তাজ ইসলাম
সুলতানি আমলে এ অঞ্চলে ঈদের জামাতের পর ঈদ মিছিল হত।তারপর মোগল আমলে এর বিস্তৃতি ঘটে। মোগল শাসক কর্তৃক রাজধানী ঘোষিত হয় ঢাকা। তখন মোগল শাসকেরা ঈদের জামাতে যেত মিছিল সহকারে।ঈদের পরে হত আনন্দ মিছিল।এরই ধারাবাহিকতায় ঈদ মিছিল ছিল পুরাণ ঢাকার ঐতিহ্য। ঈদ মিছিল হত হাতি, ঘোড়ার গাড়িসহ। তা এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন সুলতান আমল থেকে সে মিছিল যাত্রা শুরু ধরলে বাংলা অঞ্চলে ঈদ মিছিলের বয়স হয় এক রকম।মোগল আমলকে গুরুত্ব দিলে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে ঈদ মিছিল। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয় ঈদ মিছিলের ঐতিহাসিক পরিবেশ। ৫ আগস্টের আগে বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনে মানুষ ছিল অবরুদ্ধ। ইফতার মাহফিলে নজরদারী,সভাসমাবেশে হামলা,ঈদের জামাত পরবর্তী সময়ে ভিন্ন দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আক্রমণ করার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার নজির আছে বহুত। ইমাম খতিবদের কথায় ছিল বিধিনিষেধ। আগস্টে শেখ হাসিনার পলায়নে মানুষ মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়ে স্বস্তি বোধ করে।
হাসিনার শাসনকালে ঈদ পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অংশ হিসেবে গ্রামে শহরে চালু হয় সাউন্ড বক্স সংস্কৃতি। উঠতি বয়সী ছেলে ছোকরারা ঈদের দিন,তারপর দিন খোলা ট্রাকে সাউন্ড বক্স নিয়ে অলিগলি ঘুরে বিকট আওয়াজে হিন্দি গানের সাথে চলত নোংরা ড্যান্স।
এসবের বিপরীতে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা ছিল জরুরি। কিন্ত আওয়ামী শাসন বা হাসিনা শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে এসব চিন্তা করাও ছিল কল্পনাতীত। কাজেই ৫ আগস্ট পরবর্তী ঈদে চাঁদরাত মিছিল ছিল সময়োপযোগী পদক্ষেপ। ঈদে শহর ছেড়ে নিজ নিজ জন্মস্থানে চলে যায় রাজধানীর লোকজন।আমরা যেহেতু ঢাকায় থাকছি অংশগ্রহণ করাটা প্রয়োজন মনে করলাম।
রহমান মাজিদ প্রস্তাব দিল বাসায় ইফতার করে রওয়ানা দিবে।আমি শিল্পকলার আশেপাশে ইফতার করার প্রস্তাব করলে তাই মঞ্জুর হল। আমি আমার অবস্থান থেকে যেতে যেতে শাহবাগ বা একটু সামনেই আযান হয়ে গেল। রাস্তা ফাঁকা, খুব দ্রুতই শিল্পকলায় গিয়ে পৌছলাম। গিয়ে দেখি শিল্পকলার গেটে ইতোমধ্যে প্রায় পঁচিশ ত্রিশজন ইফতারি নিয়ে বসে আছেন।শরিফ ওসমান হাদীসহ অন্যরাও ইফতার করছেন।আমি পৌছতেই আন্তরিকতার সাথে আমি আপ্যায়িত হলাম।রহমান মাজিদ,হাসনাইন ইকবাল,বোরহান মাহমুদ আগেই পৌছে ছিলেন।ইফতার করে মাগরিবের নামাজ পড়লাম নিকটস্থ মসজিদে।মিছিলের আগেই আমরা গ্রুপ ছবি উঠিয়ে নিলাম। লোকজন জড়ো হতে থাকল। পরিচিত,অপরিচিত শত শত লোক এসে হাজির হল।পৌছলেন সাংবাদিক কবি আবিদ আজম, সাংবাদিক জাহিদুর। অভিভাবকগণ নিয়ে আসলেন ছোট ছোট শিশু কিশোরদের। ৭.৩০ এর আগেই শিশু,কিশোর,নারী,পুরুষ জড়ো হলেন শিল্পকলার গেটে।মিছিল শুরুর আগে শুরু হল স্লোগান।মায়েরা,বাবারা তাদের শিশু সন্তানদের হাত দিয়ে ঈদ সেলামি দিলেন স্লোগানকারীদের হাতে।সে এক নতুন দৃশ্য, উপভোগ্য দৃশ্য। মিছিল নির্ধারিত রাস্তা প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসল গেটে।এর মধ্যেই তারাবাতির ঝমকালো আলোতে আলোকিত হয়েছিল রাজধানীর রাজপথ।পুলিশ ছিল নিরাপত্তার দায়িত্বে।বিভিন্ন চ্যানেল ও মিডিয়ার লোকেরা তাদের দায়িত্ব পালন করছিল। খুব সংক্ষিপ্ত কথায় শেষ করছি।ফিরার আগেই আবিদ আজমের হাত থেকে নিলাম বহুল আলোচিত দৈনিক আমারদেশ পত্রিকার ঈদসংখ্যা।
রাত পোহালেই ঈদ।মনস্থির করলাম ঈদ জামাত পড়ব আগারগাঁওে।
আগারগাঁও বানিজ্যমেলার মাঠে ঈদ জামাত আয়োজন সরকারের প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। ঢাকায় সাধারণত মসজিদ কেন্দ্রীক ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় ঈদগাহ ছাড়া মাঠের জামাত চোখে পড়ে না। মাঠের পরিবেশ ছিল সাজানো গোছানো।আমি আমার দুই পুত্র, রহমান মাজিদ তার শিশু পুত্র নিয়ে হাজির। পরে ফেসবুক পোস্টে দেখলাম ঢাকার বহু কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিকজন আগারগাঁওয়ে ঈদে নামাজ আদায় করেছেন। সাধারণ মুসুল্লিদেরও ছিল বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস। মুক্ত পরিবেশে,মুক্ত মাঠে ঈদ জামাত আদায় করতে পেরে তারা খুবই উল্লসিত। নামাজের আগেই আমার দুই পুত্রকে মহিষের গাড়ি,ঘোড়ার গাড়ি,ব্যান্ড পার্টি দেখাচ্ছিলাম। খতিব সাহেবও কথা বলছিলেন মন খুলে। উপদেষ্টা আসিফসহ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজন উপস্থিত ছিলেন। নামাজ শেষে ঈদ মিছিল শুরু হল। আমরা মিছিলের সাথে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত আসলাম।আপ্যায়নে ব্যবস্থা থাকলেও আমরা আর সে পর্যন্ত যাইনি। আগামীগে ক্রমশঃ ঢাকার ঈদ জামাতের প্রধান আকর্ষণ আগারগাঁও হতে যাচ্ছে। জাতীয় ঈদগাহ থেকে মিডিয়া ও জন মন আগারগাঁও কেন্দ্রীক হবে বলে আশা করা যায়। চাঁদরাতের মিছিল,ঈদের দিনের মিছিল,আগারগাঁও ঈদ জামাত ছত্রিশ জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন সংযোজন।ইতিহাসের নতুন মিছিলের শুভ যাত্রা।যারা এই মিছিলে যুক্ত হয়েছেন তারা হয়ে থাকবেন ইতিহাসের অংশ ও সাক্ষী হয়ে। এ ধারা অব্যহত থাকুক এবং ছড়িয়ে পড়ুক সারাদেশে। সংস্কৃতির নতুন সংযোজন অপসংস্কৃতি মোকাবেলার অন্যতম উপায়। সাংস্কৃতিক গতিধারা নিজেদের পক্ষে রাখার অন্যতম উপাদানও বটে। সাংস্কৃতিক সংগ্রামে এগিয়ে থাকার জন্য এমন আরও বিষয়কে যুক্ত করতে হবে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া অনুসঙ্গ ফিরিয়ে এনে জারি রাখতে হবে নিজের সময়ে।
জাতীয় জীবনে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করায় সরকার ও ইনকিলাব মঞ্চকে জনতার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।