spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েপাথরের মতো চোখ

লিখেছেন : শফিউল্লাহ নান্নু

পাথরের মতো চোখ

শফিউল্লাহ নান্নু

কাঠঠোকরা পাখিদের মতো গোটা আকাশটাকে ঠুকরে রোজ গিলতে গিলতে ঝরে পড়া মেঘ-অশ্রুতে কিংবা হৃদয়ে দুঃখের স্তুপে বিবর্ণ হয়ে যায় জীবন। সরল চোখের সহজ বিশ্বাসের কি পরিণতি কাউকে বিশ্বাস করে ঠকলেই বোঝা যায়! চোখের দেখা যখন ভুল হয়, মিথ্যা হয়। চোখ থাকতেও মনে হয় চোখ যেন রেটিনাহীন। তখন কবি ব্যথিত বুকে জীবনের হিসাব মিলাতে গিয়ে প্রিয়তমাকে নির্মমতার প্রশ্ন ছুঁড়ে লিখেছেন—

‘জন্মান্ধ দুটি চোখ কিভাবে মাপবে আকাশের পরিধি;

আমি শুধু সে প্রশ্নের উত্তর চেয়েছি জয়িতার কাছে।’

বলছিলাম কবি শাহেদ সাদ উল্লাহ’র কথা।

একজন আধুনিক চিন্তাশীল মানুষের কথা। যাঁর কবিতায় আধুনিক জীবন যাপন, আধুনিক দুঃখ-সুখে কিংবা শোকে বেঁচে থাকার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। লক্ষ্য করা যায় কিভাবে তিনি পাথরের মতো চোখে এই পৃথিবী দেখেন। কতোটা যন্ত্রণায় পাথর চোখে বেঁচে আছেন। 

পাথরের মতো চোখ’ কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থটি পড়ে মনে  হয় কবির রক্ত-মাংসের চোখে এখন রক্ত মাংস নেই, রেটিনা নেই; আছে কেবল অবহেলা, বিশ্বাসের অপরাধে দণ্ডিত জীবন। ‘পাথরের মতো কিছু চোখ’ কবিতাটি পড়লে বোঝা যায় কবিতা কবির জীবনকে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দাঁড় করিয়ে দেয়। আর মনে হয় এই সংজ্ঞার রহস্য কেবল কবির একান্ত ব্যক্তিগত। কবি তার কবিতায় চাষ করেছে জীবন বেদনার পুষ্পকানন। এই পুষ্পকাননে কবি যাপিত করছে সময় ও জীবন। উক্ত কাব্যগ্রন্থ পড়ে আমার তাই মনে হলো।

শাহেদ সাদ উল্লাহ-র জন্ম ১৯৭২ সালের ৬ই নভেম্বর, কক্সবাজার শহরে। ২০০২ সাল থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শাহেদ সাদ উল্লাহ কবি হলেও একাধারে শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, চিত্রশিল্পী ও সঙ্গীতশিল্পী। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪ টি। জাতীয় পত্র-পত্রিকা ছাড়াও তার কবিতা প্রকাশিত হয় ইউপিএল নির্বাচিত ‘বাংলাদেশের কবিতা ২০০০’-এ। শাহেদ সাদ উল্লাহ যখন মাত্র লিখতে শুরু করেন, তখনই তার কবিতা প্রকাশিত হয় কবি কায়সুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক শৈলীর বিশেষ সংখ্যায়। নিউ ইয়র্কের স্টিফন হিরু প্রোডাকশন থেকে প্রকাশিত তার একমাত্র গানের অ্যালবাম ‘মেঘ ডট ক্লাউডস’। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

শাহেদ সাদ উল্লাহ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ব্যাংক JP Morgan Chase- এ কর্মরত।’

পাথরের মতো চোখ’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছি। প্রতিটি কবিতা আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে। 

কবিতায় প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, বেদনা, পাওয়া না-পাওয়া কিংবা জীবন বা সমাজ; বিচিত্র ভাবে ফুটে ওঠেছে শব্দের রঙে। কবি তার জীবনের একান্ত সময়, বেঁচে থাকার নিজস্বতা, বাস্তবতা, খুন; নিখুঁত ভাবে এঁকেছেন শব্দেরর তুলিতে। তাই ‘শিরোনামহীন’ মনে কবি লিখেছেন—

‘ডান চোখে কোনো অসুখ নেই। 

সে চোখ কিছুই দেখে না বলে, 

আমি বা-চোখে কাঁদি।

প্রতিটা নক্ষত্রের ভেতর আমার চোখ 

ঘুমিয়ে থাকে। জেগে থাকে যে চোখটি 

সে চোখ কোনো দিনই কাঁদতে পারেনি।’

এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা যেন জীবনের কথা বলে, সময়, বাস্তবতা কথা বলে। বেঁচে থাকার গোপন রহস্য রঙিন ভাবনার প্রচ্ছদে তুলে দেয় উপমা। আমি ‘পাথরের মতো চোখ’ কাব্যগ্রন্থের একজন পাঠক হিসেবে নিসন্দেহে বলতে পারি গ্রন্থটি অবশ্যই পাঠক প্রিয় হবে। এবং কোনো পাঠক মুগ্ধ না হয়ে পারবে না বলে আমার বিশ্বাস।

আমি লেখের কবিতাগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে না পারলেও উক্ত গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করার সময় যে কবিতাগুলো আমার মনকে নাড়া দিছে বা যে কবিতাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়েছে তা থেকে বেশ কয়েকটি কবিতা এখানে তুলে ধরছি—

০১.

জন্মান্ধ চোখ 

*

কাঠঠোকরা পাখিদের মতো 

আমি গোটা আকাশটাকে ঠুকরে খাচ্ছি। 

মেঘ ঝরে পড়ছে,

বৃষ্টি ঝরে পড়ছে,

কাদা মাটিতে এসব টুকরো জমছে। 

স্তুপ হতে-হতে ঢেকে যাচ্ছে

রাশ-পড়া চোখের গ্লাস।

আমি দেখতে পাব না হয়ত।

কিন্তু বিম্বিত রোদের ছায়া 

গ্লুকোমার মতো সাদা হয়ে উঠবে। 

সেখানে ডাক্তারের ছুরি, চাকু 

ব্যবচ্ছেদ করতে-করতে দেখতে পাবে 

আমার রেটিনা বলতে কিছু নেই! 

জন্মান্ধ দুটি চোখ কিভাবে মাপবে আকাশের পরিধি;

আমি শুধু সে প্রশ্নের উত্তর চেয়েছি জয়িতার কাছে।

০২.

পাথরের মতো কিছু চোখ

*

পাথরের মতো কিছু চোখ

নোঙরবিহীন।

তাদের দৃষ্টিহীনতা সমুদ্রের ওপারে গিয়ে থামে।

কিছু-কিছু মানুষ

অবশ্যম্ভাবী রাতের ভেতরে তবুও 

চোখের অন্ধকার নিয়ে ডুবুরির মতো 

মৃতদেহ খুঁজে বেড়ায়।

পাথরের মতো কিছু চোখ 

তাই রাত হলেও জেগে থাকে। 

পলক পড়ে না, পরিত্যক্ত কবরের মতো 

নিজের ছায়ায় ভিজে। 

কিছু শেকড় গজিয়ে উঠতে-উঠতে 

তারপর চোখের ভেতরে ঢুকে যায়।

হাজার বছর পর তাকে আমরা বলেছি পূরাকীর্তি। 

ব্রাশ দিয়ে চোখের ধুলাবালি সরাতে সরাতে

সেই চোখের অন্ধকার সরাতে চেয়েছি।

আমিও চোখের ভেতরে পাথরের মতো চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকি

একটি শামুকের দিকে। আমার চোখে লতার মতো পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে 

হেঁটে যায় শামুকের পা।

০৩.

প্রস্থান

*

যেখানেই যাই একজন সিগারেট-ধরা লোক দাঁড়িয়ে থাকে। যেখানেই যাই তবুও সেই মানুষ।

সে কি আমাকে চেনে? 

নাকি তার আরও একটি সিগারেট দরকার? 

আমি তাকে একটি কফি অফার করেছিলাম। 

কিন্তু লোকটি তার পকেট থেকে একটি ছবি বের করে আমাকে দিয়ে চলে গিয়েছিল।

পঁচিশ বছর ধরে তাকে খুঁজছি।

ছবির পেছনে যে ঠিকানাটি লেখা ছিল, 

সেখানে গিয়ে দেখি;

শুধু একটি জোনাকি জ্বলছিল।

০৪.

একটি লাশ

*

একটি সাঁকোতে তিন জন মানুষ সূর্যকে পিঠ দিয়ে বসে আছে। 

তাদের পরিচয় বলতে একটাই, ওরা এক চোখে দেখে না।

তবুও তারা পুরো আকাশকে দেখতে পেল 

নদীর পানিতে চোখ রেখে। 

দিন চলে যায়, মশা ও মাছি ঢুকে পড়ে ঝোপঝাড়ে। লোকগুলো সাঁকোতে হেলান দিয়ে গুনতে থাকে 

আর কতগুলো ঢেউ ফেলে গেলে তাঁর দেখা যাবে। অন্ধলোকগুলোর একজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল নদীতে 

তার গভীরতা মাপার জন্য। 

লোকটি অপেক্ষায় রইল কখন দীর্ঘশ্বাসটি 

শব্দ করে উঠবে নদীর তলদেশে পড়ে।

আর একটি দিন চলে গেল; 

এবার একটি উড়োজাহাজ চলে গেল তার মাথার ওপর দিয়ে। 

এভাবে একের পর এক চলে যেতে লাগল সব, 

সাঁকোতে বসে-থাকা অন্ধ লোক দুটিও। 

কিন্তু কোনো শব্দই সে শুনতে পেল না মৃত্যুর আগমুহূর্তেও।শুধু সাঁকোতে আটকে থাকা অপেক্ষার চোখ দেখতে পেয়েছিল 

একটি লাশ ভাসতে ভাসতে চলে গেছে ওপারে।

০৫

ঝিনুক

ঝিনুকে কেউ আমার নাম লিখে রাখেনি। 

কাঁকড়ারা হেঁটে যায়; কিছু দাগ রেখে যায় মাটিতে। 

সে দাগে সাবধানে আঙুল বুলিয়ে দিই। 

তারপর বৃষ্টি হলে সেই সব দাগ ধুয়ে যায়। 

বালির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে ভাবি, 

আহা! আমার যদি ছোঁয়াছে রোগ না হতো- 

কেউ কি আমার নাম লিখে রাখত ঝিনুকে?

কুয়োতে ঝিঁঝি-ডাকা শব্দের মতো 

একটানা ডাকতে থাকে রাত! 

সব অন্ধকারে কেবল শুনতে থাকি সমুদ্রের গান ।

০৬.

মিনাকে বলিনি যে কথা

*

সাইনাসের ব্যথার মতো কপালের ঠিক মাঝখানে ঝিম ধরে আছে। 

মিনা, আমার প্রেমিকা, তার শরীরের বেদনার মতো আমারও বেদনা 

যেন আঠার মতো লেগে থাকে আমি কোনোভাবেই 

দাঁড়িয়ে নিতে পারি না।

আমরা দুজন দুই জায়গায় থাকি। 

মিনা তবু আসে, আমাকে দেখে যায়।

মিনা জানে, আমার অনেক কষ্ট। 

এ বাড়িতেই আমাদের প্রথম সঙ্গমের স্মৃতি। 

সেই সুখ আমাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। 

মিনাকে বলিনি সে কথা। হয়ত লজ্জায় লাল হয়ে যাবে বদমাশ, রাতখেকো মানুষের মতো ভেবেছি 

বেরিয়ে যাব। মিনা জানবে না, শুধু বাড়িটি।

মিনা তবু আসে,

একটি জল-ভর্তি জার রেখে যায়। 

দুটো মাছ এখানে; একটির ভীষণ অসুস্থ। 

মিনার বেদনা মাছগুলো ঠুকরে ঠুকরে খায়।

০৭.

জোনাকি

*

নৈঃশব্দ্যের ভেতর একটি আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু গভীরতর বেদনায় সে আলো নিভে গিয়েছিল।

সহস্রাব্দ ধরে কোনো আলো নেই তাই। ভ্রুর নিচে কালো দাগ; 

প্লাবনে ডুবে গেছে হ্রদ, গ্রামান্তর। 

পাহাড়ের শঙ্খ চূড়া থেকে কেবল গড়িয়ে পড়েছিল পাখিদের ভাঙা ডানা ।

অন্তরিক্ষে রাতগুলো আজও কাঁদে। 

চোখের ছায়ার ভিতর বৃষ্টি নেমে পড়ে। 

জলের মাঝে নীরবতা ম্লান হয়ে ওঠে। 

কারও বুকের আর্তনাদ কাঁপিয়ে দেয় স্ফীত মহাকাশ। 

আমি পৃথিবীকে নদী বানিয়ে দিই; 

সেখানে কুয়াশায় আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

তবুও অন্ধকারে শ্রান্তির বইয়ের পাতায়

জোনাকি এসে বসে—প্রলম্বিত ডানায়।

০৮.

চুম্বক

একটি চুম্বকে আমার সব ইচ্ছেগুলো আটকে আছে। 

আমি মানুষ হলে একটি-একটি ঝরে পড়ত। 

আমি হয়ত অন্য কিছু পারদ, প্লাটিনাম অথবা 

শিশিরের কুয়াশাময় দুচোখ ।

আমার একপাশে নদী বয়ে যাচ্ছিল তার চোখকে ভিজিয়ে। সেই চোখে একটি সূর্য ডুবে গিয়ে রাত নেমে আসছিল।

হায়, আমি যদি মানুষ হতাম, 

সন্ধ্যার সাথে দেখা হতো!

আমি হয়ত অন্য কিছু পারদ অথবা প্লাটিনাম, শিশিরের কুয়াশাময় চোখ।

আমার চার পাশে অজস্র মানুষ; 

শিশুর কান্নার মতো ঢেউ, 

জোতিষ্কের মতো আলোকবর্ষ দূরে 

নিস্তব্ধতা একটি রেখা একে-একে ঘুমিয়ে পড়ছে। 

আমিও ঘুমিয়ে পড়ি।

টের পাই চুম্বকে আটকে আছে আমার হাতও।

০৯.

নাটাই

*

লাল রঙের ঘুড়ি, 

নাটাইয়ের সুতো ছেড়ে চলে গেছে।

আমার দুঃখ নেই।

দুঃখটা আমার নাটাইকে নিয়ে। 

আর কিছু সুতো গেলে সে একা হবে।

সবাই ঘুড়ির কথা বলে,

কেউ বলে না, 

ও নাটাই তোর বুকে আটকে রেখেছিলি

সুতো বহু যত্নে। মাঞ্জার ধারে কেটে গেছে তোর বুক।

অনেকেই ভাবে নাটাই আর্তনাদ করে।

আর্তনাদ নয়, অমীমাংসিত থেকে যায়।

তার হারানোর গল্প।

একদিন বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি, 

নাটাইয়ের চাকা খুলে গেছে;

টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘোড়ার আস্তাবল।

সবশেষে আবার বলতে চাই ‘পাথরের মতো চোখ’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠক প্রিয় হোক। পাঠ করে সমৃদ্ধ হোক সকল পাঠকের মন এবং জীবন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ