আকিব শিকদার
………….
ন্যায়-অন্যায়
…………..
গ্লাস-চামচের টংকার, টেবিলে তোমার তৈরি হচ্ছে শরবত
তোমার প্রতিবেশী যদি শব্দ শুনেও তৃষ্ণার্ত থেকে যায়
বুঝে নিও তোমার ভাগ্যে জমা হচ্ছে অপরাধের দায়।
যদি ফল-ফলাদি আহার করে তোমার সন্তানেরা
পাশের ঘরের শিশুটিকে দিও কিছুটা ভাগ
আর যদি না দিতে পারো, উঠানে ফেলো না ফলের খোসা
ওরা খোসা দেখে বড্ড কষ্ট পাবে, এবং করবে রাগ।
জৌলুসময় পোশাক পরার আগে দেখবে ভেবে
তোমার পড়শী-স্বজন এমন জামা পরিধানের সামর্থ্যবান কিনা–
যদি অপারগ হয়, তবে তাদের ত্রিসীমানায়
সুশোভন সে পোশাক পরে ঘোরাটা তোমার অন্যায়।
তোমার ঠোঁটের আড়াল থেকে এমন বাণী যেন বেরিয়ে না যায়
যা শুনলে তোমার পার্শ্বজনের অন্তরেতে লাগে ছুরির আঘাত।
…………..
উৎসব
…………..
বাবা যাদের সরকারি অফিসে ছা-পোষা কেরানী
তাদের আবার উৎসব কী! তিন বেলা খেতে পাই, এই তো বেশি।
আমরা হিন্দু। অফিসের বড়কর্তা
বাবাকে দিয়েছিলেন নিমন্ত্রণ– ‘বেড়াতে এসো সপরিবারে,
ঈদে খুব আনন্দ হয়।’
প্রভাতে দেখলাম মুসলিম লোকদের পরনে
পাঞ্জাবি-টুপি, হাতে জায়নামাজ, দল বেঁধে
যাচ্ছে ঈদগাহে। নামাজ শেষে পশুর গলায় চালাবে ছুরি।
বেলা বাড়তেই বাবা ডেকে বললেন– ‘চল বেড়িয়ে আসি
স্যারের বাসায়। সম্মানিত লোক, সাক্ষাৎমাত্র
পা ছুঁয়ে করবি সালাম।’
বাবার কথা রাখলাম। স্যার আমাকে
অবাক করে হাতে ধরিয়ে দিলেন
দুটি পাঁচশো টাকার নোট, ঈদের সালামী।
এবং পরম মমতায় বসালেন পাশের সোফায়; খেতে দিলেন
দুধেল সেমাই, ভাজা মিষ্টি পাঁপড়। বাবার সঙ্গে স্যার
কথা বলছিলেন এমন হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিমায়, দেখলে কে বুঝবে
অফিসের বড়কর্তা আর সামান্য কেরানীতে চলছে আলাপ!
স্যারের একটা ছেলে, আমারই মতন বয়স। দুজনে
অনেকটা সময় খেললাম ক্রিকেট, দেখলাম
কুরবানীর মাংসের কাটাকুটি।
যখন বিদায় নিয়ে চলে আসবো, আমাকে দিলো
খাসির মাংসভরা একটা থলি। প্রায় দু’কেজি ওজন।
চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এলো, আর নম্রতায়
নতমাথায় ভাবলাম– ‘ধর্ম যাই হোক, কোন উৎসবই
কারও একার নয়, আর ঈদও একটা উৎসব।’
……………..
রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা
……………..
ভালবাসার জন্য মানুষ কী না পারে–
কী না পারে বলুন?
সাত সাগর তেরো নদী পার!
হোহ… সে তো
সামান্য, ফুলের রেণুর মতো যৎসামান্য।
হানাদার বাহিনীর হাতে
ধরা পড়েছিল একজন
সোনার মানুষ, মুক্তিকামি সোনার মানুষ।
শত অত্যাচার, তবু
মুখ খুললো না সাহসী সে তরুণ।
যদিও বেয়নেটের খোঁচা
লাগছিল উরুতে, বুকে স্টেনগান ধরা
মুখের উপর কটু প্রশ্ন–
‘আমাদের জিজ্ঞাসার
জবাব চাই, অগত্যা গুলি করে মারবো তোমায়।’
চূড়ান্ত নির্ভীক বলে, বুকভরা
খাসা দেশপ্রীতি ছিল বলে–
নিচু হয়ে চুমু খেল
স্বদেশের মাটিকে, প্রেয়সীর গালে শেষ চুম্বনের মতো।
তারপর উঠে দাঁড়ালে
সটান, ঝাকড়া চুলের বাবরি নাড়িয়ে বল্লে–
‘যথেষ্ট প্রস্তুত আছি, আমার রক্ত
প্রিয় দেশটাকে দেবে স্বাধীনতা’।
বাতাসের কলরব
থামলো হঠাৎ। ছিঁড়ে গেল মালার আদলে ওড়া
পাখিদের ঝাঁক; ভিজে গেল ঘাস, শ্যামল মাটি।
ভেজা পতাকার মতো
রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা, আর
নক্ষত্ররূপী জ্বলজ্বলে জামার বোতাম।
…………….
যুদ্ধ ফেরত
…………….
যুদ্ধ কোন ছেলে খেলা নয়–
এ বিষয় ছেলেটার ভালো করে জানা। ওর টগবগে রক্তের
প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সর্বক্ষণ
লেগে আছে দাউ দাউ সংগ্রামী অগ্নি।
বুনো বেবুনের মতো ডালে ডালে নেচে বেড়ানো
চটপটে, দাঁত খিচিমিচি করে হাসা ছেলেটা–
নিশানা ওর যথেষ্ট তীক্ষ্ণ, নির্ভুল; প্রতিজ্ঞা ওর মৃত্যুর মতো
অমোঘ, অপরিবর্তনীয়। কেননা তার শৈশব কেটেছে
মারবেল আর ডাঙ্গুলী খেলে।
মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে লাঠি ছুঁড়ে আমপাড়া ছেলেটা
তাই বুঝি পেরেছিলো–
অজস্র পাহারাদারের দৃষ্টিতে ছানি ফেলে চুপিচুপি ছিনিয়ে নিতে
হানাদারদের কার্তুজ, আর কী নিপুণ লিচু চুরি করা হাতে
তুলে নিতে টসটসে আতার মতো মারাত্মক গ্রেনেডগুলো।
ছেলেটা দেখেছে বহুবার
তার মাকে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখা রত্মগর্ভা মাকে–
পিক ফেলতে গিয়ে শনের বেড়ায় আঙুলের চুন মুছতে।
মায়ের সে আঙুলের ছাপ, চুন মাখা টিপসই
আজও তার চোখে ভাসে বর্ণখচিত ব্যানারের মতো, যেন সেই
শনের বেড়াটি বিপ্লবের প্রতিবাদী পোস্টার।
যুদ্ধ সে যতোই স্থায়ী হোক, আর রক্তক্ষয়ী, ঘাতকের মুখে
চুনকালি মেখে থুথু ছিটিয়ে
বন্দুকের নলে পত পত বাংলার পতাকা দুলিয়ে, বনে ফেরা
বাঘের মতো ঘরে ফিরবেই ছেলেটা। ঘরে ফিরবেই ছেলেটা
সেই বোনটির জন্য– যে বোন বিছানায় হুমড়ি খেয়ে কান্না ছাড়া
কিছু আর পারে না, সেই মায়ের জন্য
ঘরে ফিরবেই ছেলেটা– যে মা জানালায় পথ চেয়ে বসে আছে
সন্তানের, আর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে না নিতেই
অতর্কিতে যে বাবাকে তুলে নিলো হানাদার বাহিনীর জীপ
তার জন্য তার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য
সমগ্র বাংলাদেশটা তাবিজ সম গলায় ঝুলিয়ে
কেশর ফোলানো সিংহের মতো ঘরে ফিরবেই ছেলেটা।