spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েএকটা কালো বই মানবসভ্যতারই স্বরূপ

লিখেছেন : তৈমুর খান

একটা কালো বই মানবসভ্যতারই স্বরূপ


তৈমুর খান


বাংলা কবিতায় যে কয়েকজন ব্যতিক্রমী কবির দেখা মেলে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি গোলাম রসুল। মহাজাগতিক বিস্ময়ের কবি হিসেবেই তিনি পাঠকের কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানুষ সাধারণত পৃথিবীর নাগরিক। তার মাথার ওপরে আছে আকাশ। তার পায়ের নিচে আছে মাটি। চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা সে পৃথিবী থেকেই নিরীক্ষণ করে। কিন্তু গোলাম রসুল শুধু পৃথিবীর নাগরিক হয়েই নিজের মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পান না, তাই তিনি মহাপৃথিবীর অন্বেষণ করেন। শুধু আকাশ দেখেই তিনি তাঁর দেখাকে সংকীর্ণ করতে চান না, তাই মহাকাশের খোঁজও করেন। পৃথিবীর মাটি, সমুদ্র এবং মাথার ওপরে চন্দ্র, সূর্য তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই তিনি তাদের সমকক্ষ। তাই তাঁর সঙ্গে কারো তফাত নেই। তিনিও তাদের সঙ্গে আবর্তিত হন মহাশূন্যে। এই মহাব্যাপ্তির মহাবোধিতে অবস্থান করেই তিনি কবিতা লেখেন। তাই তাঁর কবিতার মধ্যে থাকে মহাজীবনের মহানাগরিকের মহাপরিচয়।
কবিতা রচনার এই ধারা থেকেই সম্প্রতি ‘একটা কালো বই’ (বইমেলা ২০২৫) প্রকাশিত হয়েছে। নয় ফর্মার বইটিতে কবিতার নানা বাঁকগুলিতে চিহ্নিত হয়েছে কবির সেই মহাজাগতিক বিস্ময়েরই জাগরণ। এই গ্রন্থের ‘নিঃসঙ্গ বই’ নামে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন :
“মরা গাছে ফল ধরার মতো এক মানচিত্র জুড়ে মানুষ
মারাত্মক একটি নিঃসঙ্গ বই
আমি দেখেছি একটি আয়নাকে বহু লোককে খেয়ে নিতে”
কবিতার প্রথমেই যে উপমা ব্যবহার করা হয়েছে তা মারাত্মক এই সভ্যতারই পরিচয়। মানুষের অবস্থান মরা গাছে ফল ধরার মতোই আর তার দেশ সেখানে একটি মানচিত্র মাত্র। এই নিঃসঙ্গ বই পাঠ করতে গিয়েই একটি আয়নার মানুষ খেয়ে ফেলার দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আয়না যখন মানুষ খায় তখন আমাদের আত্মভুক চেতনায় আমরা আত্মধ্বংসের স্বরূপ উদঘাটিত হতে দেখি। কেননা কবিতার পরবর্তী অংশে তারই সংযোজন রয়েছে:
“এহেন নদীর ধারে
এক শহর আত্মহত্যার প্রবণ দাঁড়িয়ে রয়েছে
আর তার মেট্রোপলিটন ভেসে যাচ্ছে জলে”
এই আত্মহত্যাপ্রবণ জীবনের সামীপ্য থেকে আমাদের সভ্যতার পালিশ রূপ মেট্রোপলিটনের ধ্বংসও অনিবার্য। সেই যুদ্ধ রিরংসার ভেতর দিয়েই সভ্যতার স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে চলেছে। কবিতার পরবর্তী অংশে তারই পরিচয় :
“হতাশা আরও এক কিংবদন্তি
তার মধ্যে এক সুদুরপ্রসারী সারমেয়র চিৎকার
জানে না কোন অক্ষাংশে তার স্বদেশ
কোন দ্রাঘিমারেখায় বিচরণ করছে তার রক্তিম অভিনন্দন”
এই সেই মহাবই যে বই এর মধ্যেই মানুষ কোথাও নেই শুধু ধ্বংসের লীলা আর কারুণ্য জেগে আছে। হতাশা আর ব্যভিচারের রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। প্রাগৈতিহাসিক চেতনার অবিরাল ধারা থেকে তার প্রবাহ আজও কবিকে সচকিত করে চলেছে। সমগ্র কাব্যজুড়ে এই প্রবাহের কখনো ছেদ পড়েনি।
‘একটা কালো বই’ নামকরণের মধ্য দিয়েই মানব সভ্যতারই স্বরূপ কবি উদ্ঘাটিত করতে চেয়েছেন। যে সভ্যতার কদর্য উল্লাস, সংকীর্ণতা, অন্ধকারাছন্নতা, শোষণ পীড়ন, যুদ্ধ, গ্রহণ, প্লাবন, হন্তারক রূপ, রাজনীতি, মার্কসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং অমানবিকীকরণ সবকিছুই উঠে এসেছে। আর এই বইই আমরা পাঠ করে চলেছি। আমাদের অন্ধকার সংস্কৃতি জগৎ, আধ্যাত্মিক জগৎ এবং সামাজিক জগৎও পাঠের তালিকায় রয়েছে। গোলাপি ফাঁদে যেখানে জড়িয়ে আছে চাঁদের সুতো, আবার চাঁদও যেখানে গৃহপালিত। আমাদের জীবনের কন্যা, যুদ্ধের কন্যা, ইতিহাসের ইতিহাস, আমাদের মুখ ও মুখোশ সব চুরি হয়ে গেছে। বিশাল সাদা জগতে আমরা বিচারের জন্য অপেক্ষা করছি। আমাদের ঈশ্বরের লেখা কোনো কবিতা আমরা খুঁজে পাইনি। এই বৈচিত্র্য ও বোহেমিয়ান, এই বিরোধ ও সম্মোহন, এই ধ্বংস ও সৃজন থেকে আমরা বেরিয়ে আসতেও পারি না।

একটা দুঃখ ও ক্লান্তির অবসাদ থেকে গোলাম রসূল নিজেকে মুক্ত করতে চান। সভ্যতার তীব্র অন্ধকারে যেমন তিনি মানব মহিমার উত্তরণ দেখতে চান, তেমনি নিজের স্বরূপকেও উন্মোচন করতে চান। যাবতীয় বিশৃঙ্খলা থেকে নিজস্ব আশ্রয় অন্বেষণ করেন। কবি দেখেন প্রতিটি মানুষই তার নিজ নিজ মৃত্যু বহন করে নিয়ে চলেছে। সে নিজেও জানে না যে সে জীবিত কিনা। র‌্যাঁবোর কাব্যদর্শনের সঙ্গে কবির যথেষ্ট মিল আছে। কবি গোলাম রসুলও স্বেচ্ছাধীন স্বতঃস্ফূর্ততার মাধ্যমে অসীম,অনন্ত ও অচেনা এক জগতের সন্ধান করেছেন। এই জগৎ পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, অনুভূতির দ্বারাও এই জগতের ঠিকানা পাওয়া সম্ভব নয়। কল্পনাও সেখানে পৌঁছাতে পারে না। এই জগতের কথা বলতে গিয়েই তিনি প্রতীকবাদের প্রতি বেশি ঝুঁকেছেন। জড়-জীব, নিসর্গ-পৃথিবী, চন্দ্র-সূর্য সমূহ সৌরজীবনে একীভূত হয়ে গেছেন। সুতরাং কবির অস্তিত্ব সৌর আলোকে উদ্ভাসিত, আবার সৌর অন্ধকারেই নিমজ্জিত, আবার মহাশূন্যেই প্রজ্ঞার্পিত হয়ে উঠেছে।

একটা কালো বই : গোলাম রসুল, উদার আকাশ প্রকাশনী, ঘটকপুকুর, বই-গোবিন্দপুর, ভাঙড়, দক্ষিণ ২৪ পরগণা-৭৪৩৫০২, কথা:৯৮৩০৯৯২৯৫০,
মূল্য ২৫০ টাকা।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. খুব ভাল লাগল কবি তৈমুর খানের এমন বিশ্লেষণ

    কবি গোলাম রসুল এর কবিতা অনেক উচ্চ স্তরের তা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে…

    “একটা কালো বই “- এটা আমিও নিজে পড়েছি, আবারো পড়ছি, তাই শ্রদ্ধেয় কবি তৈমুর খানের সাথে আমিও একমত…

    —–সুপর্ণশু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প