রেজা তানভীর
১৬ ই মার্চ, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আলী আহসান জোনায়েদ জুলাইকে সামনে রেখে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের ঘোষণা দেন। জোনায়েদ এর আগে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। পরে যখন জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করে তখন সেখানে দেখা যায়নি জোনায়েদকে।
আলী আহসান জোনায়েদের সাথে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব পদ থেকে সরে আসেন রাফে সালমান রিফাতও।
দুজনের পরিচয় তারা ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি।
আলী আহসান জোনায়েদ ও রাফে সালমান রিফাত জাতীয় নাগরিক পার্টিতে কেন যোগ দেয়নি সেটা নিয়ে তরুণ রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কাঁনাঘুষা চলছে। দুজনের ঘনিষ্ঠজনরা মনে করছেন, তারা অতীতে ছাত্রশিবির করার কারণে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে সঠিক স্পেস পাচ্ছিলেন না। সে কারণে তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।’ জাতীয় নাগরিক কমিটির সহমুখপাত্র মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ ইসলামী ছাত্রশিবির করার কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন দাবি করে সহমুখপাত্রের পদ ছাড়েন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির ভাবাদর্শ বহুত্ববাদ এবং মতাদর্শ মধ্যপন্থা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডান বাম পক্ষ দেখা গেলেও মধ্যপন্থা কেমন হতে পারে সেটা অতীতে দেখা যায়নি। তবে, আখতার হোসেন মনে করেন, দলটি হবে ধর্মীয় সম্প্রীতির।
আমরা দেখেছি, জাতীয় নাগরিক কমিটির ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যেদিন কেন্দ্রীয় কমিটি হয় সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ মারামারি হয়। মারামারির কারণ হিসেবে জানা গেছে, সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢাবি ছাত্রদেরই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরের এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কমিটিতে রাখা হয়নি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিতেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাখা হয়নি৷ কিন্তু, জুলাই আন্দোলনে প্রাইভেট শিক্ষার্থীদের অবদান ঢাবি থেকে অবশ্যই বেশি। তাদের শহীদের সংখ্যাও অনেক। জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কমিটিতে তাদের উপেক্ষা করাটা ঠিক হয়নি। নতুন দল যদি ঢাবি কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের বাইরে যেতে না পারে তাহলে নতুন বন্দোবস্তের মানে কী হতে পারে?
তবে, যাই হোক, আলী আহসান জোনায়েদ জাতীয় নাগরিক পার্টিতে না থাকার কারণ হিসেবে গণমাধ্যমকে জানান, পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের গঠনতান্ত্রিক নিয়মনীতি এবং আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম, যেটাতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আর রাফে সালমান রিফাত জানান, নাগরিক পার্টির সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নেই, শুধু আমরা সেখানে যাই না।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া এই দুই নেতা গণমাধ্যমকে আরো বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই তাদের নতুন প্ল্যাটফর্ম কাজ করতে চায় ‘পলিটিকাল প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে।
গত ১৬ ই মার্চ আলী আহসান জোনায়েদ তাই ফেসবুকে পোস্ট করেন,
“আসসালামু আলাইকুম।
৩৬শে জুলাই ফতহে গণভবনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হলেও, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বহু মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
পিলখানা, শাপলা ও জুলাই গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধের বিচার, ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ, দুর্নীতিমুক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ, ধর্মবিদ্বেষ ও ইসলামোফোবিয়ামুক্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গঠন, ফ্যাসিবাদী কাঠামোর সম্পূর্ণ বিলোপ এবং আধিপত্যবাদের বিপক্ষে কার্যকর অবস্থান—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গৌণ হয়ে পড়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত যোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়ার কাজ এখনও অসম্পূর্ণ রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা গণঅভ্যুত্থানের দাবিগুলো প্রকৃতই বাস্তবায়ন করতে চাই।
৩৬শে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, তা পূর্ণতা দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সমাজের সর্বস্তরে যোগ্য ও নৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মূলোৎপাটন এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে এই বিপ্লব পরিপূর্ণতা পাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
আমরা বিশ্বাস করি, নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশ পুনর্গঠন সম্ভব।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠনের এই উদ্যোগে আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই। আসুন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গঠনের এই সংগ্রামে শামিল হই।”
আলী আহসান জোনায়েদ তাঁর পোস্টের নীচে কমেন্ট বক্সে একটি ফরমও ছেড়ে দেন। যারা তাঁর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আগ্রহী তাদের ফরমটি পূ্রণ করার জন্য তিনি আহবান জানান। জানা গেছে, ফরম ছাড়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে প্রায় দশ হাজার মানুষ সেটি পূরণ করেছে।
প্ল্যাটফর্মটির ফরমে আছে সংগঠক, দাতা, সমর্থক, বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা ও অনলাইন এক্টিভিজমের মতো কাজে শামিল হওয়ার সুযোগ৷ এখানে দুটি সেকশন খুবই ইন্টারেস্টিং। যেমন – বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা ও অনলাইন এক্টিভিজম। যেটা জাতীয় নাগরিক পার্টিতে দেখা যায়নি। নতুন প্ল্যাটফর্মটিতে কেউ সরাসরি মাঠে কাজ না করেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও অনলাইন এক্টিভিজমে কাজ করার মত প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাবে। এটা একটা ইতিবাচক ব্যাপার।
জানা গেছে, আলী আহসান জোনায়েদ জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগদানের আগে যেখানে ৩০-৪০ টার মত কমিটি ছিলো, সেখানে তিনি যোগদানের পর প্রায় ৪০০ জায়গায় কমিটি দেয়া সম্ভব হয়েছে।
তবে, জাতীয় নাগরিক পার্টিতে খুবই পরিচিত অন্তত সাত আটজন ফিগার আছে। এটা তাদেরকে জোনায়েদদের থেকে অনেকটা এগিয়ে রাখবে। তবে, জোনায়েদদের সেরকম খুবই পরিচিত মুখ না থাকলেও তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা বেশ প্রখর বলে অনেকে মনে করেন।
আলী আহসান জোনায়েদের নতুন প্ল্যাটফর্ম এপ্রিলে আত্মপ্রকাশ করবে। ডানপন্থী চিন্তার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটি পরিচিতি পাচ্ছে। যার মূল চেতনা থাকবে জুলাই। সকলের প্রত্যাশা নতুন এই প্ল্যাটফর্ম গণমানুষের আকাঙ্খা ধারণ করে এগিয়ে যাবে। কারণ, জুলাই যত প্রাসঙ্গিক থাকবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি তত অপ্রাসঙ্গিক হবে।