আনিসুর রহমান
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নানা রকম আলোচনা চলছে। কারণ, শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপ্রপ্রচার চালিয়ে আসছিল। ইন্টেরিম সরকার গঠনের পর থেকেই বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকবার ইউনূস মোদি বৈঠকের ব্যাপারে চিঠি বা অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনো জবাব দেয়া হয়নি। ভারতের জন্য বেশ অস্বস্তির ব্যাপার ছিলো নতুন সরকারকে মেনে নেয়া। হাসিনার পতনের মধ্যে ভারতের কিছু লোক বাংলাদেশের হাইকমিশনেও হামলা করে বসে। মেডিকেল ভিসা ছাড়া যেকোনো ভিসাও বন্ধ করে দেয় ভারত।
৪ ঠা এপ্রিল ব্যাংককে ইউনূস মোদি বৈঠকের পর বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এর আগে ৩ রা এপ্রিল থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ইউনূস মোদির প্রথম দেখা হয় এবং তারা একসাথে নৈশভোজ করেন। তবে, ৪ ঠা এপ্রিলের বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত হবে কি না সেটা নিয়ে বৈঠকের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিশ্চিত ছিলো না।
ইউনূস মোদি বৈঠক শেষ হওয়ার প্রায় দেড়দিন পর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট করেন, যা দিল্লিতেও রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয়।
ওই পোস্টে শফিকুল আলম যে দাবিগুলো করেন সেগুলো ছিল এরকম :
১) বৈঠকের সময় ড: ইউনূসের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে নরেন্দ্র মোদী বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভারতের যখন দারুণ সুসম্পর্ক ছিল, “তখনও আপনার প্রতি তার অমর্যাদাকর আচরণ আমরা লক্ষ্য করেছি, কিন্তু আপনার প্রতি আমাদের সম্মান ও মর্যাদা অটুট ছিল।”
২) অধ্যাপক ইউনূস যখন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ইস্যুটি তোলেন, তখনও (নরেন্দ্র মোদীর) ‘রেসপন্স নেতিবাচক ছিল না।’
৩) বৈঠকে বেশ কয়েকবার নরেন্দ্র মোদী উল্লেখ করেন, ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে – কোনও একটি রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে নয়!
এই পোস্টের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি অতি উচ্চপদস্থ সূত্র দিল্লির কূটনৈতিক সাংবাদিকদের কাছে এর অত্যন্ত কড়া প্রতিক্রিয়া দেন।
সেটি ছিলো এরকম:
১) বাংলাদেশের বিগত সরকারের সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে যে কথা বসানো হয়েছে, তা একেবারেই ঠিক নয়।
২) (শেখ হাসিনার) প্রত্যর্পণের অনুরোধ নিয়ে প্রেস সচিবের পর্যবেক্ষণের কোনও ভিত্তিই নেই।
৩)প্রধান উপদেষ্টার তোলা নির্দিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন এগুলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করাই শ্রেয়।
৪) যে কোনও গণতন্ত্রে বৈধতার ভিত্তি যে নির্বাচন, সে কথাও উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে সেটা যে প্রধান উপদেষ্টার সুনামকেই নষ্ট করবে, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি।
ইউনূস মোদির বৈঠক নিয়ে বিশ্লেষকরা মনে করেন, “বাংলাদেশ একটু নতুন বাস্তবতায় নিজেদের তৈরি করার চেষ্টা করছে। ফলে প্রতিবেশী, বন্ধু, সহযোগী সবার সাথে নতুন করে আন্ডারস্ট্যান্ডিং দাঁড় করানোর ব্যাপারে তারা আন্তরিক। নতুন সম্ভাবনায় সহযোগীদের তারা পাশে পেতে চায়।”
বর্তমানে হাসিনা ভারতে আশ্রয়াধীন আছে। ভারত সরকারই তাকে আশ্রয় দিয়েছে। এদিকে গণহত্যাসহ নানা অপরাধের জন্য বাংলাদেশে হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে। এদিকে হাসিনা সব সময় ভারতের যেকোনো দলের সাথে তার সম্পর্ক রাখার কারণে, শেখ হাসিনার ব্যাপারে সেখানে একটা ঐক্যমত আছে। তাই, বাংলাদেশ হাসিনাকে ফেরত চাইলেও ভারত সম্ভবত তাকে ফেরত দিবে না।
বাংলাদেশ ভারত পাশাপাশি দেশ। দুটো দেশেরই একে অপরের প্রয়োজন রয়েছে। একটি দেশের সাহয্য ছাড়া অন্যদেশ চলতে পারবে না।
তবে, ভারত সবসময় চেয়েছে বাংলাদেশে তার পছন্দের সরকারকে। সে পছন্দের তালিকায় ছিলো আওয়ামী লীগ সরকার। কারণ, আওয়ামী লীগ তার স্বার্থ রক্ষা করে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল এতটা ভারতের স্বার্থ রক্ষা করার ব্যাপারে উদগ্রীব নয়।
ভারতকে বুঝতে হবে, তারা যদি বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় তাদের আধিপত্য মানসিকতা ছেড়ে যেকোনো সরকারের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার মত মানসিকতা থাকতে হবে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবশ্যই থাকবে, তবে সে সম্পর্ক হবে দুপক্ষের পারস্পরিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে, দেশ বিক্রি করে দিয়ে নয়।