spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যঈদের সেকাল, একাল, পরকাল এবং ব্যক্তিগত অনুসঙ্গ

লিখেছেন : আবু জাফর সিকদার

ঈদের সেকাল, একাল, পরকাল এবং ব্যক্তিগত অনুসঙ্গ

 আবু জাফর সিকদার 

[পর্ব এক ] 

প্রমিত নিয়মে ঈদ হয়ে গেছে এখন ইদ। লিখতে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাই! ইদ লিখবো, না ঈদ? তবে এখনও অধিকাংশ সুধীমহলের পাল্লা ‘ঈদ’ এর দিকেই ঝুঁকে আছে সেটা বলা যায়, আমিও আপাতত তাদের দলেই থেকে গেলাম। তবে আবার কোনো নিয়মনীতি চালু না হলে, একদেড় প্রজন্ম পরে ইদ চালু হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভাষার একটি নিজস্ব গতি ও বিবর্তন প্রক্রিয়া আছে, চর্যাপদ থেকে আজকের বাংলা কতো বর্ণ, শব্দ যোজন বিয়োজন ঘটেছে তার সীমা পরিসীমা নির্ধারণ খুবই অসাধ্য ব্যাপার। নদীতে যেমন বাঁধ দিতে চেষ্টা করলে নদী নয়তো শুকিয়ে মরে যাবে অথবা কৃত্রিম বাঁধকে ভেঙ্গে নদী আপন শক্তিতে তলিয়ে নিয়ে যাবে। ভাষাও তেমন একটি স্রোতস্বিনী মাতৃদুগ্ধের মতো শক্তিমান এক মদক। মানব ছানার  মুখে বুলি ফুটতে না ফুটতে ভাষার রূপ লাবণ্য চম্পাকলির মতো সৌরভময়ী ডালপালা ছড়াতে শুরু করে! সংসদ কিংবা বাংলা একাডেমির অভিধান জীবনে চোখে একবার না দর্শন করে বা না পড়েও বঙ্গসন্তানেরা মায়ের মুখনিঃসৃত ধ্বনি রপ্ত করে অজস্র শব্দের গর্বিত উত্তরাধিকারি হয়ে যায়।

মানুষের ঐ স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় মাঝে মাঝে বর্গীরা হানা দেয়, চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয় নিজের ভাষা-সংস্কৃতির যত শব্দনিচয়, যত আচার আচরণ। কেউ কেউ খুব সফলভাবে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে পেরেছে, আবার কেউ কেউ প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাত্তাড়ি গুটাতে বাধ্য হয়েছে। চর্যাপদের উপর  আর্য-সংস্কৃতের আগ্রাসন যেমন থামানো যায়নি, তেমনি পরবর্তীতে প্রায় সহস্রাব্দের মধ্যএশিয় মুসলিম সভ্যতার বাহন আরবি, ফার্সীর ব্যাপক প্রভাব পড়তে থাকে এই বাংলা ভাষার উপর, পরে দুশ বছর ধরে অবাধে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে ইংরেজি ভাষা। পর্তুগিজ বৈমাত্রেয় বোন হলেও তারও তেজ কম আছিলো না! তাদের জের এখনও পুরোদমে চলছেই। মাঝখানে কিছুসময়ের জন্য পাঠানরা এসে উর্দু কে দিয়ে মুখের ভাষা, বর্ণ সবকিছুকেই বদলিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগে গেলো। তারপর বাকিটা তো ইতিহাস! 

ধান ভানতে শিবের গানটা এবার থামানো যাক! আসল কথায় ফেরা যাক। 

দোহাজারী ও লালটিয়ার মাঝখানে অবস্থিত মাইগ্যাপাড়ায় আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলো, নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। বহু বছর তাকে আর দেখি না, বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না! 

তার নানার বাড়ি ছিলো আমাদের পাড়ায়। তার বয়স  আমাদের সমবয়সী কিংবা একটু বেশিই হবে। তার প্ররোচনায়, এক ঈদে আমরা পরিকল্পনা করলাম চট্টগ্রাম শহরেই বেড়াতে যাবো! তখন বয়স আট কি দশ হবে হয়তো। ঈদের সালামি যা পাওয়া গেলো, এক দুটাকা করে বিশ ত্রিশ টাকা তো জন প্রতি হয়-ই। দোয়েল বা হরিণের ছবিযুক্ত একদুটাকার নতুন নোটগুলো কতই না সুন্দর, আকর্ষণীয় ছিলো! বুঝিয়ে শুনিয়ে আমাদের সব সালামির টাকাগুলো সে হাতিয়ে নিলো। আমি, কাশেম, হাবিবুর রহমান সোনা, আবু, আজিজ মামা, নজরুলসহ আরও দুএকজন ছিলো বোধ হয়।জাকারিয়াও আমাদের দলে থাকতো, কিন্তু চাচার কড়া শাসনের ভয়ে রাত্রিযাপনের সফরে সে দলছুট হয়ে গেছে।  দলবেঁধে সাঙ্গু পার হয়ে দিয়াকুল বিল পেরিয়ে শ্মশানঘাট থেকে নৌকায় করে মাইগ্যাপাড়া নেমে কাশেমের এক নানির বাড়িতে গেলাম!আশেপাশে আরও কয়েক আত্মীয় বাড়িতে বেড়ানো শেষে, সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে পৌঁঁছলাম দোহাজারী রেল স্টেশনে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ঈদে শহরে বেড়াতে যাওয়া। আমাদের সবার জন্য রেলের টিকিট কাটা হলো। আমাদের ঈদের খুশি মহা আনন্দে পরিনতি হলো। এ যেন এক স্বপ্ন! প্রথম ট্রেনে চড়া, প্রথম শহরে বেড়াতে যাওয়া। বাড়িঘরে কেউ বলিনি আমরা শহর দেখতে যাবো! বললে যে ঈদের দিনে ঘরেই আমাদের আটকিয়ে রাখবে তা প্রায় শতভাগ নিশ্চিত। তাই সবাই না বলেই এই অভূতপূর্ব এডভেঞ্চারে বের হয়ে পড়েছিলাম!  

যা হোক, কাঙ্ক্ষিত ট্রেনটি আসলো দোহাজারী স্টেশনে। আহারে, হকারদের কী হাঁকডাক ! কুলিদের বেড়ে গেছে কর্মচাঞ্চল্য। মানুষের চেয়ে যেন নানা জাতের মালামাল বেশি তোলা হচ্ছে ট্রেনের বগিতে। সাড়ে এগারটায়, কি সাড়ে বারটায় ট্রেন ছেড়ে গেলো স্টেশন। কাঠের ডাবকা ডাবকা সিটগুলোতে উল্টো দিকে মুখ করে বসে ছিলাম।ও মাগো, গাছপালা ঘরবাড়ি সবকিছু যেন দ্রুত দৌড়াচ্ছে উল্টোদিকে!  দৃশ্যটা দেখতে মনোরম তবে প্রশ্নউদ্দিপক। কিন্তু প্রশ্ন তো কাউকে করতে পারছি না, সংকোচবোধ চেপে বসেছে, তাই আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকলাম। গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে ট্রেনটি সাপের মতো পুরো শরীরটা হেলিয়ে দুলিয়ে চলতে লাগলো, বিস্ময় ও আনন্দের যুগল অনুভুতির ভেতর আমাদের ঈদ আনন্দ ছুটতে লাগলো শহর পানে। টানটান উত্তেজনা নিয়ে ঘরে মাকে না জানিয়ে ঈদের এই বেড়ানোতে কোন ক্লান্তি নেই। আমরা যারা এই যাত্রায় সঙ্গী ছিলাম, বোধ হয়, কেউ নিজের মা বাবাকে বলে আসেনি। বললে নির্ঘাত যাত্রা বন্ধ করে দিতো। ট্রেন যতই শহরের দিকে ছুটছে উত্তেজনা বেড়েই চলছে, কোন ভয় ডর কাজ করছে না। আমাদের যে প্ররোচিত করে শহর দেখাতে নিয়ে চলছে, সে দোহাজারীর ছেলে, ট্রেন সে বহুবার দেখেছে, সেই গল্পও বহুবার আমাদের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে করেছে।আমরা আগ্রহী হয়েছি,ট্রেন দেখবো, ট্রেনে চড়বো শহর দেখবো। সেই সূত্রেই আমরা যারা বাকিরা তার সফরসঙ্গী  হয়েছি সবারই নতুন অভিজ্ঞতা হতে চলছে আজ। 

স্টেশনে স্টেশনে হকার, কুলিদের হাঁকডাক আর যাত্রিদের উঠানামা দেখতে দেখতে, কর্ণফুলী নদীর লাল ব্রিজটায় এক অদ্ভুত আওয়াজ তুলে, আমরা শহরে প্রবেশ করলাম। 

দোহাজারীই হলো রেলের সর্বদক্ষিণের জংশন ও শেষ স্টেশন। প্রায় চার পাঁচ মাইল দূরে সাঙ্গু নদী ও লালটিয়ার পাহাড় সারি ডিঙিয়ে, আমাদের গ্রামেও রেলের হুইসেলের আওয়াজটা স্পষ্ট শোনা যেতো। খুবই অপূর্ব  লাগতো, বিশেষ করে সাত সকালে এই হুইসেল বারবার বাজতেই থাকতো। আমরা মক্তবে পড়তে যেতাম দল বেঁধে এই সময়, ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হতো, এই হুইসেল যেন আমাদের মক্তবে যাওয়ার তাড়া দিতো! এখনও সেই হুইসেল নিয়মিত বাজে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের কর্ণকুহরে এর আওয়াজ পৌঁছায় কিনা জানি না!  

যা হোক, পরিশেষে আমাদের নিয়ে ট্রেনটি কদমতলি রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে থেমে গেল! এটাই শেষ স্টেশন। সব লাল দালান। হুড়মুড় করে সবাই নেমে পড়ছে। আমরা নামতে গিয়ে একটা বিপত্তি ঘটে গেল! যেদিকে পাটাতন/প্লাটফরম আমরা সেদিকে নামতে গেলাম না, ঝুলতে ঝুলতে নেমে গেলাম সারি সারি রেল লাইনের ভেতর! নেমেই ঘা ঘিনঘিন করে উঠলো! পুরো স্টেশন যেন এক উম্মুক্ত পায়খানা ! স্যাঁতসেঁতে, পিচ্ছিল এবং যত্রতত্র মানব বিষ্ঠার ছড়াছড়ি, দুর্গন্ধময় এক পরিবেশ। তার মাঝখানে আমাদের নামিয়ে দেয়া হয়েছে!  নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কোনরকমে পাটাতনে উঠতে গিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে!  পিছলে গিয়ে এক বিশেষ বস্তুতে পা লেপ্টে গেল! ওফ্,  কী অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা! এখনও চোখের উপর ভাসছে!  আজও সেই দৃশ্যটি মনে পড়লে, গা গুলিয়ে ওঠে, বমির উদ্রেক করে। তবে ঈদের আনন্দ বলে কথা! পড়ি মরি করে প্লাটফরমে উঠলাম বটে, পা টা যেন দশমণ পাথরের মতো ভারি হয়ে গেছে! এখানে সেখানে মোছার বারবার চেষ্টা করছি। মোছা হয়ে গেছে বোধ হয়, তবুও অস্বস্তি কাটলো না, আজও যেন সেটা আমার পায়ে লেগে আছে! বোধ হয়, বহু বছর পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজর কাড়ে বিষয়টি। এখন আর রেল স্টেশনে এই দৃশ্যটা  তেমন  দেখতে পাওয়া যায় না। 

আমার সাথি বন্ধুরা আমার সেই লেজেগোবরে অবস্থা দেখে সবাই বেশ হাসাহাসি করলো। সারাদিনের ঈদ বেড়ানির চেয়েও বেশি মজা পেল তারা আমার অসহায়ত্ব দেখে! যা হোক, আমরা প্লাটফর্মে উঠার পর কিছুটা উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরি করলাম কেবল স্টেশনের ভেতরই। চট্টগ্রামের রেলওয়ে স্টেশনটা বেশ পুরানো হলেও দেখতে বেশ সুন্দরই মনে হলো। প্লাটফরম জুড়ে নানা জাতের দোকান পশরা সাজিয়ে বসে বিকিকিনিতে ব্যস্ত। প্রচুর শুটকির দোকানের কথাও মনে পড়ছে। ফলের দোকান, চানাচুর বিক্রেতা, আইসক্রিম এসবের ছড়াছড়ি। কিছু খেয়েছি নাকি মনে নেই।  কিছুক্ষণ পর আমাদের দলনেতা বলল, আমরা পরের ট্রেনে করে আবার ফিরে যাচ্ছি! তাহলে শহর দেখার কী হবে? আসলে আর শহর দেখার কাজ নেই! দিনে দিনেই তো গ্রামে ফিরতে হবে। না হলে, থাকবো কোথায়, খাবোই বা কোথায়? ইত্যাদি নানা যুক্তির কাছে শহর দেখার স্বাদ মিটে গেলো সহসা! তাই ঠিক করা হলো, যে ট্রেনে এসেছি সেই ট্রেনের ফিরতি শিডিউলেই ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গেল! পড়ন্ত বিকেলে ট্রেন আবার ফিরে চলল আপন গন্তব্যে।

[ চলবে….] 

Author

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি
কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা