spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যপ্রবাসে নিঃসঙ্গ সারসের ঈদ

লেখা ও ছবি : শান্তা মারিয়া

প্রবাসে নিঃসঙ্গ সারসের ঈদ

শান্তা মারিয়া

মহাভারতের স্বর্গারোহণ পর্বে যুধিষ্ঠির স্বশরীরে স্বর্গে গিয়ে প্রথমেই  প্রিয় ভাইসকল এবং প্রিয়তমা দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।  তাকে বলা হলো ওরা স্বর্গে আসতে পারেননি। যুধিষ্ঠির তার প্রিয়জনদের ছাড়া এক মুহূর্তও স্বর্গে থাকতে চাইলেন না। তিনি বললেন, স্বর্গ যতই সুন্দর ও আরামদায়ক হোক না কেন, প্রিয়জনদের ছাড়া স্বর্গ আর স্বর্গ নয়। বরং প্রিয়জনরা যেখানে থাকেন সেটাই স্বর্গ। কেন যে তিনি প্রিয়জনদের ছাড়া স্বর্গে থাকতে চাননি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আজকে। এবারের মতো এত একা একা ঈদ উদযাপন আর কখনও করতে হয়নি। এর আগে প্রবাসে ঈদ পালন করেছি বটে কিন্তু তখন অর্ণ ছিল, শাহিন ছিল। আরও ছিলেন আমার বোনের মতো সহকর্মী উর্দুভাষার শিক্ষিকা জাভারিয়া চুঘতাই। অন্য বিদেশি সহকর্মীরাও ছিলেন। গতবার যখন কুনমিংয়ে ছিলাম তখন জাভারিয়া এবং অন্যরা থাকাতে মনে হয়েছিল আত্মীয়দের মধ্যেই আছি। আর শাহিন রিজভির হাতের রান্না তো ছিলই।

বেইজিংয়েও দুইবার ঈদ করেছি। সেসময় একা হলেও বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে অন্তত ঈদের খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু আজকের ঈদে যে কি মন খারাপ হয়েছে তা বলার নয়।

চীনে দুই কোটির উপর মুসলিম বাস করেন। রয়েছে অসংখ্য মসজিদ। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মসজিদও চীনের কুয়াংচৌ(বাংলাদেশীদের কাছে গুয়াংজোও) শহরে অবস্থিত। হুয়াইশাং মসজিদ নামের এই মসজিদ ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে সাহাবি সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস(রা.) গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর মামা।

চীনের প্রতিটি শহরেই ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বড় শহরগুলোতে তো একাধিক ঈদের জামাত হয়। কুনমিংয়েও সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত হয়েছে নানফিং চিয়ে সড়কের ছোংদা মসজিদে। এর আরেক নাম নানছাং মসজিদ।এই মসজিদ প্রথম নির্মিত হয় অষ্টম শতকের দিকে। এরপর অনেকবার সংস্কার হয়েছে। বর্তমান ভবনটি ১৯৯৬ সালে ব্যাপক সংস্কার ও নির্মাণ কাজের ফসল।নানছাং মসজিদের ভবন পাঁচতলা। প্রথম ও দ্বিতীয়তলায় দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থ মসজিদের বিভিন্ন কাজে ব্যয় হয়। তৃতীয়তলায় রয়েছে রান্নাঘর, অজুখানা, পানির চৌবাচ্চা, বসার ব্যবস্থা। আরও রয়েছে আবাসিক ব্যবস্থা। চতুর্থ তলায় রয়েছে নারীদের নামাজ পড়ার হলরুম। চতুর্থ তলায় মেহমানদের থাকার জন্য আবাসিক ব্যবস্থাও রয়েছে। এটি মুসাফিরখানা ও অতিথিশালা হিসেবে পরিচিত। পঞ্চমতলায় রয়েছে পুরুষদের নামাজ পড়ার হলরুম। মসজিদের ছাদে চমৎকার একটি বাগানও রয়েছে।

হুই হুই ইন নামের মসজিদেও ঈদের জামাত হয়েছে। কিন্তু এবার আমি একটি জামাতেও অংশ নিতে পারিনি সকালে ক্লাস থাকায়। সকালে তড়িঘড়ি করে ক্লাস শেষ করে রওনা দিলাম সাবওয়ে স্টেশনের দিকে। গন্তব্য নানফিং চিয়ে। এখানেই নানছাং মসজিদ এবং এর আশপাশে বেশ বড় মুসলিম কমিউনিটির বাস। গিয়ে পৌছালাম সাড়ে বারোটা নাগাদ।

ততোক্ষণে ঈদের অনুষ্ঠান শেষ। বেইজিংয়ে এর আগে ঈদের মেলা দেখেছিলাম।  এবার এখানে তেমন কিছু দেখলাম না। হয়তো বিকেলে মেলা বসবে। এসব মেলায় সাধারণত হালাল খাবার ও অন্যান্য সৌখিন সামগ্রী পাওয়া যায়।

এখানে মসজিদের সাথেই রয়েছে ফুড স্ট্রিট। সেখানে অনেকগুলো হালাল রেস্টুরেন্ট আছে। এগুলো সবই মুসলিম পরিচালিত।

বিশ্বব্যপী মুসলিম খাবারের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন কাবাব ও রুটি জাতীয় খাবার, পোলাও ধরনের খাবার, মিষ্টি খাবার ইত্যাদি। মুসলিম জনগোষ্ঠী সুস্বাদু খাবার তৈরির জন্য বিখ্যাত। চীনেও মুসলিম রেস্টুরেন্টগুলো বেশ জনপ্রিয়।

চীনে ৫৬ জাতির মানুষের বাস। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হলো হানজাতির মানুষ। দশটি এথনিক গ্রুপ ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে। এরা হলো হুই, উইগুর, তাজিক, কাজাখ, সালার, তাতার, পাওআন, উজবেক, তুংসিয়াং ও কিরগিজ। ইউননান প্রদেশে হুই জাতির প্রচুর মানুষ রয়েছে। হুই হুই ইন নামের একটি বিশাল মহল্লা রয়েছে হুই মুসলিমদের। যেখানকার মসজিদে ঈদের জামাতের কথা আগেই বলেছি। এই মসজিদে আগে আমি জুম্মার নামাজ পড়েছি। কিন্তু আজকে যেতে পারিনি কারণ এখন যেখানে থাকি সেখান থেকে ওই পর্যন্ত সরাসরি বাস নেই। লিয়ানডা স্ট্রিট সাবওয়ে স্টেশনে নেমে অনেকদূর হাঁটতে হয়। যাক যা বলছিলাম। ইউননানের হালাল খাবারের দোকানগুলো মূলত হুই মুসলিমরাই পরিচালনা করেন।

এখানে ইয়াংরোছুয়ান বা ছাগলের মাংসের কাবাব আর নুডুলস খেয়ে ঈদের ভোজ সারলাম। দেখলাম বিনে পয়সায় গোলাকার রুটি বিলানো হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে। অনেক মুসলিম পরিবার ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে রেস্টুরেন্টে মজাদার খাবার খাচ্ছেন। আবার অনেকে নিশ্চয়ই বাড়িতে রান্না করেছেন। দশটি মুসলিম এথনিক গ্রুপের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে। যেমন মাংসের(ভেড়া বা ছাগল) হটপট। গরুর মাংসেরও বিভিন্ন রকম খাবার তৈরি করেন এরা। নেহারি ধরনের একটি খাবারও বেশ জনপ্রিয়। গরুর মাংসের শিককাবাব, ভাজা মাংস ইত্যাদিও জনপ্রিয়। সঙ্গে থাকে বিশাল গোলাকার রুটি। উইগুরদের নানরুটিও বিখ্যাত।

প্রতিটি এথনিক গ্রুপের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক রয়েছে। শুধু সাংস্কৃতিক পরিবেশনা বা উৎসবে সেগুলো পরেন তারা। তবে কাজে কর্মে ও সাধারণ সময়ে সকল চীনা নাগরিকই পাশ্চাত্য ধরনের পোশাক পরেন। নারীরা শার্ট, প্যান্ট, স্কার্ট, গাউন ও লং ফ্রক ধরনের পোশাক পরেন। মুসলিম, অমুসলিম সকলের পোশাকই এরকম। তবে অনেক মুসলিম নারী মাথায় একটা স্কার্ফ পরেন। সেটাও অনেকে না পরতে পারেন। নামাজের সময় স্কার্ফ পরেন সকলেই। পুরুষরাও পাশ্চাত্যের পোশাক পরেন। তবে নামাজের সময় অথবা ইচ্ছা হলে মাথায় টুপি পরেন।

আজকেও নানফিং চিয়েতে তাই দেখলাম। তবে ঈদের দিন বলে সকলেই একটু দামি পোশাক পরেছেন।

আজকে সকাল থেকে আকাশের মনখারাপ। আর এত ঠাণ্ডা যে কি বলবো। তাই বেলা তিনটে নাগাদ নানফিং চিয়ে থেকে ফিরতি ট্রেনে উঠে পড়লাম। কারণ মেলা দেখার আশায় যদি বৃষ্টির কবলে পড়ি তাহলে আর দেখতে হবে না। নির্ঘাত সর্দি কাশি হবে।

বাসায় ফিরে মনে হলো একটু ভালো কিছু রান্না করি। কিন্তু একা একা নিজের জন্য রাঁধতে মোটেই ইচ্ছা হয় না। আর আমার তো এমনিতেই সবচেয়ে অসহ্য বিষয় হলো রান্না। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে চটজলদি যেটা বরাবর রান্না করি সেই ওটসের পরিজ দিয়েই ডিনার সারলাম। হায়, আজ যদি এখানে শাহিন রিজভি থাকতেন তাহলে কি আর আমার এমন নাজেহাল অবস্থা হয়। পোলাও মাংস, কাবাব, বোরহানি, সেমাই, জর্দা সবই খাওয়া যেত।

কুনমিংয়ে বাংলাদেশের বেশ অনেকজন ছাত্রছাত্রী আছেন। তাদের একটা কমিউনিটিও আছে। কিন্তু আমার সঙ্গে এখনও খুব বেশি যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। আর আমার বাসস্থান ছ্যংকং থেকে বাংলাদেশ কনসুলেটও বেজায় দূরে। তাই পোলাও খাবার লোভে আর সেখানে যাওয়ার এনার্জি ছিল না।

প্রবাস মানেই পরবাস। সত্যিই একেবারে পর পর ভাব। নিজেকে আমার নিঃসঙ্গ সারস পাখির মতো মনে হচ্ছিল। পরিবারের লোকজন ছাড়া, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া, বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাড়া ঈদ কোন ঈদই নয়। একা একা ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে নিজে নিজেই গাইছি ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on মরুভূমি
সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা