আবু রাইহান
‘যাবার বেলায় সালাম লহ হে পাক রমজান
তব বিদায় ব্যথায় কাঁদিছে নিখিল মুসলিম জাহান।
…ওগো রমজান, তোমারি তরে মুসলিম যত
রাখিয়া রোজা ছিল জাগিয়া চাহি’ তব পথ,
আনিয়াছিলে দুনিয়াতে তুমি পবিত্র কোরআন।
পরহেজগারের তুমি যে প্রিয় প্রাণের সাথী,
মসজিদে প্রাণের তুমি যে জ্বালাও দীনের বাতি,
উড়িয়ে গেলে যাবার বেলায় নতুন ঈদের চাঁদের নিশান।’
–কাজী নজরুল ইসলাম
ইফতার হলো রমজান মাসে মুসলিমদের দ্বারা পালিত একটি ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় আচার।এটি সূর্যাস্তের পরে রোজা ভাঙার জন্য একটি খাবার।ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের জীবনে রমজান মাসে তিরিশ দিনের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হলো রোজা। সারাদিনের পানাহার থেকে বিরত থাকার পর পশ্চিম আকাশে সূর্য যখন অস্তমিত হয়,মসজিদ থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আজান, তখন আসে রোজাদারের জন্যে কাঙ্খিত ইফতার তথা রোজা ভঙ্গ করে পানাহারের সময়। মুসলিম জীবনে ইফতার হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক অনুষঙ্গ।রমজানে আত্মশুদ্ধি, ধর্মভীরুতায় মুমিন বান্দা, জেগে ওঠে আল্লাহর ভালোবাসায়। রমজানে মানুষের মধ্যে সামাজিকতা বেড়ে যায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রমজানকে উপস্থাপন করেছেন আত্মজাগরণের অনুরণনে-‘মাহে রমজান এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’,/নামিবে তাহার রহমত এই ধূলির ধরার পর।/এই উপবাসী আত্মা, এই যে উপবাসী জনগণ,/চিরকাল রোজা রাখিবে না আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ।’
রমজান এলেই মুসলমানদের জীবনধারায় যোগ হয় শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা। পৃথিবীর সকল মুসলিম একই নিয়ম মেনে রোজা পালন করে। ধনী-গরিব একই নিয়ম রীতিতে সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত ক্ষুধা-পিপাসার কষ্ট অনুভব করে। রমজানে প্রতিদিন বাঙালি মুসলমানরা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রচলন অনুযায়ী ইফতারে নানা মুখরোচক খাবার তৈরি করে। সাধারণত তারা শরবত,ছোলা-মুড়ি, পিয়াজি, বেগুনি, আলুর চপ, হালিম, দই-চিড়া, খেজুর, জিলাপি ও মৌসুমি নানা ফল দিয়ে ইফতার করে। ইফতারের দশ-পনের মিনিট আগে ইফতার সামগ্রী সামনে নিয়ে পরিবারের সবাই এক সাথে বসে।এতে মুসলিমদের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
এখন শহর-গ্রাম সর্বত্রই পাড়া বা মহল্লাবাসী প্রতিদিন মসজিদে ইফতারের আয়োজন করা হয়। এ ইফতারে মসজিদের মুসল্লি ও থেকে সব শ্রেণীর মুসলিম রোজাদার অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া পুরো রমজান মাস জুড়েই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পক্ষ থেকে ইফতার মজলিশের আয়োজন করা হয়। এ ধরনের আয়োজন যেমন সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে, তেমনি সাম্য ও প্রীতির বন্ধনেও আবদ্ধ করে।
বাঙালি মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি তাওহিদ, রিসালাতের চেতনায় উজ্জীবিত এবং ইহ-পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত। এতে ইফতার এক ধর্মীয় আভিজাত্যপূর্ণ পবিত্র খাবার।বাঙালির ইফতার তালিকা দৈর্ঘ্য-আফ্রো-অ্যারাবিয়ান ধারা, মোগল রসনাবিলাস, ভারতীয় রন্ধনশৈলী—সব কিছুর সমন্বয়ে বাঙালির ইফতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।বাঙালির ইফতারে খেজুরের বিকল্প নেই। কেননা, প্রিয় নবী সা.-এর প্রিয় ফল খেজুর।প্রিয় নবী সা. খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তিনি পবিত্র রমজানে সবাইকে খেজুর ও জল দিয়ে ইফতার করতে বলতেন। ইফতার করাকে বলা হয় ‘রোজা খোলা’, অর্থাৎ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোজা ভাঙা।ছোলামুড়ি, পিঁয়াজি বাঙালির ইফতার ঐতিহ্য। ছোলামুড়ি এখনও বাঙালি মুসলমানের ইফতারির মূল উপকরণ।কী শহর কী গ্রাম, ধনী অথবা গরিব সবার ইফতার তালিকায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ছোলামুড়ি, পিঁয়াজি।সেই সঙ্গে থাকে ভেজানো কাঁচা ছোলা এবং আদার কুচি। এটি সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকা রোজাদারদের পেটে জমে থাকা গ্যাস ও পিত্ত নাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।ছোলামুড়ি কীভাবে বাঙালি মুসলমানের ইফতারির মূল উপকরণ হয়ে উঠল, সে ইতিহাস বেশ কৌতূহলোদ্দীপক বটে।
রমজান মাসে কলকাতার চিৎপুরের নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন জাকারিয়া স্ট্রিট, কলুটোলা,মধ্য কলকাতার নিউমার্কেট থেকে শুরু করে পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার, মেটিয়াবুরুজের বিভিন্ন রাস্তায় সাজানো থাকে ইফতারির নানা খাবারের পসরায়। দুপুর থেকে শুরু হয় কেনাবেচা। ইফতারের সময় যত ঘনিয়ে আসে, বিক্রেতাদের ব্যস্ততা ততই বাড়ে। কলকাতার নামিদামি রেস্তোরাঁর সঙ্গে ইফতারির খাদ্যপণ্যের বিষয়ে রীতিমত পাল্লাদেয় কয়েকশ মৌসুমি ব্যবসায়ী। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সমাজের সবস্তরের মানুষের চাহিদা অনুয়ায়ী থাকে ইফতারের নানা আয়োজন।হালিম, লাচ্ছা সেমাই, কাবাব, ফিরনি, ফালুদা। নানা ধরনের ফল, খেঁজুর, কাজু, কিসমিস, ড্রাই ফ্রুট, ছোলা,পকোড়া, স্যালাডের আয়োজন।অল্প দামেই পাওয়া যায়, জিলাপি, সিঙ্গাড়া,টিকিয়া, শিক কাবাব,চিকেন-মটন কষা, পেঁয়াজি, বেগুনি, শাহি বাখরখানি, বিশেষভাবে তৈরি নান-রুটি, হালিম কিংবা সুস্বাদু আপেল-ন্যাসপাতি-আনারস-কলা-আম-কাঁঠাল-জাম-আঙুর-পেঁপে-সপেদা-তরমুজ-মোসাম্মি সহ নানা ফল,আর তা দিয়ে তৈরি জুস।
সপ্তম-অষ্টম শতক থেকেই বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের কাজে এ অঞ্চলে আরব দেশ থেকে লোকেরা আসতে শুরু করেন। আর ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে বঙ্গে মুসলমান শাসনের সূত্র ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ধর্মান্তরিত হতে থাকেন। এভাবেই প্রতিবেশীদের জীবনাচারের অনেক রীতিনীতি বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করে। আবার দিল্লিতে পাঠান ও মোগল শাসনের সূত্র ধরে অভিজাত ভারতীয় পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে মুসলমানি ধারা। মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় প্রবল হয়।ষোল শতকে লেখা মুকুন্দরামের কাব্যে আছে, মুসলমানেরা ‘পাঁচ বেরি’ নামাজ পড়েন এবং ‘প্রাণ গেলে’ও রোজা ছাড়েন না। বাংলা সাহিত্যে রোজা, ইফতার—এসব প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়াই দায়। চর্যাপদ থেকে প্রাচীন বাংলার সমাজজীবন খুঁজে বের করা যায়, কিন্তু বাংলা সাহিত্য থেকে ইফতারির খাদ্য-উপাদানের বিবর্তন বোঝা যায় না। এর জন্য আশ্রয় নিতে হয় ইতিহাসের।
মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা বাংলা ভ্রমণকালে সিলেটের সুফি-দরবেশ হজরত শাহজালাল রাহ.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইবন বতুতার ভ্রমণকাহিনি ‘আর রিহলা’তে আছে, হজরত শাহজালাল রাহ. ইফতারে গরুর দুধ পান করতেন। সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্ম আরব দেশ থেকে বিস্তৃত হতে থাকে অন্যান্য দেশে। ওই সময়ে হজরত মুহাম্মদ সা. ইফতারিতে হিসেবে খেজুর ও জল খেতেন। তাই পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা নবীর আদৰ্শ মেনে ইফতারিতে প্রথম রোজা ভাঙেন খেজুর ও জল দিয়ে। বাংলার মুসলমানেরাও ইফতারে খেজুর রাখেন। তবে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আন্ত:দেশীয় সম্পর্কের কারণে ইফতারির উপাদানের মধ্যে অনেক সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। এমনকি স্থানীয় অনেক খাবারও জনপ্রিয় হয়েছে।
মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান ‘বাহারিস্তান-ই-গায়রি’ গ্রন্থে লিখেছেন, সতেরো শতকের শুরুর দিকে তিনি বঙ্গ অঞ্চলে ছিলেন। তখন প্রথম রমজানের দিনে পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। দিল্লির পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বিষণ্ন মনে বন্ধু মির্জা আলম বেগের তাঁবুতে গিয়ে হাজির হন। সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ করেন, এখানকার ইফতার আয়োজন অনেকটা দিল্লির মতো। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, মোগল সেনাদের তাঁবুর জনপ্রিয় পদ ছিল ‘নান তাফখান’—বাদাম দেওয়া একরকম গমের রুটি। এ ছাড়া সুজি দিয়ে তৈরি রুটি শিরমাল, আকবরি নানখাতাই—এসবও ছিল।
১৬৩৯ সালে শাহ সুজা বাংলার সুবাদার হওয়ার পর এখানে খোরাসানি পোলাও পরিচিত লাভ করে। এ ছাড়া মোগলরা মাংস, মসলা, লেবুর রস ও গম দিয়ে তৈরি হালিম জাতীয় একরকম খাবার তৈরি করতেন। তবে কাবাব, হালিম, বিরিয়ানি—এগুলো মূলত পারস্যের খাবার। জিলাপিও পারস্যের খাবার, জনপ্রিয় হয়েছে মোগলদের দ্বারা।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খাঁ চকবাজারকে আধুনিক বাজারে পরিণত করেন। তখন এর নাম ছিল ‘বাদশাহি বাজার’। নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ আছে, রোজার সময়ে মোগলাই খাবার ও রকমারি ইফতারি বিক্রি করা হতো এখানে। বাকরখানি, বোগদাদি রুটি, শবরাতি রুটি, কাকচা, কুলিচা এবং হরেক রকমের নানরুটি পাওয়া যেত তখন। এসব পদের অধিকাংশই এই ২০০ বছরে হারিয়ে গেছে। ছিল ১০-১৫ সের ওজনের মাংসের টুকরা থেকে তৈরি পাসান্দ কাবাব, এখন যা সুতি কাবাব নামে পরিচিত।
বাঙালি রোজার দিনে ইফতারে খরচ করতে কার্পণ্য করে না।ইফতারে এখন বাঙালি মুসলমানদের প্রধান খাদ্য ছোলামুড়ি। এই ছোলা মূলত আফগানদের খাবার, কাবুলিওয়ালাদের হাত ধরেই তা বাঙালি মুসলমানের ইফতারে জায়গা করে নিয়েছে। রমজানের আগে শবে বরাতে যে বুটের ডালের হালুয়া তৈরি করা হয়, তার আসল নাম ‘হাবশি হালুয়া’। এটিও আফগানদের খাবার।বুটছোলা,আলু,বেসন ও শসাকুচি দিয়ে তৈরি ঘুগনিও এখন ইফতারির খাদ্য তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। আর পেঁয়াজি, আলুর চপ—এসব ভাজাপোড়া-জাতীয় খাবার এসেছে উত্তর ভারত থেকে। ওই সব খাবারের ধারায় বাঙালি নিজের কৌশল খাটিয়ে বানিয়েছে বেগুনি। এ ছাড়া চালের তৈরি নানা পদ, যেমন খই, মুড়ি, চিড়া বাঙালির খাদ্যতালিকায় তো বহু যুগ ধরেই আছে। রোজার দিনে একসময়ে চাল ভিজিয়ে রাখা হতো জলে এবং সাধারণ মুসলমানেরা সেই চাল মুখে দিয়ে রোজা খুলতেন। তবে ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজি একসঙ্গে করে খাওয়ার বুদ্ধি হয়তো স্থানীয় এবং সাম্প্রতিক।
লক্ষ করার বিষয় হলো, ইফতার আয়োজনে শাসকদের পছন্দ-অপছন্দ সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছে। একই সঙ্গে আরও লক্ষণীয়, প্রায় ২০০ বছর ইংরেজরা শাসন করলেও পাশ্চাত্য খাবার ইফতারির তালিকায় কখনো আসেনি। এর পেছনে ধর্মীয় কারণই মুখ্য। তবে খাদ্যাভ্যাস, ফসলের প্রাপ্যতা, সংগতি ইত্যাদিও নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
রমজানে ধর্মভীরুতা, ধৈর্য্য, আত্মসংযম, মিথ্যা পরিহার, দোয়া, তাওবার মাধ্যমে সবার জীবনে প্রতিফলিত হয় স্বর্গীয় আবেগ ও পাপাচার বর্জিত আদর্শ আত্মজাগরণের অনুভব। ইফতার পালন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠান। এটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনের পাশাপাশি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানও।যা পরিবার এবং বন্ধুদের একত্রিত করে করার পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনকেও দৃঢ় করে।কিন্তু বাংলায় কিছু বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক এবং বিশিষ্ট মানুষজনের স্মৃতিকথায় রোজা-ইফতারের পরম্পরার কিছুকথা উঠে এলেও, বাংলা সাহিত্যে এখনও পর্যন্ত এ প্রসঙ্গ প্রায় অনুপস্থিত।