| মাহমুদ নোমান |
বিশেষ ভ্রমে সহজাত উপমার সারল্যে কোনও আলগা টান কিংবা টিউন নেই; সরাসরি ঘটনার পর ঘটনার বর্ণনায় আন্তরিক বৈভবে গল্প বলার মানুষ হাইকেল হাশমী। চমৎকার দুষ্টুমি করার মাজেজা আছে উনার গল্পে। সে দুষ্টুমিই একটা ফাঁদ; পাঠককে এই ফাঁদে ফেলে নিয়ে যায় সত্যের সাহসিক ভ্রমণে। হাইকেল হাশমীকে অনেকে কবি হিসেবে চেনেন, অনেকে জানেন উর্দু ভাষার নন্দিত অনুবাদক। কবিতার কিংবা অনুবাদের আড়ালে গল্প বলার যে নিজস্ব সত্তা আছে সেটিই জানলাম এই বছর প্রকাশিত উনার প্রথম মৌলিক গল্পগ্রন্থ ‘বিভ্রমের মগ্নতা’ পাঠে; হাইকেল হাশমী অকপটে স্বীকার করেন বাংলাদেশে জন্ম বেড়ে ওঠা হলেও পারিবারিক বলয় কিংবা শিক্ষাজীবন ছিল উর্দু ও ইংরেজি ভাষার দখলে। বাংলা নিয়ে অন্যান্য লেখকের মতো যা ইচ্ছে তাই’ পরিবেশনা হাইকেল হাশমীর লেখায় দেখা যায় না। এই কারণে বুঝি হাইকেল হাশমীর অনুবাদে অতো প্যাঁচ নেই, যথার্থ মেসেজ দিতে সহায়ক। গল্পেও দেহের অতিরিক্ত চর্বির মতো আস্তরণ নেই, পুরোটাই খাসা; এমনকি ‘বিভ্রমের মগ্নতা’ গল্পগ্রন্থ পাঠশেষে জেনেছি হাইকেল হাশমী শব্দ বা ভাষার টানটান বুননে আখ্যানের বাড়াবাড়ি নেই। এটাই হাইকেল হাশমীর গল্পকে সুদৃঢ় করেছে বরঞ্চ; নিরীক্ষার নামে ঝুঁকির মধ্যে পড়েননি নাকি গল্প বলতে গিয়ে গল্পই বলতে চেয়েছেন, এই সুবাদে পাঠকের মনে হবে পাঠকের বলতে চাওয়া কথা-সব ;
হাইকেল হাশমীর ‘বিভ্রমের মগ্নতা’ প্রথম গল্পগ্রন্থে ছোটগল্প ১২টি, অণুগল্প ১০টি এবং ফ্ল্যাশ ফিকশান ৮টি সন্নিবেশিত কিন্তু সব ফর্মে তিনি গল্পই লিখেছেন এটি বলা যায়। এই ধাঁচের গল্পকার জননন্দিত হতে তেমন সময় নেয় না, পাঠকদের কাছে পৌঁছলে হয়; এই গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটি ভালোবাসার মধ্যে দোটানায় পড়ে ক্লান্তির গল্প। গল্পের নাম- ব্যর্থ চেষ্টা। গল্পের নায়ক ভালোবেসে বিয়ে করেন অথচ কিছুকাল পরে সে বউকে আর ভালো লাগছে না, এই দ্বন্দ্ব তৈরি হয় মূলত নায়কের অফিসের নাজিয়ার সাথে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে। যে বউকে ভালোবেসে এক কোটি টাকা দেনমোহর দিতে এক মুহূর্ত ভাবেনি, সেই বউকে নিজের জীবন থেকে তাড়ানোর জন্য ফন্দি আঁটে! প্রথমে কিশোর গ্যাংকে দশ লক্ষ টাকা দিয়ে ভাড়া করে অগ্রিম দেয় ৫লাখ! কিশোর গ্যাং লিডার বলে- জানালার পাশে যেন বউ শোয় কিন্তু প্রতিদিন স্বামীই জানালার পাশে ঘুমায়। পরিকল্পনা মোতাবেক সেদিন জানালার পাশে না শুয়ে আরেক পাশে আগেভাগে শুয়ে পড়ে এবং বউ এসে তাকে না জাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে যেই পানি খাওয়ার জন্য বউ আরেক রুমে যায় তখন কিশোর লিডার এসে গুলি করে চলে যায়! গুলির শব্দে বউ এসে হুশহারা স্বামীকে হাসপাতাল নেয়, সে যাত্রায় হয়তো স্বামী বেঁচে ওঠেন কিন্তু দুই সপ্তাহ পরে বাড়ি ফিরে। বউকে মারার প্লান বৃথায় যায়। এদিকে নাজিয়ার তর সয় না,একরকম চাপ দেয় ওদের সম্পর্ককে বিয়েতে রূপ দেওয়ার জন্য। নতুন করে সময় দেয় বউকে মারতে। এবার প্লান করে রোড এক্সিডেন্টে মারবে। বউকে যেই গাড়িতে ফেলবে, উল্টো বউকে বাঁচিয়ে নিজে গাড়ির তলে! এই এক্সিডেন্টে হাসপাতালে থাকতে হয় পুরো একমাস। নায়কের দুটো প্লানে বউকে মারতে গিয়ে উল্টো মৃত্যুর মুখে পতিত হয়ে ফিরে আসে নায়ক। হতাশও হয়ে যায়। এরপরও নাজিয়াকে পেতে একটা তীব্রতর আকর্ষণের জন্য আবার প্লান করে। এবার বউকে নিয়ে যায় ছুটিতে জাহাজ ভ্রমণে, তাও বর্ষার মৌসুমে। বউয়ের মনে তো কাদা নেই, রাজি হয়ে যায়। সেদিন মধ্যরাতে কেবিনে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত পার করে জাহাজের ডেক-এ যায় দুজন, আশেপাশে কেউই নাই। রেলিঙে যেই চরম মুহূর্তে যাবে তখনি ধাক্কা দিতেই বউ স্বামীকেও নিয়ে পড়ে জলে। ডুবতে ডুবতে স্বামী দেখে বউ সাঁতরায়ে কূলে চলে যাচ্ছে। স্বামী তো সাঁতারও জানে না। এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয় পরিশেষে। এই গল্পের শেষটা শুধু নয়, হাইকেল হাশমীর গল্পের শেষটা থাকে অদ্ভুত মোচড়, চমৎকার দর্শন, চিন্তার উৎকর্ষতা। ‘ব্যর্থ চেষ্টা’ গল্পের পরে পড়ি ‘ভালো মানুষ’ গল্পটি। হতদরিদ্র পরিবারের ১৫বছরের কিশোরীকে জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মহিলা দালাল এনে নারায়ণগঞ্জে বেশ্যালয়ে বিক্রি করার গল্প। সেখান থেকে একজন পুরুষ উদ্ধার করে চিকিৎসা করায় হাসপাতালে। কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থও হয়ে যায়। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে মেয়েটির কাছে মানুষটি ঘটনার বিবরণ জানতে চাইলে শেষ মুহূর্তের কথায় পুরো স্তব্ধ করে দেয়, কিছুটা এখানে উল্লেখ করি-
‘সে আমার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলো। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা তুমি নিশ্চয় ওই খারাপ লোকদেরকে প্রচণ্ড ভাবে ঘৃণা করছো?
সে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উত্তর দিল,আমার ওদের ওপর কোন রাগ নেই, তারা তো খারাপ মানুষ, তারা তো নোংরা মানুষ। আমার রাগ হচ্ছে আপনাদের মতো ভালো মানুষের ওপর, আপনারা এতোদিন কোথায় ছিলেন!’
০২.
হাইকেল হাশমীর গল্পের শেষটা আপনাকে অনেকদিন ভাবাবে। এই গল্পগ্রন্থের নাম গল্পটাই যেমন খুব সাদামাটাভাবে এগোচ্ছে, এমনকি পাঠক নিজ থেকে ‘বিভ্রমের মগ্নতা’ গল্পের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধের সবকিছু ভুলে যাওয়ার দরুন, যেই পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সেখানে হেসে উঠবেন; কিন্তু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ঘুমের ঔষধে বৃদ্ধের ঘুমের মধ্যে মারা যাওয়ায় পাঠক থমকে দাঁড়াবে। যখন লেখক বলে বৃদ্ধ মানুষটি সব ভুলে যাওয়ার মধ্যে ভুলে গেছেন কীভাবে নিশ্বাসও নিতে হয়!
সত্যি হাইকেল হাশমী জীবনের সত্য উদ্ঘাটন করতে পারেন সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে; এই গল্পগ্রন্থের অধিকাংশ গল্পই মনে রাখার মতো। ‘মর্গে প্রেম’, ‘অফিসে একদিন’, ‘শূন্য থেকে শূন্য’- এইসব গল্প বিশেষ উল্লেখের;
আগেই বলেছি এই গ্রন্থে ছোটগল্প, অণুগল্প কিংবা ফ্ল্যাশ ফিকশান যাই বলি হাইকেল হাশমী মূলত গল্পই বলেছেন। সেটি বলার জন্য কিংবা বোঝানোর জন্য পরিসর ভাগ করেছেন কেবল। অণুগল্প আর ফ্ল্যাশ ফিকশন ঠিক একেবারে হঠাৎই মোচড় দেওয়ার চমক; ‘পিতা-মাতা আর টমি’ ও ‘নীরবতার অভিশাপ’ অণুগল্প দুটি বিশেষ ভালোলাগার আবার ফ্ল্যাশ ফিকশান- এ কয়েক লাইনের গল্পে মাত করে দিয়েছেন হাইকেল হাশমী। এই গ্রন্থে ‘পলায়ন’ কিংবা ‘বাসনা’ ফ্ল্যাশ ফিকশান দুটো উল্লেখযোগ্য। আদতে হাইকেল হাশমীর কবিমনের ভাবনার এতো উর্বরতা ‘বিভ্রমের মগ্নতা’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশে নতুন রহস্য পথকে ইঙ্গিত করে…
||
বিভ্রমের মগ্নতা
হাইকেল হাশমী
সৃজন
প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান
মূল্য: ৩০০টাকা