শান্তা মারিয়া
পাখির মতো আকাশে উড়ছে মানুষের দেহ। ইসরায়েলি বোমার আঘাতে গাজা উপত্যকায় সম্প্রতি মানুষের দেহ পাখির মতো আকাশে উৎক্ষিপ্ত হতে দেখা গেছে। বিশ্ববাসী আতংক ও দুঃখ নিয়ে এই ভিডিও দেখেছে। এই দেহ হতভাগ্য ফিলিস্তিনিদের। এই দেহ বেসামরিক মানুষের। নারী ও শিশুর। এই হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা দেখে প্রতিবাদ করার জন্য আপনাকে মুসলিম হতে হবে না। মানুষ হলেই চলবে।
মনে পড়ছে অনেক আগে এইচ ওয়েলস এর বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন টাইম মেশিন অবলম্বনে নির্মিত একটি সিনেমা দেখেছিলাম। সেখানে মানুষের পরবর্তি প্রজন্ম ‘ইলোয়িদের’ কথা বলা হয়েছিল। তারা দেখতে মানুষের মতো হলেও গরু ছাগলের মতো প্রতিবাদহীন। একজন মানুষকে চোখের সামনে পানিতে ডুবে মরতে দেখেও অন্যরা নির্বিকার হয়ে ছিল। কারও কিছু আসে যাচ্ছিল না। এখন গাজা উপত্যকায় বেসামরিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যার দৃশ্য দেখেও যদি বিশ্ব মানব সম্প্রদায় চুপ করে থাকে তাহলে বলতে হবে মানুষ আর মানুষ নেই। ‘ইলোয়ি’তে পরিণত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশার জন্ম আজকে নয়। সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে এই ভূখণ্ডে মানুষ ক্রমশ নিজেদের বাড়িঘর হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এখানে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দুঃখ আর মৃত্যুর কালোহাত ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে।
প্রায় দুই হাজার বছর আগে রোমানদের হাতে ইসরায়েলি বা ইহুদি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রের বিনাশ ঘটে। তারপর থেকে সারা ইউরোপে ধীরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া ইহুদি ধর্ম ও জাতির মানুষ অনেক বৈষম্য, ঘৃণা ও বৈরিতার শিকার হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানির নেতা হিটলার হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ইহুদিদের ওপর গণহত্যা চালালে পুরো বিশ্বেই নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও করুণার জন্ম হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্র স্থাপনের প্রশ্নটি সেসময় ইউরোপ ও আমেরিকার সমর্থন পায়। মুশকিল হলো যেখানে এই ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করা হয় সেখানে তো সেভূমির আদি বসবাসকারী আরব বংশোদ্ভূত ফিলিস্তিনি জনগণ বাস করছিল। তাদের উচ্ছেদ করে কিভাবে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন করা হলো?
একটু খেয়াল করে দেখুন, ইহুদিদের ওপর যুগে যুগে জুলুম ও নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের ঘৃণা করেছে ইউরোপবাসীরা। ঘৃণ্য হলোকাস্টও করেছে জার্মান নেতা হিটলার। কিন্তু ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনের ফলে দুর্দশায় পড়েছে বা মৃত্যুর মুখে পড়েছে এশিয়াবাসী ফিলিস্তিনিরা। হলোকাস্টের শাস্তি কেন ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্তাবে এর কোন সদুত্তর আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা পায়নি। উচিত ছিল ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিটি দেশে সেদেশে জন্মগ্রহণকারী ইহুদিদের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে সহায়তা করা। ধর্মে ইহুদি হলেও যার যার দেশে জন্মগ্রহণকারী নাগরিককে (তিনি যে ধর্মেরই হোন) সেই দেশেই পূর্ণ অধিকার নিয়ে বাস করার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই উচিত কাজটি সুসভ্য ইউরোপবাসী না করে তাদের দেশ থেকে বের করে পাঠিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করার জন্য।
বর্তমানে যে ইজরায়েল রাষ্ট্র সে ভূখণ্ডে আগে থেকেই মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের অনুসারী ফিলিস্তিনিরা বাস করছিল। স্থানীয় ইহুদি, স্থানীয় খ্রিস্টান ও স্থানীয় ইসলাম অনুসারীরা হাজার হাজার বছর ধরে বেশ মিলেমিশেই ছিল। এদের মধ্যে হঠাৎ করে দলে দলে ভিনদেশী ইহুদি এসে পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই পুরো ভূখণ্ডে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় ইহুদিরাও কিন্তু এটা খুব সুনজরে দেখেনি। কিন্তু তারাও তখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে বহিরাগতদের চাপে। শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে এ ধরনের একটি চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্রর সৃষ্টি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে চিরদিনের মতো বিষাক্ত করে দেয়। বিশ্ব রাজনীতিতেও চিরকালীন অশান্তির সৃষ্টি হয়। ইজরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই এখানে ফিলিস্তিনি আদি বাসিন্দাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ চলছে। চলছে ভূমি অধিগ্রহণ। চলছে জবরদখল, জুলুম, নির্যাতন।
গাজায় সাম্প্রতিক হামলা ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে হত্যার ঘটনা বিশ্ববাসীকে নতুন করে আতংকিত করেছে।
দীর্ঘ ১৫ মাস সামরিক অভিযানের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ইসরায়েল। তারপর প্রায় দুই মাস গাজায় কম-বেশি শান্তি বজায় ছিল; কিন্তু গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রশ্নে হামাসের সঙ্গে মতানৈক্যকে কেন্দ্র করে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ফের গাজায় নির্বিচারে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় নতুন করে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ১ হাজার ৩৯১ ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও ৩ হাজার ৪৩৪ জন আহত হয়েছেন। ইসরায়েলের বর্বর এই হামলা চলতি বছরের জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে দিয়েছে।
এভাবে চলতে থাকতে ফিলিস্তিনের আর কোন অস্তিত্ব থাকবে কিনা কে জানে। ইসরায়েলের হামলায় মৃতদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি।
সম্প্রতি একটি ভিডিও সারা বিশ্বে ভাইরাল হয়েছে
সেখানে দেখা গেছে ইসরায়েলি বোমার আঘাতে আকাছে পাখির মতো উড়ছে মানুষের দেহ। পাখি নয়, ফিলিস্তিনিদের দেহ এভাবে বোমায় শূন্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দৃশ্য দেখার পর ছিটে ফোঁটা বিবেকও আছে এমন মানুষের আতংক ও আহাজারিতে ভরে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। শুধু তাই নয় প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছে অনেকে দেশের জনতা।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল তোষণ নীতির প্রতিবাদে খোদ ওয়াশিংটনেই রাজপথে বিক্ষোভ করেছে সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশও কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে এই নির্মম হামলার। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদী সমাবেশ ও বিক্ষোভ হচ্ছে। তবে এর সঙ্গে বেশ কিছু অনভিপ্রেত ঘটনারও জন্ম দিয়েছে সুযোগসন্ধানী একদল অমানুষ। তারা এই সুযোগে ভাঙচুর, লুটতরাজ চালিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এগুলো ফৌজদারি অপরাধ। এর অবশ্যই বিচার হতে হবে এবং অপরাধীদের শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সবকিছুরই একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভের নামে লুটতরাজ, ভাঙচুর চালানো হলো দেশবিরোধী কাজ। এর মাধ্যমে নিজের দেশের ভাবমূর্তি যেমন বিনষ্ট নয় তেমনি বিশ্বেও ঘৃণার বিস্তার ঘটে। এসব অপরাধীদের দ্রুত বিচার করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। মনে রাখতে হবে এরা ছিঁচকে চোর ও তস্কার। কোনভাবেই এরা প্রতিবাদী জনতার অংশ নয়।
আমরা বাংলাদেশীরা এবং বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষ অবশ্যই ফিলিস্তিন সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান চাই। কি সেই সমাধান? সমাধান হলো দ্বিরাষ্ট্র ব্যবস্থা। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র দেশ হলে তো আর সমস্যা থাকে না। যার যার দেশে সে সে দেশের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারে। চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের কথা অনেক দিন ধরেই জাতিসংঘে বলে আসছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে বারবারই চীন ও অন্যান্য দেশ দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছে। শুধু তাই নয় গাজায় মানবিক সহায়তা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপরও ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ করেছে চীন ও অন্যান্য দেশ।
কিন্তু জাতিসংঘে সবসময়ই ইসরায়েলি হামলায় মদদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সাথে রয়েছে কয়েকটি দেশ। এই মদদ প্রদান বন্ধে সেসব দেশের শান্তিকামী জনতাকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে ফিলিস্তিন সংকট শুধু মুসলমানদের সংকট নয়। এটা সারাবিশ্বের মানবজাতির সংকট। ফিলিস্তিনি নারী শিশুসহ বেসামরিক মানুষের ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ড কোন ধর্মীয় সমস্যা নয়, বরং বিশ্বমানবতার সমস্যা। যেমন হলোকাস্ট ঘৃণ্য ও নৃশংস তেমনি ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলাও ঘৃণ্য ও নৃশংস। কোনটাকেই বিন্দুমাত্র সমর্থন করার কোন রকম সুযোগ নেই। ফিলিস্তিনের উপর হামলার প্রতিবাদে শুধু মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশকে ঐক্যবদ্ধ হলে চলবে না। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে পুরো বিশ্ববাসীকে। শিশু হত্যা, বেসামরিক মানুষ হত্যা পুরো মানবজাতির ওপর হামলা ও নির্যাতন চালানোর সামিল। নিহত মানুষের কোন ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় নেই। একজন ইহুদি শিশুকে হত্যা করলেও যেমন দুঃখবোধ হয়, একজন মুসলিম শিশুকে হত্যা করলেও তেমনি দুঃখবোধ হয়। ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারি সমান রাঙা’। বেসামরিক মানুষের ওপর হত্যা, নির্যাতন চালানো এবং পুরো মানবজাতির ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালানোর মধ্যে কোন নীতিগত পার্থক্য নেই। হিটলার আর নেতানিয়াহু একই রকম পাষণ্ড। এজন্য পুরো মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
আমরা বাংলাদেশীরা অবশ্যই সারা বিশ্ববাসীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবাদ করবো। জাতিসংঘে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখবো। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। দ্বিরাষ্ট্র দ্রুত কার্যকরের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে, পুরো মানবজাতিকে একমত হতে হবে। কিন্তু ভাঙচুর ও লুটতরাজ চলবে না। মনে রাখতে হবে শান্তির শক্তি অসীম। শান্তি এবং অহিংসাই মানবজাতির চূড়ান্ত লক্ষ্য। সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিকামী জনগণকে অবশ্যই একত্র হতে হবে জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে।
সারা বিশ্ব যদি ইসরায়েলকে বয়কট করে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে হামলা বন্ধ করতে তারা বাধ্য হবে। ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার রয়েছে নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের। গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর এবং সমগ্র ভূখণ্ড প্রাচীন সভ্যতার পীঠস্থান। বিশ্বের প্রথম শহর গড়ে উঠেছিল জেরিকোতে। বিশ্বের তিনটি ধর্মের অনুসারীদের কাছেই জেরুজালেম ও এর চারপাশের সমগ্র ভূখণ্ড অত্যন্ত পবিত্র। ইব্রাহিম (আ.) বা প্রোফেট আব্রাহাম তিনটি ধর্মের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একটি নাম। এই পবিত্র ভূখণ্ডে অশান্তির আগুনকে নির্বাপিত করতেই হবে। বিশ্ব মানবজাতি তো এখনও ‘মানুষ’ রয়েছে ‘ইলোয়ি’ হয়ে যায়নি। দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের শান্তিপূর্ণ পথে দুটি পৃথক দেশ হোক। বিশ্ববিবেক জেগে উঠুক। আর নয়, হত্যাকাণ্ড। আমরা বাংলাদেশীরা সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শান্তি চাই। আমরা বিশ্বের আকাশে শান
উড্ডীন দেখতে চাই। বোমার আঘাতে নিক্ষিপ্ত মানুষের মৃতদেহ যেন দেখতে না হয়। সকল দেশে সকল মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বিরাজ করুক।