spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যঅবেলায় ঝরে গেলো কবি-সুহৃদ মুকুল চৌধুরী

লিখেছেন : সালেম সুলেরী

অবেলায় ঝরে গেলো কবি-সুহৃদ মুকুল চৌধুরী


সালেম সুলেরী

“আমার বয়ানগুলো রেখে যাই— আজাদী অক্ষরে
পড়বে পৃথিবী জানি জ্ঞানের মক্তবে, সখ করে।’’
(শেষ নোঙরের পদাবলি)

২২ আগস্ট থেকে ২২ এপ্রিল। ১৯৫৮ খেকে ২০২৫। কবি মুকুল চৌধুরী‘র জীবনপঞ্জিকায় যবনিকাপাত। ২২টি প্রামাণ্য গ্রন্থ রেখে চিরবিদায়। ২৩ এপ্রিল ‘বিশ্ব বইদিবস।’ পৃথিবী জানলো বইপ্রেমী মানুষটি সৌভাগ্যবান। কারণ আজীবন সাহিত্য-গ্রন্থের আরাধনা করেছেন। মহাপ্রভূ তাই বইদিবসেই তুলে নিলেন মেঘাকাশ পাঠাগারে।

কিছুটা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে পরিচয়। সেই ১৯৭৯ সালে, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে’ । ‘জিবরাইলে‘র ডানা’-খ্যাত অধ্যাপক শাহেদ আলীর টেবিলে। আমি তখনও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করিনি। নাটোর নবাব সিরাজউদ্দোলাহ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। জাতীয় সাহিত্য প্রতিযোগিতায় এসেছিলাম ঢা.বি.র কার্জন হলে। প্র্ধান বিচারক ছিলেন চিন্তক এজেডএম শামসুল আলম। তিনি তখন ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে‘র মহাপরিচালক। আমার কবিতায় মুগ্ধ হয়ে নিয়ে এলেন অফিসে। ঢাকার পুরানা পল্টনের বায়তুল মোকাররমে।

অধ্যাপক শাহেদ আলী তখন ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে’র পরিচালক। ওনার কাছেই সোপর্দ করলেন আমাকে। বললেন, ওর লেখা আমার ভালো লেগেছে। গায়ক আব্বাসউদ্দিনের নিকটাত্নীয়। দেখেন, ওকে দিয়ে কিছু করানো যায় কি না।

পাঠ্যবইয়ে ‘জিবরাইলের ডানা’ মন লাগিয়ে পড়েছি। প্রিয় লেখক অধ্যাপক শাহেদ আলীর মুখোমুখি আমি। বিস্ময় আর জাদুময়তায় কিছুটা কাঁপছি। পাশেই বসে থাকা যুবক মানুষটি সাহারা দিলেন। বললেন, আমি মুকুল চৌধুরী। লেখালেখি আর খন্ডকালীন চাকরিতে আছি। তখন আরেকটি চেয়ারে ছড়ালেখক মসউদ উশ শহীদ। লেখকে-লেখকে আমাদের আড্ডাটি বেশ জমে উঠলো। অধ্যাপক শাহেদ বললেন, তুমি একটা বই লেখো্। সহজ ভাষায়, গায়ক আব্বাসউদ্দিনের ওপর। কি বলো মুকুল-মসউদ তোমরা? ও কি পারবে সেটি, এক মাসে পান্ডুলিপি চাই। কেনো যেনো দু‘জনই জোর সমর্থন দিলেন। আমার বয়েস তখন কেবল ১৭। দু‘জনই বললেন, হয়ে যাবে, আমরা আছি না।

মুকুল চৌধুরী থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়তেন, ছাত্রও পড়াতেন। ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ তখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমি ১৯৮১-এর অক্টোবরে স্থায়ীভাবে ঢাকায় এলাম। আমাদের সাহিত্য-আড্ডার আরেক তীর্থস্থান হলো এই ফাউন্ডেশন।

আশির দশকে ‘মাসিক অগ্রপথিক’, ‘সবুজ-পাতা’ বেরুলো। ভাষাসৈনিক আব্দুল গফুর ‘অগ্রপথিক’ সম্পাদক। মুকুল চৌধুরী, মসউদ-উশ শহীদ সহ-সম্পাদক। আবার শেখ তোফাজ্জল হোসেন ‘সবুজপাতা’ সম্পাদক। ‘অনুশীলনসঙ্ঘে’র প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা-গুলোতে দু‘হাতে গদ্য-পদ্য লিখতাম। সম্মানী তুলে মতিঝিলের ‘বাদশাহ হোটেলে’ আড্ডা ও ভোজ।

ভীষণ রুচিশীল ও মার্জিত স্বভাব মুকুল চৌধুরীর। সার্টিফিকেট নাম : মন্জুরুল করিম চৌধুরী। কিন্তু তিরিশের দশকের ‘পঞ্চপান্ডবে‘র আদলে সংস্কারবাদী। লেখালেখির কাজে নামের সংস্কার করেছেন। যেমন জীবনানন্দ দাশ, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমেদ, শামসুর রাহমান। অথবা আল মাহমুদ, দিলওয়ার, নির্মলেন্দু গুন, আফজাল চৌধুরী। মুকুল চৌধুরীর দাবি, নাম হতে হবে সর্বোচ্চ দুই শব্দে। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবীদের এটা মানতে হবে।

সবাই অবশ্য মুকুল চৌধুরীকে অনুসরণ করেনি। আমি সেই ঘরানার সতীর্থ বন্ধুদের কথা বলছি। যেমন কবি-গীতিকার আসাদ বিন হাফিজ, মতিউর রহমান মল্লিক। ব্যতিক্রম মহিউদিন আকবর, সোলায়মান আহসান, হাসান আলীম। মল্লিক-আসাদ অকাল প্রয়াত হওয়ায় নেমে আসে বিষাদ। লেখক-চিকিৎসক বুলবুল সারওয়ার নির্বাক হওয়ায় আড্ডাপর্বের অবসান। ২০০৫-এ মার্কিন প্রবাসী হওয়ার হারিয়েছি বন্ধুদের স্মর্ণসান্নিধ্য।

মুকুল চৌধুরীর পৈতৃকবাস সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লালবাজার। ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে’র পরিচালক পদ থেকে অবসর। রাজধানী ঢাকা থেকে শেষ জীবন পূণ্যভূমি সিলেটে। প্রয়াণের পর সেখানকার ‘মানিকপীর গোরস্তানে’ সমাধিস্ত।

“মুত্যু কি আড়াল করে কবিদের নাম?
যদি তাঁর কপাল লিখন হয়— সৃষ্টির সুনাম।
বৃষ্টিরা সরাতে পারে ধূলো-বালি, পুরানা তাবিজ,
মাটিতে প্রোথিত থাকে সৃষ্টিভ্রুণ, শস্যের যা বীজ।
বুনন বনেদী হলে ‘বৃক্ষ তার ফলে পরিচয়।’
পৃথিবী প্রাচীন হবে, তব ভবে কবিতা অক্ষয়।”
🔹 (সতত আগামী)

‘জ্বী, কথা সত্য’, মুকুল চৌধুরীর কবিতা চিরভাস্বর। দেহত্যাগ মানেই সৃষ্টিকলারও বিনাশ নয়। অর্ধডজন কাব্যগ্রন্থ যেনো পাঠকমহলে চিরজাগরুক। ১৯৯১ সালে বেরুলো প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অস্পষ্ট বন্দর।’ আমি তখন সর্বজনপ্রিয় মাগাজিন ‘সন্দ্বীপ-’এর নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৮৪-তে ছিলা্ম ‘দৈনিক জনতা’য় ফিচার-ইন-চার্জ। অনেক কবিতা ছেপেছি সেখানে, বা অন্যত্রও। ফলে প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো আমার চেনা। তারপরও মনে হলো, অনেক কাট-ছাট করেছেন। পরের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থেও একই বৈশিষ্ট্যের বহি:প্রকাশ।

মুকুল চৌধুরী তাঁর কাব্যবয়ানে কখনও লিরিকপন্থী। নিয়তিপ্রধান বিষাদেরও কাব্যকথক। মননে শুদ্ধতা আর আদর্শবাদী চিন্তক। রাজনৈতিক সচেতনতার প্রবোধক। আন্তর্জাতিকতাবাদের নীরব সাধক।

“আমি নই পীরের মাজার— একলা দাঁড়িয়ে
বোরাকে চড়িনি তবে ছুটে যাই দিগন্ত ছাড়িয়ে।
মনের ভিতরে চোখ, হাদিস-কোরানে দেখা,
আমার মানসপটে বিশ্ব— কল্যাণের রেখা।
🔹 (সতত আগামী)

একজীবনে কবিতা, প্রবন্ধ গবেষণা, শিশুসাহিত্য। লেখক হিসেবে দেশে-বিদেশে পেয়েছেন সম্মাননা। কথাশিল্পী শাহেদ আলী, কবি আফজাল চৌধুরীর জীবনীকার। ‘কবিতা সমগ্র’, ‘গ্রন্থমুগ্ধ কথামালা‘সহ সংগ্রহযোগ্য প্রকাশনা ঢের। ‘কবি ও কবিতার প্রতি রসুল (সা:)-এর অনুরাগ, উৎসাহ।’ এটির পাশাপাশি শেষ কাব্যগ্রন্থটি ‘মুত্যুর চিত্রকল্প’ অসাধারণ। অবাক করা ভুমিকা-কথন ২০২৪-এর বইটিতে। লিখেছেন এ টিই আমার শেষ কাব্যগ্রন্থ, আর নয়। একজন জাতকবিই পারেন আগাম মৃত্যুসংবাদ জানাতে।

“কোনোই আগল নেই,
খোলা থাক মৃত্যুর প্রাঙ্গন,
আসবেই মহাদূত,
মেনে নেবো আলিঙ্গন।,,
🔹 (শেষ নোঙরের পদাবলি)

২০২৫-এর ২২ এপ্রিলের প্রয়াণতিথি বাংলা সাহিত্যের অপুরণীর ক্ষতি। স্বর্গসিক্ত হোক আকাশবাড়ির দেহহীন অভিযাত্রা। 🔸

🔹এপ্রিল ২০২৫ ।।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি