spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাতৌফিক জহুর এর কবিতা

তৌফিক জহুর এর কবিতা

মাননীয় রব

কোটি বছরের রহস্য চারপাশ, দৃশ্য- অদৃশ্যের তুমি

অদৃশ্যেই স্বপ্ন বৃক্ষের চারা রোপণ করি আমি

স্তরে স্তরে নির্মাণ এই আকাশ শুধু ‘কুন’ শব্দে সাজানো সুশোভিত কোটি-কোটি প্রদীপমালায় 

পাহাড় পেরেক হয়ে থামিয়ে দেয় পৃথিবীর দুলুনি

নরকের রক্ষীরা সদাজাগ্রত ও ভীতিকর 

স্বর্গের আমন্ত্রণপত্র ডাকবাবু নিয়ে হাজির দুয়ারে

ফিকিরে দুনিয়া ইমারত সৌন্দর্যে কাতর হৃদয় 

দৃষ্টির দেয়াল টপকে পার হয়ে যায় কত বসন্ত 

ভূমি ধ্বসে, পানির স্তর নিম্নগামী করে মেরে দিওনা

পাপকর্মীর অন্ধ সিজদাহ্ কবুল করো

অবাধ্য এ বান্দা জৌলুস সমুদ্রে সাঁতার কেটেও

চোখ ও শ্রবণের দান অস্বীকার করেনি

শ্রাবণের ঘনবৃষ্টি মোষের মতো নেমে এলে শুরু হয়

দিনেই রাতের আঁধার, বজ্রপাত আওয়াজ আতংকে

রুহ বেরিয়ে যেতে চায় দেহ থেকে

ঝড়ের তান্ডবে উড়ে যায় শতবর্ষী বৃক্ষের ছায়া

গ্রীষ্মের উষ্ণতার আলিঙ্গনে পথভোলা পথিকের

পানি শূন্যতায় বুক কাঁপে থরোথরো 

তখনো জিহবায় জিকিরে তোমারই নাম

রাত্রিতে বিক্রি হওয়া শরীর প্রভাতের আলো মেখে

কলতলায় পাপ ধুয়ে স্মরণ করে  তোমারই নাম

কবুল বলে যে মেয়েটি কুমারিত্ব নিয়ে হাজির বাসরে

সেও তোমাকেই স্মরণ করে রীতির ঝাড়বাতিতে 

একমুঠো আলোর সঙ্গে একগ্লাস সারাবান তহুরা দিও

আত্মাকে সবুজ রুমালে নিও তোমার দরবারে

যে খুশবুতে জগৎ মাতোয়ারা

সব পথের ঢাকনাগুলো খুলে খুলে দেখেছি

যেভাবে বলগওঠা ভাতের ঢাকনা খুলে দেখা হয়

লাল নীল হলুদ পথগুলো ইশারায় ডাকে পাখির ভাষায়

মায়ের চেনানো বাল্যপথেই হেঁটে যাই 

একটা অক্ষর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়

যে কিতাব বিজ্ঞানের আলো জ্বেলে পথ দেখায়

আত্মা হরদম শেখে সহীহ সাঁতার তরিকা

একটা নাম পাল্টে দেয় আমাবস্যা 

পূর্ণিমায় ভেসে ওঠে নতুন সভ্যতা 

বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ানো মুসাফির 

খুঁজে পায় সিঁড়ি, আলোর প্রাসাদে নতজানু যে জীবন 

ভোরের গোলাপি আভায় সবুজ চাদরে পৃথিবী জাগে

দুয়ারে কড়া নাড়ে রহমতের সাগর 

যাঁর পাশে একজন কবি 

দেড় হাজার বছর পর 

আমার তৃষ্ণার্ত দুটি চোখ

শিকড়ের রহস্যময় সে পথে হেঁটে যায় 

আমার প্রতি এহসান করুন সৃষ্টির প্রধান আত্মা

২৮/০৯/২০২৩, বৃহস্পতিবার,  মোহাম্মদপুর,ঢাকা

লাশ ও প্রিয়জনেষু

দুটো দারুণ বিষয় নিয়ে ভাবছি চিৎ হয়ে শুয়ে 

আজ দু’জনেই চলে যাচ্ছি নিজের ঠিকানায়

তোমার জন্য এলো সাজোয়া পালকি ও ফুল

আমার জন্য এলো খাটিয়া 

তোমাকে আনন্দ সরোবরে হলুদ জাফরানে গোসল করানো হলো

আমাকে গোসল করালো একদল এতিম মানুষ 

তোমাকে বেনারশী শাড়িতে কি আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছে 

আমি সাদা কাফন জড়িয়ে শুয়ে আছি গাছের নীচে

কি আশ্চর্য প্রিয়জেনষু!!

তোমার বাড়িতে আনন্দের সানাই বেজে চলেছে

আমার বাড়িতে সবাই চুপচাপ, কেউ কি কাঁদছে! 

তোমার বন্ধন মজবুত করতে দুটো আয়াত পাঠ করলেন মহল্লার মসজিদের ইমাম 

কি আশ্চর্য, আমার জন্যও একই ইমাম দুটো আয়াত পাঠ করলেন, তবে তা বিদায়ের

তোমাকে নিয়ে একটা কাফেলা এগিয়ে চললো

ফুলশয্যার জন্য নির্ধারিত হেরেমে

আনন্দে কেউ কেউ শিষ দিলো, বাজি পোড়ালো

আমাকে নিয়েও একটা কাফেলা এগিয়ে চললো 

গোরস্থানের পথে, যেখানে আত্মা ছাড়া দেহ ঘুমায়

ওরা আমার জন্য একটা শীতল শয্যা প্রস্তুত করেছে

একটা শীততাপ কক্ষে ফুলের বিছানায় তুমি 

একটা স্বপ্ন ও সোনালী দিনের অপেক্ষায় 

আমিও শীতল ঘরে একাকী

চারপাশে অসংখ্য পোকা মাকড়ের উল্লাস 

রুহ বেরিয়ে যাবার পর আমি উদ্বিগ্ন হাশর নিয়ে 

তুমি বলেছিলে, আমাদের দেখা হবেই, নিশ্চয়

আমি কবর থেকে দেখছি তোমায়

তোমাকে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করে সোপর্দ করা হলো

আমার হৃদয় থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে 

পঞ্চাশ বছরের জমানো শব্দেরা

আমাকেও সোপর্দ করা হলো একটা আায়াত পাঠে

” বিসমিল্লাহি ওয়ালা মিল্লাতি রাসুলুল্লাহ “…

বাঁশের উপর চাটাই তার উপর মাটি, নীচে আমি 

অন্ধকার কবর থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে 

অলৌকিক জগতের দুয়ারে

আমার সওয়াল জবাব শুরু… 

ভালো থেকো আমার অক্সিজেন…. 

ভালো থেকো আমার আকাশ.…

মালতীনগর০১

উপরে তাকালে একটা আকাশ দেখি

কখনো নীল কখনো গোলাপি 

কতটুকু দেখি ঐ আকাশ 

এই যে নীচে বয়ে যায় কৈশোরের করতোয়া

ঢেউগুলো গুণে রেখে দিয়েছি নীল পানজাবির পকেটে

যে বটগাছটা হুড়মুড় করে করতোয়ার পাড় থেকে

একদিন শিকড় ছিঁড়ে আছড়ে পড়লো জমিনে

অবাক হয়ে দেখেছি তার বিলয়

কতো পাখির বাসা সেদিন হয়েছে বিলীন

চাঁনমারী ঘাট আর লালো মাঝি হয়ে যায় 

স্মৃতির হার্ডডিস্কে লুকিয়ে থাকা সোনালী অতীত 

মহিষের ঘাস খাওয়ার সেই বালকবেলা 

বারবার ফিরে আসে স্মৃতির পালকি চেপে

করতোয়ার পাশে কদম গাছের নীচে বসে 

আজো কি বাঁশি বাজায় আমাদের পাড়ার শাজাহান 

এখনো কি সাইকেলের টায়ার চালিয়ে

কেউ চিৎকার করে বলে ‘লই নিবেন লই’ 

বড়ো শুনতে ইচ্ছে করে 

স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে

চুড়ি ফিতা লিপস্টিক বহন করা কানু কাকার 

চলমান মার্কেট ‘ লাগবে চুড়ি ফিতা দুল’ 

নিজের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে নিজেই 

নতজানু হই

আহা! মালতীনগরে কৈশোরের ঘুড়ি ওড়ানো

গোলাপি বিকেলগুলো বারবার হাতছানি দেয়।

নবুবা ৩১

একটা সন্ধ্যা এ জীবন নিয়ে যায় পশ্চিম পাড়ায় 

দেহের বিমারকে তুড়ি বাজায় মুঠো মুঠো প্রেম 

তোমার শহরে এতো আয়োজন কতো আলোড়ন

গোপন সিন্দুক খুলে দিলাম, নাও গ্রহণ করো

আমার একাকীত্ব,আনন্দ, চোখের আকুতি 

এ জীবন ‘ কুরবানে সুমা ‘….

নবুবা ৩২ 

রাত গভীর হলে পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে

চোখের তারায় জেগে থাকে মায়াবী মুখ 

ঢেউয়ের মতো বুকে আছড়ে পড়ে স্মৃতির ঝাঁপি 

রাত গভীর হলে ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলি চাঁদের আলো

জোনাকির আলোয় ছিটিয়ে দেই মুঠো মুঠো শব্দ 

একই আকাশের নীচে থেকেও শহরটা আলাদা

একটা বই মানে একটা সভ্যতা উপহার দেয়া

“দারসে সুমা দার্দ না কুলে” … নবুবা…

নবুবা৩৩ 

কাঁচের দেয়ালের ওপাশে দুঃখের কাঁথাটা ভাজ করো

অন্ধকার নদী সাঁতরে পার হই চন্দ্রগ্রহণের রাতে

আলোর দাবানল ছড়িয়েছে শিরায় শিরায় 

গোলাপের সুবাস পেয়েছে দুপুরের রোদ

সানগ্লাসের কাঁচে সভ্যতার পান্ডুলিপি 

দুপুরের সূর্যে কুচকাওয়াজ করে দরিয়ার মাছ

এককাপ কফি এবং তুমি, সবুজ পাতায়

খাগড়াছড়ির আলু টিলা গুহার মতো রহস্যময়

নবুবা ৩৪

নীল কুয়াশায় খোপা খোলা এক অপ্সরী হেঁটে যায়

যাঁর খোলাচুলে খেলা করে পৌষের হাওয়া

ঘনকালো চুলের মায়া ছুঁয়ে যায় হৃদয় 

স্বপ্নের তীব্রতায় ডেকে ওঠে ঘুঘু

ধূসর দিবসে ভোমরের আহলাদ জানে দু’টি চোখ 

আসন্ন শীতে অপেক্ষার সেতু পার হয়ে দেখা হবে 

দক্ষিণা বারান্দায় জ্যোৎস্না ডেকে আনি

কালোচুলের গভীরে তাকিয়ে থাকে জীবন

হারমোনিয়ামে দূরের জানালায় কে যেন গাইছে,

” আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন,দিল ওহি মেরা ফাসগায়ী”……

নবুবা৩৫

কাশফুলের পায়ে নূপুর বাজে

সৃষ্টির আহবানে পরিবর্তিত অভ্যাস খোঁজে একতারা

আয়নায় দাঁড়ালে বিকশিত পাগলামি 

নিয়ে যাও আমাকে লোকান্তরের দুর্গম নির্জনে

আধুনিকতার কালো ধোঁয়ামুক্ত অনাথ পৃথিবী ছেড়ে

সবুজ ঘাসের জাজিমে খুঁজি চিরসত্ত্বা

অকল্পনীয় নাচের মুদ্রায় নিঃসঙ্গ আঁধারে

সাম্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত তোমার চোখ 

মৃতদের পাড়া থেকে জীবিত মানুষ মূলত একাকী

তৌফিক জহুর নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বগুড়ায়। শিক্ষাজীবনে বাংলায় স্নাতক। সৃজনশীলতার হাতেখড়ি মূলত সাংবাদিকতা থেকে। কাজ করেছেন খণ্ডকালীন সাংবাদিক হিসাবে  দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক বাংলার বাণী,দৈনিক জনকণ্ঠ এবং সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পাক্ষিক সাদাকালো, সাপ্তাহিক রোববার, সাপ্তাহিক বৈচিত্র, মাসিক এশিয়া ডাইজেস্ট এর মতো উল্লেখযোগ্য পত্র-পত্রিকায়। আল-মাহমুদ ও অন্যান্য(২০০৪)তৌফিক জহুরের গবেষণামূলক প্রবন্ধ যা সমকালে ভীষণ আলোচিত। কবিতাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : তৃষ্ণার্ত চোখের আকুতি (২০১৬),পাখি বিক্রি কাহিনী (২০১৯), কে তোমাকে ডেকে নিয়ে যায় বারেবারে (২০২০), এ শহরে আমার কোন প্রেমিকা নেই (২০২১), নব্বই দশকের  কবি তৃষ্ণা বসাকের সাথে যৌথ কাব্যগ্রন্থ ঠান্ডা মাংস এবং আগুনের চুল্লি (২০২১)। অনুজ কবি কুশল ভৌমিক এর সঙ্গে যৌথ কাব্য গ্রন্থ শব্দের ওন্কার(২০২২)। ২০২৪ এর একুশে বইমেলায় দুটি সিরিজ কবিতার কিতাব আসছে () নবুবা () মালতীনগর। 

কবি তৌফিক জহুর ১৯৯৮ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন শিল্প সাহিত্য ও দর্শনের ছোট কাগজ উদ্যান। উদ্যান লিটলম্যাগের পরিকল্পনায় অনলাইন টেলিভিশন উদ্যানে আন্তর্জাতিক কবিতা পাঠ এর লাইভ প্রোগ্রাম করে ইতোমধ্যে তিনি নতুন এক দুয়ার উন্মোচিত করেছেন। তাঁর কবিতা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বর্তমানে তিউনিশিয়ার  বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন The Cultural Salon এ তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে Ambassador এর দায়িত্ব পালন করছেন। মেক্সিকোর বিখ্যাত কালচারাল সংগঠন UMEA এর Ambassador হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্মাননা ও পুরস্কারের মধ্যে লাভ করেছেন দৈনিক বাঙ্গালীর কণ্ঠ লেখক পুরস্কার (২০১৯) এবং কবি জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পদক(২০২০), অপরাজিত সাহিত্য পুরস্কার (২০২২),এবং  সৌমেন বসু স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার(২০২২)কোলকাতা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠন অন্কুরোদগমের ২০২২ এ ” অন্কুরোদগম সম্মাননা ২০২২” প্রাপ্ত। কোলকাতার স্বপ্নকথা সংগঠন এর পক্ষ থেকে কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য পুরস্কার প্রদান ২০২৩। এছাড়া পৃথিবীর বিশটি রাষ্ট্র থেকে কবিতার জন্য সার্টিফিকেট সম্মাননা পেয়েছেন যা বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ