আমিনুল ইসলাম
ছোটকালে ভাবতাম, যেদিন আমার টাকা হবে কয়েক হাজার,
রোজ বাখরালীর ভবেশ কাকার দোকানে বসে
গাভীর দুধের ঘ্রাণে মউমউ রসগোল্লা খাবো পেট ভরে আর
একখান দালানবাড়ি বানাবো যার গেটের সামনে রং ছড়াবে
জয়েন্দীপুরের গোমস্তাবাড়ির গেটে দেখে আসা ফুলের মতো
পাতাওয়ালা লতালতা ফুলগাছ;
পা থেকে কোমর অবধি জড়িয়ে ধানকাউনের গন্ধ
সেই কিশোর আমি তখন জানতাম না সেই ফুলের নাম;
এখন মনে হয় সেগুলো ছিল রবীন্দ্রনাথের বাগানবিলাস।
সেও চল্লিশ সাল আগের চাওয়া। আজ আমি ছাগলকাণ্ড কিংবা
সাভানা ইকো পার্কের নব্য জমিদার না হলেও যে টাকা আছে,
তা দিয়ে ভবেশ কাকার মিষ্টির দোকানটা কিনে নিতে পারি।
কিন্তু হায়, সেও অনেক বছর হয়, ফারাক্কা বাঁধ চালিত পদ্মা
ছোটোবোন পারুলের ভেল কুত কুত খেলার গলিসহ আমাদের
পৈতৃক ভিটেমাটি গিলে খেয়েছে; ভবেশ কাকা সহজপ্রাণে
সনাতন ধর্মের অনুসারী জেনেও হিন্দুস্তানী ফারাক্কা বাঁধ
কোনো রহম তো নয়ই, একটুখানি অনুগ্রহও করেনি;
তার হুকুম মোতাবেক অনুগত পদ্মা এক লকমায় ভবেশ কাকার
দুধচিনি স্বাদের মিষ্টির দোকানটা গিলে নিয়েছে—গপ্ !
পান মুখে নেয়ার মতো করে গ্রাসে নিয়েছে তার লাউডগা জড়ানো ভিটাটিও।
বলিউড বাদশাহর মান্নাত আমার নাইবা হলো! আমি আজ নিজদেশে
আস্ত একটা শহুরে ফ্ল্যাটের মালিক।
সেকেন্ড হ্যান্ড। মাঝারি সাইজ। মন্দ নয়।
কিন্তু সেদিনের ক্লাস টেনের সেই আঞ্জু আপার হাওয়ায় দোলা
ওড়নার মতো বাগানবিলাস নয়,
বারোয়ারি ফ্ল্যাট-ভবনের গেটে হাসে
স্বৈরাচার কবলিত গণতন্ত্রের মতো মলিনমুখ কতিপয় গেটম্যান:
স্লামালাইকুম স্যার!
শিফটিং ডিউটি। বেতন কম। টানটান বেশি। প্রতিদিন বাধ্যতামূলক সালামে সেঞ্চুরি।
শেয়াল আর আঙুর ফলের মতন আমার একটা চাকরি ছিল; সেই চাকরির দিন
কয়েকবছর আগেই চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে;
অবসরে ব্যবসা-বাণিজ্য?
সেটা আমার মন-মেধার সিলেবাসে কোনোদিনও ছিল না;
আর এটা সত্য যে, আজও আমার সুভাষ-সলিমুল্লাহ-চিত্তরঞ্জন-
শেরে বাংলা-ভাসানীদের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রয়েছে;
কিন্তু আমার এই ষাটোত্তর পেনশন নির্ভর মনটা
ষাটোত্তর রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছার মতোই রাজনীতি বিমুখ।
কৈশোরের আরমানীর হাসির স্মৃতিতে মুখরিত টিকলীচর গ্রামে চলে যাবো?
যেতে তো পারিই। কিন্তু লোকমান দাদা নেই,
কার সুরেলা কণ্ঠের ফজরের আজানকে
আবদুল আলীমের গান মনে করে আমি
নিদজড়ানো কান পাতবো
চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে চলে আসা সুবহ সাদেকের হাওয়ায়!
পদ্মায় ভিটেমাটিহারা আজকের এই আমি চাইলেও গড়ে তুলতে পারব না
কোনো গ্রামীণ বাগানবাড়ি।
জীবিকার তাগিদে নেয়া নগরের দিনরাত
আমার চোখমুখ থেকে
রোদের রং ও জোছনার জ্যোতি এতটাই কেড়ে নিয়েছে যে,
গ্রামে ফিরে গেলে বেখাপ্পা এই আমাকে দেখে
মুখ ঘুরিয়ে অন্য স্টলে চলে যাবে
জনতার হাটের চায়ের হুল্লোড়;
যদি কাগজি লেবুর গন্ধে জেগে থাকি একা,
উত্তর-আধুনিকতা বিমুখ দোয়েলের দখলে থাকা চাঁদনিরাতের বাঁশবাগান
আমাকে শোনাবে না কাজলাদিদির গল্প;
উদাস আমাকে ঘিরে রোমান্টিক জোনাকিরা রচবে না
স্বপ্নের মারবেল নিয়ে জাগলারি করা আলোকের মালা;
আমার অস্তিত্বে লেগে থাকা দূষণের গন্ধ শুঁকে দূরে সরে যাবে
তিলফুলের ঘ্রাণমাখা অনাধুনিক হাওয়া: যাও, মরাপদ্মার বালুজলে
শরীরটা মেজে আসো যেমন করে প্রতিভোরে তোমার বাল্যসাথি ছবি
তার দাঁতগুলো ছাই দিয়ে করে নিতো মুক্তার মালা।
অন্যদিকে হয়তো সেই উন্মুক্ত মাঠ পেরিয়া আসা
বাতাসের সঙ্গ
বেশিদিন ভালো লাগবে না
ভিন্ন আসক্তিতে জড়িয়ে যাওয়া এই আমারও;
বোতলপ্রেমীরা কি ভালোবাসতে পারে লীনার নাকে সুড়সুড়ি দেওয়া
লালচে সরপড়া গাভীর দুধের তাওয়া!
কিংবা ভেদাভেদ-অন্ধ মন কি উপভোগ করতে পারে
যমুনার জলছুঁয়ে পাথরের গায়ে লেখা জাদুকরী প্রেমের কবিতার
জীবন্ত সৌন্দর্য যা দেখে বিশ্বকবি বলেছিলেন–
‘একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।’?
তো গেটলক, লোকাল, একপ্রেস–সব চালু আছে৷ খোলা সকল রাস্তাও
কিন্তু আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
ট্রাকের হর্ন, ট্রেনের হুইসেল,
প্রযোজিত দাবিদাওয়ার চিৎকার,
ভাড়া খাটা কণ্ঠের রাজনৈতিক স্লোগান,
মাইনাস টু ফরমুলার টেলিভিশন টকশো—
সেসবের কোনোটাই আমার নয়।
স্বেচ্ছাচারী রোদের দিন চলে গেলে কী হবে! তার ছায়ারা তো রয়ে গেছে
সাময়িকতার হাতে পালটিয়ে নিয়ে ধুপছায়া ছবি;
অতএব প্রতিষ্ঠানও ডাকে না আমাকে
কবিতা পড়তে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে।
জোটহীন ভোটহীন এই মন– সারা দিন সারা রাত;
নিজেরই রচা এক অদৃশ্য নির্জন বাড়িতে বন্দি আমি।
না, এটা নুহাশ পল্লীর মতো কোলাহল থেকে দূরে কোনো অবসরবিলাসী
বাগানবাড়ি নয়,– নানা ধরনের শব্দের উৎপাতের মাঝখানে
বোবাভাষাময় এ এক অদ্ভুত আয়নাঘর যা খুঁজে পাবে না
কোনো গুম কমিশন; মাঝে মাঝে মনটা শিকের ফাঁক দিয়ে
দিগন্তে চেয়ে থাকা খাঁচার পাখি হয়ে ওঠে।
কিন্তু এই আয়নাঘরের কোনো মোল্লা শামস নেই;
কাকে বলবো, প্লিজ একটু খুলে দিন না স্যার!
বরইগাছের ছায়াসহ কবরদুটি তো গেছে, মরাপদ্মার পাড়ে গিয়ে
একবার দাদাদাদির রেখে যাওয়া আকাশটা দেখে আসতে চাই!
কাশিমপুর কারাগারের নির্জন সেল নয় কিন্তু সেলের মেজাজ নিয়েই
আমার এই নিঃসঙ্গ বাড়ি; ঘরের ভেতরে ঘর হয়ে একচিলতে রান্নাঘর;
আমিই পাচক, খাদকও আমি। কত কি রান্না করি!
প্রাণে ঘাম আসে, ধোঁয়া উসকানি দেয় চোখের পাতায়;
রান্নায় মিশে যায়
রুবাইয়াতের জাফরানী খোশবু,
মসনবীর অলৌকিক ঘ্রাণ,
কখনো-বা গীতাঞ্জলির গভীর গন্ধ: আহ!
বসন্ত যায়,– গ্রীষ্ম যায়,– বজ্রের নকীব নিয়ে আসে বর্ষা;
নজরুলে বেজে ওঠে তানসেনের মেঘমল্লার:
‘শ্যাম-তন্বী আমি মেঘ-বরণা….’ ।
অলখে অলখে কেটে যায়
কোলাহল ঘেরা নৈঃসঙ্গ্যের তাজমহলে সমাহিত
যাবতীয় সকাল দুপুর সাঁঝ।
মাঝে মাঝে স্বপ্ন নিয়ে আসে স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাক—
স্রোতে ডুবসাঁতার দিয়ে ভেসে যাই ভাটিতে—-
বাখরালীর ঘাট ছাড়িয়ে গোয়ালডুবীর পাড় ভাঙা বাঁকের উজানে ।
কোনো কোনো রাতে সারারাত লাশের উপমা হয়ে থাকি
স্বপ্নহীন ঘুমের অতলে।
কোনো কোনো রাতে পাতাহীন চোখের শয়তান আর কোতোয়ালি থানার
সাথে পাল্লা দিয়ে জেগে থাকি একা—
আধো জাগরণের আগুনে–মেহেদী হাসানের পাক খাওয়া সুরের স্রোতে
ভেসে আসে মীর তকী মীর:
‘দেখ তো দিল কে জাঁ সে উঠতা হ্যায়— ইয়ে ধুয়াঁ সা কাহাঁ সে উঠতা হ্যায়…’।
আমি তো শুনি। শয়তান কি শোনে সেই গান? কিংবা থানা?
——০০০ ——
“জোটহীন ভোটহীন এই মন– সারা দিন সারা রাত;
নিজেরই রচা এক অদৃশ্য নির্জন বাড়িতে বন্দি আমি।”
কবিতার শিরোনামটি ধাধা টাইপের হলেও কবিতাটি পাঠ করলেই বোঝা যায় তার মর্মার্থ কি । কবি আসলে ভবেশ কাকার মিষ্টির দোকান বলতে সেই দোকানের মিষ্টান্নের দিকে ইংগিত করেন নি,তিনি সেই দোকানের কোলাহল, মানুষের আনাগোনা, গল্প গুজব,আড্ডা ইত্যাদি কে বুঝিয়েছেন । অন্যদিকে আধুনিকতার চাপে বিশাল শহুরে বাসায় থাকলেও তিনি তাকে নিঃসংগতার রান্নাঘর বলেছেন,যার পাচক,খাদক তিনি নিজেই । সেখানে অনেক মানুষ থাকলেও একেক জনের জগৎ ভিন্ন,আর তাই সেখানে নিঃসংগতার গভীরতাও অতল ।
দারুণ যুগোপযোগী একটি কবিতা এটি। কী চমৎকার ভাবেই না কবি বিভিন্ন চিত্রকল্প, উপমা, ও যুতসই শব্দের মিশেলে কবিতাটিকে করে তুলেছেন সুপাঠ্য !
Bayazid Bostami, আপনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অনেক সুন্দর। কবিতাটিতে জীবনের দুটি বিপরীতার্থক রূপের বা অবস্থানের নিবিড় ছবি আছে যা এই অভিমতে ধরা পড়েছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় গুণীজন। এবং শুভকামনা।
কবিতাটির নামকরণ দেখে অনেকেই হয়তো মিষ্টির দোকান বা রান্নাঘর মনে করতে পারেন। আসলেই মিষ্টির দোকান বা রান্নাঘর শব্দগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মিষ্টির দোকানে বসে গল্পগুজ, গ্রামীণ আড্ডা, কল কোলাহল ইত্যাদি যেন একটি অনুষঙ্গ মাত্র। এসব অনুষঙ্গের অন্তরালে গ্রামীণ জীবন ও সেখানকার পরিবেশ পরিবেশন অতঃপর শহরে জীবন ও বসবাস করার এবং শহর জীবনের অন্তরালে সেই ভবেশ কাকার মিষ্টি বার বার হাতছানি দিয়ে আহ্বান জানায়। জীবনের এই তো চলমান বাস্তবতা ও প্রতিধ্বনি। দারুন একটি কবিতা শুরু এবং সমাপ্তির মধ্য দিয়ে একটি জীবন নদীর কথায় যাপিত আবেদনের চিত্রিত হয়েছে। কবিতা উপস্থাপন করতে গিয়ে নানা ধরনের উপমা, অলংকার, রূপক, চিত্রগল্প ও রূপকল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশেষ করে ভাষা ও শব্দ বুনন এর মধ্য দিয়ে আবহমান বাংলা ও বাঙালির যাপিত আবেদনের যে চিত্র সেটিকেই খুঁজে পাওয়া যায়।
খুবই মূল্যবান এবং গুরুত্বফূর্ণ আপনার অভিমত যা কবিতাটির বিষয়ভাবনা এবং সৃষ্টিশৈলী উভয় দিক বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে। আমি আনন্দিত। অনুপ্রাণিতও। অনেক অনেক ধন্যবাদ গুণিজন। এবং শুভকামনা।
যেতে তো পারিই। কিন্তু লোকমান দাদা নেই,
কার সুরেলা কণ্ঠের ফজরের আজানকে
আবদুল আলীমের গান মনে করে আমি
নিদজড়ানো কান পাতবো
চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে চলে আসা সুবহ সাদেকের হাওয়ায়!
পদ্মায় ভিটেমাটিহারা আজকের এই আমি চাইলেও গড়ে তুলতে পারব না
দীর্ঘ এই কবিতাটি আপনার ভালো লেগেছে দেখে আনন্দিত আমি। অনুপ্রাণিত আরও বেশি। অনেক অনেক ধন্যবাদ কবি।