স্বচ্ছ দে
[ক]
কিছুক্ষণ আগে যা করেছি, কেন করেছি বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু করে ফেলেছি। পাঁচ ছয়টি সিসি ক্যামেরার সামনে দিয়ে দশ পনেরো জন মানুষের ভিতর থেকে তিন মাস ধরে খোঁজা বইটি কাছে পেয়ে লোভ সামলাতে পারলাম না। বইটি হাতে খেল দেখিয়ে নিজের ব্যাগ ঢুকিয়ে ফেললাম। সহজ কথায় বলতে গেলে বইটি আমি চুরি করে ফেললাম। ধীরে-ধীরে ও বই এ বই দেখে-দেখে দাম করতে-করতে বই দোকান থেকে বের হয়ে পড়লাম।
বইটির নাম ছিলো কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র। গত তিন মাস ধরে ময়মনসিংহে তন্ন-তন্ন করে খুঁজলাম পেলাম না। অনলাইন প্লাটফর্মে পেলাম, দাম অনেক। কেনা সম্ভব না। আজ যখন গাঙ্গিনাপাড়ের দিক দিয়ে যাচ্ছি, ভাবলাম সংকলন অথবা আজাদ অঙ্গনে একটু ডুব দিয়ে যাই। ডুব দিতে গিয়েই ভুল করলাম নাকি আমার এতোদিনের সাধনা পূরণ হলো জানলাম না। বইটি হাতে পেয়ে গেলাম। দাম দেখলাম একহাজার টাকা। এতো টাকা আমার কাছে নেই। কখনো ছিলো না।
আগামীকাল সপ্তমী। দূর্গাপূজার শুরু। সবাই এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে যাবে ঘুরবে। এ আনন্দ বুকের ভিতর জমা রেখেছি বছর ধরে। রাস্তায়-রাস্তায় মরিচ বাতি জ্বলছে।ঢাকের শব্দ হচ্ছে। গাঙ্গিনাপাড়ে অনেক ভিড়। এর মাঝে আমি বইটি চুরি করে ফেললাম। কেউ টের পেলো না। আমি জানি কখনোই টের পাবে না।তবুও ভিতর থেকে কিসের ভয় হচ্ছে। মাথায় ঘাম হচ্ছে। কথা বলতে পারছি না। কথা বলার সময় তুতলিয়ে যাচ্ছি। মা দূর্গা দেখছে। আমি কি করছি। একটা দামি বই চুরি করে ফেললাম।কথায় আছে চুরি করা মহা বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা। আমি ধরা পড়িনি। পড়বোই না। এখানে এই দোকানে বেশ কয়েকদিন আসবো না। তবুও ভয় কমছে না।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো। আর বাহিরে থাকা যাবে না। বাসায় চলে গেলাম। হাত মুখ ধুতে গেলাম। হাত দিয়ে মুখে জল দিচ্ছি–দিচ্ছি, দিতেই আছি, আর কল্পনা করছি কিভাবে বইটা আমি সবার সামনে দিয়ে আনলাম। এই বই যে আমার প্রথম চুরি তা নয়। স্কুলে থাকতেও বই চুরি করেছি, কলেজ থাকতেও বই চুরি করেছি। কিন্তু তারপরের দিন চুপি চাপে বইটি বইয়ের জায়গায় রেখে এসেছি। তাহলে কি এই বইটাও আমি দোকানে রেখে দিবো! জানি না, কিছুই জানি না।হাত মুখ ধুতে গিয়ে দু’বালতি জল ঢাললাম শরীরে। শীত লাগছে। হয়তো সর্দি লাগবে। শরীর গরম হয়ে গেছে। বিছানায় শোয়া মাত্র চোখ লেগে গেলো। খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেলাম। নয়টা এখনো বাজেনি। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
[খ]
সকালে উঠে দেখি, শরীর ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, কমর ব্যথা। ব্যথা-সর্দি লেগে গেছে। মাথা প্রচন্ড ব্যথা। কিন্তু আমি অনেক দিন পর ভালো ঘুম ঘুমিয়েছি।চোখ বন্ধ করলাম এবং চোখ খুললাম।
বইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। কমলকুমার মজুমদার উপন্যাসসমগ্রর কথা। ভাবলাম না আজ বিকেলে বইটি চুপিসারে দোকানে রেখে চলে আসবো। আবার ভাবলাম না। পড়ে ফেলি।যতো সময় লাগুক। পড়ে শেষ করি। তারপর ভাবা যাবে।
দেখি কঙ্কা কল দিয়েছে অনেকগুলো। কঙ্কা কখনো আমাকে কল দেয় না। যা কথা হয় মেসেজে কথা হয়। হুট করে কঙ্কা কেন আমাকে কল দিবে। আমি কি কল দিবো? বলবো কেন কল দিলো? ভাবতে ভাবতে দেখি কঙ্কা আবার কল দিলো। কল ধরলাম–
হ্যালো
হুম, কোথায় আপনি!
বাসায়, কেন?
আপনার নামে পোস্টার বের হয়েছে। যে এই ছেলের পরিচয় দিতে পারবে, তাকে প্রাপ্য পুরষ্কার দেওয়া হবে।
মানে, কে বলেছে, কি বলছেন এইসব। কে করেছে।
বলতে বলতে ফোন কেটে গেলো। কল দিলাম ধরছে না। ভয়ে আরো বেড়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লাম। বের হয়ে অনেক দূর চলে যেতেই মনে হলো বইটা নিয়ে আসা দরকার ছিলো। ফিরত দিয়ে দিবো। বলবো যে লোভ সামলাতে পারিনি। বইটি আমি চুরি করেছিলাম, নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরত দিতে এসেছি। ক্ষমা করে দিবেন।
আমিও নিজের চোখের আমার পোস্টার দেখলাম। গতকালের দোকানে বই যখন ব্যাগ ঢুকাচ্ছি ঠিক সেই সময়ের তোলা ছবি। তারমানে আমি কি ধরা পড়ে গেলাম। আমি বই চুরি করেছি, তারা দেখেছে। প্রমাণ আছে। এখন আমি কি করবো?
আজ সপ্তমীর। মা দূর্গা আমাকে বাঁচাও। এমন কাজ আমি করবো না। এবারের মতো আমাকে বাঁচাও।
কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলাম তিনজন ছেলে আমাকে ফলো করছে। এর মাঝে বই দোকানের একজন ছেলে। আরেকটু সামনে দেখি আমার মা বাবা ভাই ঠাম্মা সবাই পূজোর মন্ডপে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আমার মস্তিস্কে কিছু হয়েছে। তারা দিব্যি ঘুমুচ্ছেন এই সকালে। হুট করে শুনি সপ্তমীর অঞ্জলি দেওয়া হবে, মা আমাকে ডাকছে আয় অঞ্জলি দিবি। বললাম আসছি। যেতে-যেতে পিছনে তাকিয়ে দেখি ছেলে তিনজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অঞ্জলির শেষে আমি তিনজন ছেলের কাছে যাই। বলি আমার মা বাবা বাসায় যাক আমি আপনাদের সব বলছি। তারা কথা বলে না। মা বাবা বাসায় চলে গেলেন। আমি তাদের কাছে সব বললাম। বললাম আমি আজ বিকালেই বইটা ফিরত দিতে যাবো, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখিই এই অবস্থা। ভাবলাম আমার কথা তারা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তারা বিশ্বাস করেছে। বললো বইটা ফিরত দিয়ে দেন।তাহলেই হবে। আর এমন করবেন না।
আমি বললাম কখনোও এমন করবো না। তারা বললো আমরা এখানে আছি আধা ঘন্টার ভিতর বইটি এনে আমাদের হাতে দিবেন। আমি বলছি দশ মিনিটের ভিতর দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেলাম। কিন্তু আমি বইয়ের নাম ভুলে গেছি।কিছুতেই মনে করতে পারছি না, আমি কি বই চুরি করেছিলাম। বইটা কোথায়? তারা অপেক্ষা করছে, আধা ঘন্টা পেরিয়ে এক ঘন্টার উপরে চলে গেলো আমি পাগলের মতো বই খুঁজছি, হয়তো আমার সামনেই আছে আমি দেখতে পারছি না। মনে করতে পারছি না। ভয় হচ্ছে, মাথা ব্যথা প্রচন্ড হচ্ছে। তাকাতে পারছি না। চিৎকার দিতে মন চাচ্ছে, চিৎকার দিতে পারছি না। ঘুম ধরে যাচ্ছে, আবার আমি গভীর অতলে ঘুমিয়ে গেলাম।
[গ]
ঘুম ভাঙলো। দেখি সকাল। মাথা ভারি হয়ে আছে। মাঝে মাঝে চিলিক মারছে। কিছু সময় বিছানায় বসে রইলাম। বুঝে উঠতে পারছি না, কি হচ্ছে আমার সাথে। আমি কি এতোক্ষণ পর্যন্ত স্বপ্ন দেখলাম? নাকি দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? বইয়ের নাম মনে পড়লো। নাম হলো– কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র।কৌশিক দার ফেসবুক পোস্টে বার-বার দেখেছিলাম। মাথায় রেখেছিলাম জমিয়ে কিনবো। টাকা জমাচ্ছি। তাহলে কি এই বইটার জন্য এতো কিছু আমার ভিতরে। আর কঙ্কা কে? কঙ্কা নামে তো আমি কাউকে চিনি না! জানি না।কে এই কঙ্কা!
এটা স্বপ্ন ছিলো এটা বাস্তব। আমি বই চুরি করিনি। ময়মনসিংহে বইটি নেই ভালো করে জানি। কিন্তু আগামীকাল সপ্তমী।
সন্ধ্যার কথা, গাঙ্গিনাপাড়ে গেলাম হাঁটতে। দেখি মরিচ বাতি জ্বলছে। ঢাক বাজছে। কেনো জানি মনে হলো যাই সংকলন অথবা আজাদ অঙ্গনে ডুব দিয়ে আসি। কমলকুমার মজুমদার উপন্যাসসমগ্র অথবা গল্পসমগ্র আসছে কি না, দেখে আসি। ভিতরে গেলাম। দেখলাম বইটা আসছে। খুব খুশি হয়ে গেলাম। ভিতরে ধপধপ করছে। বইটা নিলাম। দাম একহাজার টাকা। আটশত পঞ্চাশ দিয়ে কেনা যাবে। দেখছি সবাই ব্যস্ত। চাইলে চুপিসারে ব্যাগে বইটা ডু
ঢুকিয়ে ফেলতে পারি কেউ দেখবে না। মা দূর্গা আমাকে ক্ষমা করো। বুঝে উঠতে পারছি না কি করবো, বইটা কি রেখে দিবো নাকি চুরি করে ফেলবো? চুরি করা যাবে না। লোভ সামলাতে হবে, লোভ খুব খারাপ। নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।বুঝতে উঠতে পারছি না, সবাই ব্যস্ত। আমার দিকে এখন কেউ নেই।
…………….
ময়মনসিংহ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪