই করা আছে।
পাকিস্তানি বাহিনী আত্নসমর্পণের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইজরাইল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইজরাইল বাংলাদেশকে একদম প্রথমের স্বীকৃতি দানকারী দেশের একটি। এবং ইহুদি লবিগুলোর তৎপরতার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোও দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত কথা বললেও বুদ্ধিজীবীরা ইজরাইলের এই মহানুভবতার কথা বেমালুম চেপে গেছে।। কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশীদের পুরস্কৃত করে। সেখানেও সরকার গোল্ডা মেয়ার বা ইজরাইলি সরকারের অকুণ্ঠ সহায্যের কথা চেপে যাওয়া হয়৷
…………..
লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।