spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধষটকগুচ্ছ : ভাবনার গভীরতায় জাগিয়ে তোলে মোহমুগ্ধতা

লিখেছেন : আবু রাইহান

ষটকগুচ্ছ : ভাবনার গভীরতায় জাগিয়ে তোলে মোহমুগ্ধতা


আবু রাইহান

বাংলা ভাষায় আশির দশকের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী কবি মজিদ মাহমুদ। কবি মজিদ মাহমুদ লেখার একটি অন্যতম প্রধান ধরন আইডিয়া নির্ভরতা। কথা বলেন পরিচিত ভঙ্গিতে। বিশেষ বাগভঙ্গি নয়, চিত্রকর বা ধ্বনিবাজনাও নয়, তাঁর কবিতার ভাববস্তুই কবিকে চিনিয়ে দেয় পাঠকের কাছে। কবি মজিদ মাহমুদ তাঁর কবিতায় মিথের বিনির্মাণ করেন। যা পাঠককে চমকিত করে এবং অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। তাই তাঁকে বলা হয় মিথ বিনির্মাণের কবি।
সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা যেভাবে অ্যাবসার্ডনেস ও অ্যাবস্ট্রাকশনে ভর দিয়ে নতুন কোনো উন্মোচনের দিকে যেতে চাইছে, সেখানে মজিদ মাহমুদের কবিতা চিন্তা ও দর্শনের সাথে লড়াই করবার জন্য পাঠককে আত্মমননের দিকে নিয়ে চলে। তাঁর কবিতায় আমাদের ঐতিহ্যগত মিথের ব্যবহারে অতীতকে সমসাময়িকতায় এবং সমসাময়িকতাকে অতীতের মূল্যায়নে লীন করে দিয়েছেন কবি মজিদ মাহমুদ। তাঁর কবিতা-ভাষায় বোধগম্য দারুণভাবে গভীর। ফলে কোনো আরোপিত টেকনিকের দ্বারস্থ হতে হয়নি তাঁকে। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় একটি স্বতঃস্ফূর্ত সংবেদনশীলতা থাকে। আরো থাকে দার্শনিক ঋদ্ধতা।
বাংলাদেশের মানুষের আটপৌড়ে মুখের ভাষাকে কবিতায় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মজিদ মাহমুদ সেই দার্শনি শুদ্ধতাকে নতুন করে যাচাই করেছেন। ভাষার সেই ব্যবহার সরল কিন্তু সিদ্ধ। সেই ভাষাকে তিনি কোনো বিশেষ ছাঁচে ফেলে পরিশীলনের চেষ্টা করেননি। এই ক্ষেত্রে তাঁর সাহস এবং পারঙ্গমতা আশির কবিতার মৌলধারার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তাঁর শক্তিই প্রমাণ করেছে, তিনি স্বতন্ত্র এবং নিজের জায়গায় মৌলিক।

কবি মজিদ মাহমুদের শেষদিকে প্রকাশিত ‘ষটকগুচ্ছ’ একটি উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলিকাতা লেটারসেস থেকে এই কবিতার বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রিয়জন প্রয়াত দুই কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত এবং মল্লিকা সেনগুপ্তকে উৎসর্গ করেছেন– ‘তোমরা থাকো অমর গাঁয়ে / হৃদয়ে অমলিন সুপ্ত / মুখরিত এখানে বায়ুর গতি / আমরা রয়েছি চুপ তো।’ কবি মজিদ মাহমুদ বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের অনুসন্ধানী হয়েও তিনি এখানে নতুন একটি শৈলীর উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি ভাবনার গভীরতায় জাগিয়ে তোলে মহোমুগ্ধতার আবেশ।

‘এই দুনিয়ার রূপ সৌরভে আনন্দ পায় মজিদ ঢের/ লোভ দেখাচ্ছে নিত্য হুজুর হুর পরীদের বেহেশতের/ এই পৃথিবীর সকল বস্তু মায়ার বাঁধন আসল নয়/ মরার পরের জগৎ জীবন অক্ষয় রয় হুজুর কয়/ জীবন বীমার দালাল বোঝায় প্রিমিয়াম নেন ভবিষ্যৎ/ সেই ভরসায় নিচ্ছে মজিদ মৃত্যুর পরে বাঁচার মত।’

ইসলামি সংস্কৃতির চিহ্ন উদ্ধারে, বিশেষত সিমেটিক সভ্যতার মিথ বিচূর্ণীভবনে কবির ঝোঁক লক্ষণীয়।

‘নৌকা নুহুর ভাষার জন্য শেষ মেরামত সম্পন্ন আসছে বন্যা খোদার গজব অসহায় নবী অবসন্ন খোঁজ নিচ্ছেন রাত্রি ও দিন ত্রস্ত ব্যস্ত সকল প্রাণ মাখলুকাতের সৃষ্টি সকল কিস্তি ভাসান বাদ না যান ক্ষুদ্র বৃহৎ কেউ নেই বাদ নিশ্চিত সব আসন ঠিক তবুও নুহুর মন ভালো নেই মজিদ যাচ্ছে অন্য দিক।’

‘জাহাজ ছাড়ার হুইশিলে শিস বাজিয়ে দিচ্ছে ইস্রাফিল নোঙর আগেই তুলছে সারেঙ ভাঙ্গা দুয়ার বন্ধ খিল বস্তুনিচয় চিন্তা বিশ্ব সম্পর্কের শরীর গিট ছিন্নভিন্ন পুরনো-জীর্ণ মান-মন্দির তীর্থ পিঠ ছুটছে সবাই উর্ধ্বশ্বাসে দিগম্বরের চিহ্নহীন পাগলা ঘন্টা বাজাও মজিদ ইপ্সিত সেই নতুন দিন।’

এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে কবি নিজের বহমান জীবনের ফেলে আসার সময় এবং চিন্তা ও চেতনাকে ধারণ করার সচেতন প্রয়াস করেছেন।

‘জন্ম আমার হয়েছিল এক নদী-বেষ্টিত বদ্বীপ ঘর/ বিহঙ্গ হয়ে চেয়েছি বাঁচতে উড়ে যেতে দূর গৃহান্তর/ নদী উপকূলে হাঁটতে চেয়েছি খাদ্য গ্রহণ একটি মাছ/ চিনতে চেয়েছি প্রতি প্রান্তর জন্মভূমির প্রতিটি গাছ/ যদিও এখানে বর্গির হানা রৌদ্র-বৃষ্টি জলোচ্ছ্বাস/ মানুষের ছিল লালসা প্রচুর তথাপি মজিদ পায় সুবাস।’ কবির জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ফেলে আসা কৈশোরের দিনগুলি। কবির রোমান্টিক মনকে স্মৃতিকাতর করে তুলছে কিশোর বেলার ব্যর্থ প্রেমের বিশুদ্ধ স্মৃতি।

‘জানতে চেয়েছ বহুদূর হতে–এখনো কি আমি আগের এই/ এখনো কি জাগি বিনিদ্র রাত মুগ্ধ তোমার প্রেমিক নত/ হাতড়ে অতীত স্মৃতির দুয়ার স্মরণ বেলায় পেলাম টের/ সত্যি আমার কেটেছে সময় সেই বালিকার জন্য ঢের/ সেসব অনেক পুরনো বন্ধু নেই ধরাধামে সেই মজিদ/ বিদায় নিয়েছে ব্যর্থ প্রেমিক এখন সে জন যাচ্ছে নিদ।’

কবির বিশ্বাসী মানবিক মন ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি দেখে ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকারীদের প্রতি তথাকথিত ধার্মিক মানুষদের অবহেলা কবিকে ব্যথিত করে। নিজেকে নিয়ে কটাক্ষের ছলে ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠতে দ্বিধা করেন না।

‘শহরে নতুন হুজুর এসেছে দাপটে প্রবল করছে বাস/ ফতোয়া দিচ্ছে উঠতে বসতে এবার মজিদ সর্বনাশ/ মসজিদে যারা যাচ্ছিল রোজ নামাজ কালাম ঈমান ঠিক/ তারাই পড়ছে রোষানলে তার কাফের ফতোয়া প্রাত্যহিক/ উল্টে দিচ্ছে পুরনো আদব বাপ-দাদাদের ধর্ম ধিক/ ভুল করেছিল অতীতে সকলে বলছে কেবল তারটা ঠিক।’

‘লোক পাঠিয়েছে পাড়ার হুজুর মসজিদে কেন গর হাজির/ জানতে চাচ্ছে দারোগা সাহেব মাথার উপর কয়টা শির/ উল্টা-পাল্টা লিখছ পদ্য বেপথে নিচ্ছ বান্দাদের/ কপালে তোমার খারাবি ভীষণ পস্তাবে পাছে কান্না ঢের/ বাঁচতে চাইলে যেতে হবে রোজ সকাল-সন্ধ্যা খোদার ঘর/ হুজুর পুলিশ প্রভুর আপন-মজিদ থাকল কেবল পর।’

কবি তাঁর এই ‘ষটকগুচ্ছ’র কবিতাগুলিতে শাশ্বত বোধের কথা বলেন, জীবনের অনিবার্য পরিণতির কথা বলেন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদে থেকে যে সমস্ত মন্ত্রী, সাংসদ, আমলা, ধ্বজাধরা কবি সাহিত্যিক ক্ষমতার দম্ভে গর্বিতভাবে চলাফেরা করেন, কবি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন অনিবার্য পরিণতির কথা।

‘ক্ষমতা গর্বে গরিয়ান তুমি দম্ভে পড়ে না মাটিতে পদ/ বায়ুর সঙ্গে ধূলি হয়ে যাবে সচিব মন্ত্রী বা সাংসদ/ দুএক কলম পদ্য লিখেই ভাবছো নিজেকে খৈয়াম শাদি/ প্রতিদিন পথে হারিয়ে যাচ্ছে এমন অনেক ভেড়ার নাদি/ অনেক বুদ্ধি অনেক অর্থ সবার উপরে আসন চাও/ আপন হাতে পারবে না নিতে শেষ বিদায়ের কাফনটাও।’

কবি নিজের জীবনের পশ্চিমে ঢলে পড়া সময়ের কাছে এসে অহরহ মৃত্যু চেতনায় জারিত হন। অনিবার্য মৃত্যুর কথা ভাবেন। তখন নিজের জীবনের সব অপ্রাপ্তিকে গুরুত্বহীন মনে হয়। তাঁর হৃদয় জেগে ওঠে বিশুদ্ধ বোধ। এই বোধ তাঁকে আরও বেশি মানবিক করে। তিনি আরো বেশি উদারমনের, সহনশীল এবং সৃষ্টিশীল মানুষ হয়ে ওঠেন।

‘চলে যেতে হবে পশ্চিম পানে সূর্য যখন বসবে পাটে/ এখন যদিও সময় খারাপ বাঘের ওষ্ঠ বিড়াল চাটে/ হয়তো তোমার অর্জন থেকে তস্কর নেয় সুনাম কেড়ে/ হয়তো তারাই গালি দিয়ে বলে মালাউন বা যবন নেড়ে/ তুমিও ভাবছ চোর সমিতির সম্পর্কের বহর দেখে/ ভুলো না মজিদ চলে যাবে তুমি বিদায় লগ্নে সবটা রেখে।’
‘প্রতিদিন তুমি এখনো মজিদ কাঁদছ তোমার ভাগ্য দোষে/ কত মানুষের সাজানো বাগান চোখের সামনে যাচ্ছে ধ্বসে/ মৃত্যুর কোলে পরম শান্তি কিংবা তাদের আপন জন/ কাল ছিল যারা পরমানন্দে আজ নেই তার গৃহের কোণ/ ঈর্ষা অনল বুকের ভেতর স্বপ্নের ঘোর প্রতিশোধের/ শকট এবার প্রস্তুত দ্বারে উঠে পড় নেই সময় ঢের।’

কবি বুঝতে পারছেন এই মায়াময় পৃথিবীতে ঘনিষ্ঠ স্বজনদের সান্নিধ্যে আনন্দময় যাপনের কাল শেষ হয়ে আসছে। গভীর রাত্রিতে ঘুম ভেঙে গেলে রাতের নির্জনতায় তাঁর চেতনায় দোলা দেয় অলৌকিক মহাজগতে অনন্ত জীবনের কথা। তখন তাঁর বিশ্বাসী মন এই বিশ্ব ব্রহ্মা-ের সৃষ্টিকর্তা সেই মহান সত্বার খোঁজে অস্থির হয়ে ওঠে।

‘কত যে রাত্রি নির্ঘুম গেছে ভেবেছি তোমায় পাব না আর/ হয়তো আমার অপূর্ণ রবে জন্ম গ্রহণে সারৎসার/ প্রথম যেদিন পড়ন্ত বেলা মেঘ করেছিল ঈশান কোণ/ একটু হাসির বিদ্যুৎ চমক অসাড় করল প্রেমিক মন/ স্বর্গের এক দেবদূত এসে কানে কানে বলে-এই তো সেই/ হারিয়ে ফেলেছ যাত্রার কালে-তার প্রেম ছাড়া মজিদ নেই।’

যাপিত জীবনে অনেক অসহনীয় যাতনা এবং অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা সত্ত্বেও কবি মজিদ মাহমুদের কাছে মায়াময় পৃথিবীর এই ধরণীতলে মানুষের সান্নিধ্যে জীবনের অফুরাণ ফল্গুধারায় স্নাত হয়ে, হৃদয় পরিচিত প্রকৃতি পরিবেশে এই বেঁচে থাকা খুবই আনন্দময়।

‘আনন্দময় জীবন-উৎস দুঃখের ভাঁজে রেখো না ভাই সাগর-গগণ মিলনের কালে তুমি বিপরীত থেকো না ভাই তোমার যখন দুঃখ-বিষাদ অন্য কোথাও ফন্তু বয় সকল প্রাণের কেন্দ্রে তোমার প্রাণ অফুরাণ প্রবাহ বয় মনটা তোমার জাগ্রত কর দুই হাতে নাও নিয়ন্ত্রণ গিরি-পর্বত আঁধার বাঁধন উপভোগ করো প্রতিটি ক্ষণ।’

এই শৈলীর কবিতা সম্পর্কে কবি নিজেই জানিয়েছিলেন- ‘এক জীবনে কত ভাবেই না জীবনের বহমান সময়কে ধরার চেষ্টা করেছি। সে সব সময় বাহ্যত সচেতন প্রয়াস না থাকলেও, মনকে রাখতে হয়েছে সোজা জাগ্রত। ভাষার শব্দগুলো যখন যেভাবে বাণীতে রূপ নিয়েছে সেভাবেই তা ধরা পড়েছে কবিতার নির্মাণে।’ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না ‘ষটকগুচ্ছ’র কবিতাগুলি নিশ্চিতভাবে কবি মজিদ মাহমুদের জীবনের অমোঘ অভিজ্ঞতা, ব্যথা, আনন্দ ও নিবিড় বিশ্বাসী অনুভবের বাক্সময় বাণীরূপ। মাহফুজামঙ্গল, বল উপাখ্যান, আপেল কাহিনির মতো ‘ষটকগুচ্ছ’ও কবিকে নতুন এক অমরতার পথে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মরুভূমি