মজিদ মাহমুদ
[ফিলিস্তিনি-সংগ্রাম দুঃখ-দুর্দশা গণহত্যা ধর্ষণ নির্যাতন মানবিক বিপর্যয় মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা বিশ্বজাতির নীরবতা অসহায়তা নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিতে বিভিন্ন সময়ে কবিতা লিখেছি, আজ তাদের চরম দুঃসময়ে তারই কয়েকটি একত্রে রেখে দিলাম।]
১. জেরুজালেম
অন্ধকারে ছিল যখন আমেরিকা য়ুরোপ
ভারত ভূমির কথা জানত না বেশি লোক
জানত না কেউ- আমরা কখন সভ্য হলেম
তখনো ছিল- জেরুজালেম! জেরুজালেম!
মুসাকে যেহেতু দিলেন প্রভু অঙ্গীকার
থাকবে এখানে সন্ততি আর সঙ্গী তার
তারাই হয়েছে ইহুদি নাসারা আর মোস্লেম
এখানে বসত গড়েছে সবে জেরুজালেম!
যারা এখানে রক্ত ঝরায় রাত্রি দিন
সভ্যতাকে রেখেছে যারা নিজ অধীন
খুঁজেছে এখানে অমর মানুষ নিকষিত হেম
তবু এখানে রক্ত ঝরে জেরুজালেম!
কে দেবে বল অভঙ্গ সেই তীর ও তুন
কে তাড়াবে সিনাই থেকে হিংস্র শকুন
সর্ব ধর্মের প্রার্থনা হোক মানুষের প্রেম
মানুষ এনেছে সভ্যতা এই জেরুজালেম!
২. ঈশ্বর দর্শন
ফিলিস্তিনি শিশুটি ছাড়া কেউ আল্লাহকে সরাসরি দেখেনি
খোদার তাজাল্লি দেখে মুসা হয়েছিলেন নিশ্চেতন
তাঁর দূরবতী আগুনের ইশারায় পুড়ে গেল তুর-পর্বতমালা
পবিত্র সেই ছাইভস্ম এখনো মানুষ মাখে চোখে- ঈদ-পার্বণে
আজ মুসা নেই- এখনো হয়নি চাক্ষুষ দিদার
অথচ তাঁর সেই সিনাই পর্বতে
প্রতিশ্রুত ভূমিতে- নিত্য পড়ছে অগ্নির গোলা
আকাশ থেকে নেমে আসছে টন টন আগুন
বিকট চিৎকারে ফেটে যাচ্ছে শিশুদের মাথার উপর
তাদের পিতা নেই, অঙ্গবিহীন সহোদর কাতরাচ্ছে–
বিধ্বস্ত হাসপাতালের অলীক বেডে
কিছুক্ষণ আগে তার মায়ের রক্তে ভিজেছে ফুটপাত
এখন আর কেউ নেই– না ঘর, না স্বজন
শিশুটি দৌড়াচ্ছে, আর আল্লাহকে ডাকছে-
ইয়াল্লাহ! ইয়াল্লাহ!
যেন দূর থেকে তাঁকে দেখেতে পেয়েছে
তুমি সামনে কোথাও আছ– নিশ্চিত জানে সে
তোমাকে সে বলতে চায় কিছু–
তাঁর শরীর থেকে রক্ত মুছে দিয়ে
তুমি তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে
আর ভাইদের সুস্থ করে দেবে
ঘরগুলো করবে মেরামত
আর বোমাবাজদের করবে পাকড়াও।
৩. স্বাধীন ফিলিস্তিন
একদিন স্বাধীন ফিলিস্তিন হবে–
শিশুরা জেগে উঠবে ভূমধ্যসাগর তীরে
মায়েরা করবে সন্তানের জন্য খাদ্য প্রস্তুত
বোমার শব্দবিহীন জেগে উঠবে ভোরের লালিমা
যদিও সেদিন আমি থাকব না
সেদিনও মানুষ থাকবে এই গ্রহে
কয়েক দিনের ব্যবধানে চলে যাবে ট্রাম্প
মরে যাবে তেলাবিবির কসাই
যদিও আসবে পৃথিবীতে নতুন ইহুদি
ইহুদি- কোনো ধর্ম নয়, জাতি নয়, নয় মানবিক সংঘ
পুঁজির দাসত্ব যার ধর্মে ঈশ্বর উপাসনা
তুমিও হতে পারো আমিও হতে পারি ইহুদি শাবক
ঈশ্বর পুত্র যীশু বলেছিলেন সে কথা সহস্রাব্দ আগে
আজ পৃথিবী বুড়ো ইহুদির দখলে
চারিদিকে ইহুদি সংঘ
ফুরিয়ে যাচ্ছে সৌদি তেলের মজুদ
খাদ্যের অপচয় শেষে তারা
দেশে দেশে করিছে মসজিদ নির্মাণ
বাংলা পাক বুরকিনা ফাসোতে
তীর্থযাত্রীদের কেনাকাটা হবে বিবিদের মৃগয়া
বুভুক্ষ শিশুরা তুলিতেছে মুখে তৃণের গ্রাস
ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপাপড়া শিশু অনবরত কাঁদিতেছে
অবুঝ সহোদর খুঁজিতেছে তাকে
অবুঝ সহোদরা খুঁজিতেছে তাকে
মাথার উপর তেলাবিবির শকুন উড়িতেছে
একটি ডুগং শিশু করিতেছে খেলা
লোহিত সাগরের জলে উঠিছে ভেসে বহুবর্ণিল প্রবাল
সামনে যদিও বাব এল মান্দেব– মরণ উপত্যকা
তবু সিনাই উপকূলে ওই তো সূর্য উদিতেছে..
৪. দাইফ দ্য মাস্টারমাইন্ড
কারা তোমায় হত্যা করে
যারে তুমি হত্যা করেছ–
সে-ই তোমায় হত্যা করে
যারে তুমি হত্যা করো
নিহতের অশরীরি শরীর–
তোমার পশ্চাৎ অনুসরণ করে
তুমি বেঁচে থাকলেও মরে যাও
যদিও তাকে তুমি দেখ–
আসলে সে তোমার চোখের ভ্রম
সে তার ছায়া
যাকে তুমি হত্যা করেছ
যেমন দাইফের কথা ধরা যাক–
তার একটি পা তুমি আগেই নিয়েছ
তার শিশুপুত্র, তিন বছরের আদরের কন্যা
প্রিয়তমা স্ত্রী- কারা তাকে হত্যা করেছিল
দাইফ তো দেখতে পারে না
তার চোখ অন্ধ হয়েছিল তোমার স্প্লিন্টারে
তার বৃদ্ধ পিতা
তার স্নেহময়ী মা
তারাও মরেছে তোমার গুলিতে
তুমি ছায়ার সাথে যুদ্ধ করছ
চাচ্ছ প্রাণ-ভিক্ষা
প্রেতলোকে করছ শান্তি প্রার্থনা
তুমি ভাবছ তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ
সে-ই করছে এসব অনাসৃষ্টি
বলো, কেউ কি তাকে দেখেছে কখনো
তার ছবির সত্যতা কেউ করেনি নিশ্চিত
তার সহপাঠীরাও মরে গেছে একই নিয়মে
যখন তার স্ত্রীর খুলি উড়ে গেল
তোমার বোমায়
গুলিতে ঝলসে গেল শিশুপুত্রের বুক
তার কন্যাটিও মরে গেল চোখের সামনে
তখন কি করে দাইফ বেঁচে থাকে
অহেতুক ভাবছ সে বেঁচে আছে
যেহেতু তুমি তার অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়েছ
যেহেতু তার আত্মা ঘুরে বেড়ায় তোমার চারপাশে
তুমি তার ছায়ায় মারো বোমা
কে তোমায় মারছে হে অবোধ খুনি
মৃতরা ছাড়া কেউ তোমায় মারতে পারে না
এটা তো মৃতদের আবাস ভূমি
যারা মারা গেছে গোলান পর্বতে
যাদের বাড়িঘরে করছ বসবাস
শুনছ তাদের আত্মার দীর্ঘশ্বাস
তাদের কবরের কারাগারগুলো দিচ্ছ পাহারা
কেউ তোমায় মারেনি
কেউ তোমায় মারবে না
যার স্ত্রী মরেনি তোমার গুলিতে
যার ভাই স্তব্ধ হয়নি বেয়োনেটের খোঁচায়
দাইফ সত্যিই বেঁচে নেই–
জন্মের মূহুর্তে মরে গেছে শরণার্থী শিবিরে
দাইফের কোনো দেশ নেই, সে অনাগরিক
তুমি তার গল্প বানাচ্ছ
তার নামে কথা সাজাচ্ছ
দাইফ তোমার ছায়াসঙ্গী
দাইফ তোমায় তেড়ে বেড়াচ্ছে
তেড়ে বেড়াবে প্রজন্মান্তর
তুমি সংখ্যা দিয়ে ধরতে পারবে না
মুছে দিতে পারবে না কখনো
কারণ দাইফ তোমার হত্যাকাণ্ডের ফসল।
৫. মৃত্যু
আমি মরবো বলেই জন্মেছি–
তবু দিচ্ছ মরার ভয়–
মরতে না পারলে অহেতুক আশ্বাস
তুমি বরং অভিশাপ দিতে পারো বাঁচার–
যা কার্যত হবে না সফল
দু’একটি ছোট মৃত্যু তুমি করেছ বশীভূত
কিন্তু তারা বড়-মৃত্যুর চেলাপুলা
আমি গভীর নদীতে দিই ঝাঁপ
দাবানলে করি মৃগয়া
পাহাড় থেকে অনেকবার পড়েছি
শিশুকালে খেয়েছি ভয়াল মন্বন্তর
তারও আগে দেশ-ভাগের লেবেঞ্চুস
ঘুড়ির বদলে এখন উড়াই পানির পাইপে রকেট
কতবার রাজা এলো রাজা গেলো
তারাও আমার মৃত্যুর কাছে পরাভূত মেনেছে
তুমি ভূমি থেকে করবে উচ্ছেদ
আমি তো জন্মেছি শূন্য গর্ভ বাঙ্কারে
তুমি সূর্যকে করেছ আড়াল, বেশ
আমি অন্ধকার কক্ষে হয়েছি প্রবিষ্ট
সুপেয় পানীয় জল
বাগানের সুমিষ্ট ফল
তুমি সব নিয়েছ দখল
কেবল আমার মৃত্যুকে বাঁচাতে এসো না
কারণ আমি এখন প্রান্তে এসে গেছি
প্রণয়ের খুব কাছাকাছি
এতদিনের অতৃপ্ত বাসনা
উপেক্ষার কষ্ট
আজ দুহাতে নেবো টেনে
যার কোমল বাহুদ্বয় তোমাকেও
উজাড় করে নেবে।
৬. আমেরিকা
স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতন্ত্র শব্দত্রয়কে বস্তুত আমারা
ঘৃণা করতে শুরু করেছি; কিছুদিন আগেও যা
ছিল আমাদের প্রাণের দোসর
পবিত্র শব্দেরা একদিন আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ
করে তুলেছিল; পবিত্র বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে
আমরা একটি ধর্মগ্রন্থের কথা বলেছিলাম
আমরা শিখেছিরাম এ ফর আব্রাহাম ও আমেরিকা
জে ফর জেফারসন আর ওয়াশিংটন ঘাড়ের ওপর
তুলে ধরেছেন অন্য এক পৃথিবী
আমরা যুক্তিকে ঈশ্বর বলে ডেকেছিলাম
সংখ্যার ভয়াবহতা জেনেও আমরা তার পক্ষ নিয়েছিলাম
অথচ যার দৃশ্যত পতন ও প্রতারণা আজ
আমাদের গভীর গুহার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে
বিগত বিশ্বাস আজ আমাদের কষ্টের কারণ
যে উপত্যাকা ও জলাশয় তোমার অবদান
যাকে আমরা আশ্রয় ভেবেছিরাম
তুমি নিজেই তার সুপেয় জল দূষিত করেছ
আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি না…
৭. রবার্ট ফিস্কের প্রতিবেদন
মাত্র দুমাসের হিসেব; বড়জোর দুমাস কয়েকদিন
সব কিছুই ঘটেছে জুন ২০০৬-এর পরে, আর আমি
এ রিপোর্ট লিখছি আগস্টের মাঝামাঝি, তখন
হামাস জঙ্গিরা এক ইসরাইলি সৈন্যকে করেছিল আটক
এটা ছিল বিবিসি আর সিএনএন-এর ব্রেকিং নিউজ
তার আগের দিন ইসরাইলি সৈন্যরা এক ফিলিস্তিনি
ডাক্তারকে ধরে নিয়ে যায়-বিশ্বমিডিয়ার কাছে
এ খবরের ছিল না প্রচার যোগ্যতা
৭০ দিনের মাথায় সৈন্যরা নিয়েছে কেড়ে ১৮০ জন
ফিলিস্তিনির প্রাণ আর হামাস জঙ্গিদের রকেটে
নিহত হয়েছে এক ইসরাইলির মূল্যবান জীবন
তবু জঙ্গিদের এ কেমন বাড়াবাড়ি
৮. ঈশ্বর এখন গাজাতে
সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিন নিয়ে অনেকে অনেক কিছু লিখছেন, একজন খেদ করেছে এভাবে : ছেলে বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘বাবা ঈশ্বর কোথায় থাকেন?’ বাবার জবাব — ‘ফিলিস্তিন ছাড়া হয়তো সর্বত্র’।
বর্তমান সময়ে এমন ভাবনা হয়তো অস্বাভাবিক নয়- চোখের সামনে এতো রক্তপাত বিশ্ববাসী হয়তো আগে কম দেখেছে। আর নিস্ক্রিয় মানুষ ভাবে ঈশ্বর তাদের সব অপকর্মের সাজা নিজ হাতে তুলে নেবেন।
কিন্তু আমার মনে হয়, ঈশ্বর এখন গাজাতেই আছেন। তা নাহলে গাজার হাতে গোনা কজন মানুষ কিভাবে এতো রক্ত ও প্রতিরোধ বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারে! ঈশ্বর গাজাতে বিশ্ব মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছেন। গাজা সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে, পৃথিবীতে কোনো মুসলমান কি এখনো জীবিত আছে! আরব জাজিরা সৌদি হজ্বযাত্রী কি এখন ঘুরছে কালো পাথরে! কোথাও কি এখনো কোনো মানুষ আছে? এখনো কি বেঁচে আছে তথাকথিত মানবতার মার্কিন, সমতার চীন? শোন বিশ্ববাসী গাজায় ঈশ্বর তোমাদের পরীক্ষা নিতে চান। এখন কাবাঘরে নয়, মসজিদে নয়, ভ্যাটিকানে নয়, গজন্নাথ মন্দিরে নয়, সিনাগগ সাইল্যান্ট টাওয়ারে নয়, এখন ঈশ্বর গাজাতে আছেন, আর বাকি সব দাজ্জালের অধীন। ঈশ্বরের আজ একটিই রাজ্য– সার্বভৌম কুরশি- তার নাম গাজা উপত্যকা।