তপু সরকার
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটি শিরোনাম করেছে, ‘নতুন বাংলাদেশ গঠনে সুযোগ নিচ্ছে কট্টর ইসলামপন্থীরা।’
এই প্রতিবেদনটি তৈরী করেছে নিউইয়র্ক টাইমসের মুজিব মাশাল এবং বাংলাদেশের সাইফ হাসনাত। প্রতিবেদনটি নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে এবং এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটির এক জায়গায় উল্লেখ করেছে,
“নারী শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের এখন ধর্মীয় লোকরঞ্জনের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। তাদের লড়াই করতে হচ্ছে এমন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, যারা হিন্দু ও ইসলামের ছোট ছোট সম্প্রদায়ের অনুসারীসহ নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।”
এই কথাটি যে কতটা প্রপাগাণ্ডা সর্বস্ব তা বাংলাদেশের জনগণ জানে। জুলাই পরবর্তী সময়ে দেশে কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এটা সত্য। কিন্তু তাদেরকে প্রশাসন গ্রেফতার করেছে। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ নারী গার্মেন্টসে যাতায়াত করে, কোটি কোটি নারী শিক্ষার্থী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করে। অসংখ্য চাকরিজীবী নারী তাদের অফিসে যাতায়াত করছেন। বাস, ট্রেন ও অন্যান্য পরিবহনে লক্ষ লক্ষ নারী চলাফেরা করছেন। পত্রিকাটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। কিন্তু ওই ছাত্রীর বক্তব্য তো দেশের সমগ্র নারীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। বাংলাদশে ৫১% নারী আছেন। একজন নারীর বক্তব্য তো ৫১% নারীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।
প্রতিবেদনটির বড় অংশ জুড়ে বলা হয়েছে, তারাগঞ্জে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছে মসজিদ নেতা। এ ব্যাপারে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, “সারা বাংলাদেশে তিন হাজার ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি ঘটনা ঘটেছে সেটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সেটা সমগ্র বাংলাদেশের অবস্থা মনে করা স্রেফ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হলুদ সাংবাদিকতা।”
আরেকটি ব্যাপারে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, এখানে একজন নারী হেনস্থাকারীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে যেটি হয়েছে, তার ব্যাপারে দেশের মেইনস্ট্রিম ইসলামিস্টরা যথেষ্ট প্রতিবাদ জানিয়েছ সোশ্যাল মিডিয়ায়। যারা ফুল দিয়ে বরণ করার কাজটি করেছে তারা কাজটি ঠিক করেনি বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তারা। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে দেশের মুসলমান কমিউনিটি ভালো চোখে দেখেনি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং পুরো প্রতিবেদনের উপর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। প্রেস উইং বলেছে,
“নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধটি বাংলাদেশের একটি বিভ্রান্তিকর ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে দেশটি ধর্মীয় চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণের দ্বারপ্রান্তে। এই বয়ান কেবল দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতিরঞ্জিত করে না, বরং ১৮ কোটি মানুষের একটি সমগ্র জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকির মুখেও ফেলে দেয়। একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরার মতো বেছে বেছে উসকানিমূলক উদাহরণের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে বিগত বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও পরিস্থিতির জটিলতা স্বীকার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন নিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন,
“আমরা চেষ্টা করব, বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা যেন মাথাচারা দিতে না পারে। নির্বাচনের মাধ্যমে যেন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভূমিকা রাখতে পারি। যদি আলোচনা সতর্কতায় কাজ না হয়, যদি দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হয়, সরকার অবশ্যই হার্ডলাইনে যাবে।”
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন নিয়ে বিএনপি নেতা রহুল কবির রিজভী বলেছেন,
“নানা ধরনের যে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে তার আরেকটি প্রমাণ হলো – ‘বাংলাদেশে আবার ইসলামী উগ্রবাদের উত্থান’ ইত্যাদি বলে নিউইয়র্ক টাইমসের যে প্রতিবেদন। এর পেছনে নিশ্চয়ই কারা জড়িত বাংলাদেশের মানুষ জানে। আজকে যারা পরাজিত শক্তি এবং তাদেরকে যারা মদত দেয় তাদের যৌথ প্রচেষ্টা এটা। আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি।বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কেউ জানে না এখানে কোথায় উগ্রবাদের উত্থান হয়েছে? কোন এলাকায়? কোন মহল্লায়? কোন গ্রামে? এখানে যারা ধর্মপ্রাণ মানুষ তারা উপসনালয়ে যাচ্ছে, মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডায় যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের কোনো ছোবল নেই, মানুষ নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন। কথা বলতে পারছে।”
তবে, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন নিয়ে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে বামপন্থীদের। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী আলতাফ পারভেজ পত্রিকায় কলাম লেখেন,
“প্রতিবেদনকে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হাস্যকর। বরং নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ ও অপূর্ণাঙ্গ। এতে হিমশৈলের চূড়াও প্রকৃত চেহারায় আসেনি। বাংলাদেশের সমাজ জীবন ও শাসন কাঠামোতে ধর্মীয় প্রভাবের ব্যাপকতা সামান্যই ছুঁতে পেরেছেন দুই প্রতিবেদক।”
আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতীয মিডিয়া বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা বলতে চাইছে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের দখলে চলে গেছে। ড. ইউনূসের বিশ্বব্যাপী যে ইমেজ সেটা না থাকলে হয়তো নতুন সরকার বেকায়দায় পড়তো৷
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ ও জঙ্গি রাষ্ট্র প্রমাণ করার চেষ্টার প্রাথমিক ধাপ।’