spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগল্প৫ টি অনুগল্প : জহির হাসান

লিখেছেন জহির হাসান

৫ টি অনুগল্প : জহির হাসান

বিস্ময় চিহ্ন

পুরানা ময়লা পোশাকের মতো একটা বাড়ি। এই বাড়িতে আমরা দুই ফ্যামিলি পরস্পর বিবিধ কলহসহ বহু দিন বছর গুজার করতেছি।

 এক ফ্যামিলি নিচ তলায়। আরেক ফ্যামিলি উপর তলায়।

 আমাদেরকে আশেপাশের লোকজন গোনায় ধরে না! তারা আমাদেরে তাদের বাসার ময়লা ছয়লার মতোই মনে করে।

 আমাদের বাড়ির সামনে একটা বড় মেহগনি গাছ। সরকারি রাস্তার পাশের এক গাছ। বাড়ির গেট পার হইলেই তারা দেখে বিশাল এক ময়লার থুপ। ঐ গাছের গোড়ায়।  আমরা ময়লার গন্ধে নাক চাপি ঘরে ঢুকি।কিন্তু ঘরে ঢোকার পর। ঐ গন্ধ নিয়া আর ভাবি না।

অন্তত ময়লার থুপ তো আর আমাদের মাথার উপর এসে মহল্লার লোকজন আপাতত ফেলতেছে না! কবে যে প্রথম আমাদের বাড়ির সামনে এই ময়লা ফেলা শুরু হইল! কে জানে! আমাদের তো মনে আসতেছে না!

বাসার সামনে কেউ যেন আর ময়লাটয়লা না ফেলে- এই নিয়া কেহই আমরা দায়িত্ব নিই না। যাচ্ছে গাড়ি যাত্রা বাড়ি কে যায় আর কে আসে কার খবর কে রাখে!

 আমরা কেবল এক ফ্যামিলির লোকজন আরেক ফ্যামিলি কি করে, দেখি না, দেখি না করতেছি!আমরা ব্যস্ত, আমদের ধান্দাটাই বা কি! মনে হয়, আমাদের সামনে মহাকাল। আমরা সবাই অনন্তকাল ধরে বাচি থাকবোনে দুনিয়ায়।

আমরা সিটি করপোরেশনের লোকদের ডাকি কিছু বলি না! ময়লার থুপ জমে। মযলার ট্রাক ময়লা  নিয়ে যায় বটে! প্রতিবেশি যারা আমাদের বাড়ির সামনে ময়লা ফেলে তাদেরে কোনোদিন নিষেধ করি না! যেন তারা যা করতেছে তা যথেষ্ট ঠিকই করতেছে।

মহল্লার কুকুরগুলাও এই ভাগাড়ে তাদের খাবারের লোভে খুজতে আসে যদি কিছু পাওয়া যায় – এই আশায়! একদিন আমাদের পরিবারের সবাই এক যোগে বাড়ির ময়লার থুপটারে স্বপ্নে দেখলাম। কারা যেন বস্তায় করে একটা কাটা  লাশ আমাদের ময়লার থুপের ভিতর

লুকায় রাখি তাড়াতাড়ি করে গা ঢাকা দিতে অন্ধকারে চলে গেল। মুখগুলো ঝাপসা। তবু আমরা  পরেরদিন সকালে কেহই এই স্বপ্নের কথা কারও সাথে শেয়ার করি না!

বিশেষ ঘটনা এই যে একদিন সকালে অফিসে যাবো বের হইলাম। গেইটটা যেন নিজের থেকে খুলে গেল! দেখি, ওমা আমাদের বাসার সামনে ময়লার থুপটা কারা যেন মাথায় নিয়া পালাই গেছে। সেইখানে এক গাদা ফুলের টব বসানো । টবের ফুলগুলি বাতাসে তাইরে নাইরে মাথা নাড়তেছে! আমাদের সমর্থন আদায় করার জন্য।

আগের ময়লা, না ফুলের টব?

কোন মারকায় ভোট দিবা ?

মহল্লায় ফুলের টব নিয়ে কেউ গবেষণা শুরু করল নাকি।

 আমাদের চোখের ভিতর কোনো বিস্ময় চিহ্নও দোল খাইতে কেউ দেখল না। অবশ্য কেহ আশে পাশেও তখন ছিল না!

সিক্রেট

এ কলোনির  মুখ চাপি ধরছে কেউ যেন। সব কথা আটকাই গেছে । গোঙাইতেছে, চিৎকার শুনা যায় না। কোনখানে যেন কেহ নাই। গরমে ১ম লেনের কালা কুত্তাটার জিব্বা ৩হাত বাইর হই পড়ছে।বোধ হয় ওর জিব্বাখান মুখের ভিতর আর ফিরাই নিতে পারতেছে না। হয়ত পানির লাগুড় পাইতে বাহির হইছে। নইলে ৩য় লেনের লাল বাঘাডা হেরে তাড়া করছে। এত গরমেও নিজের এলাকায় উপর প্রভাব  রাখতেছে হালায়!

ঐ তো দূরে আমার কাঠ গোলাপের গাছখান। কত কত ফুল ফুটছে। তাকাই আছে আকাশের দিকে মনডা উবদা করি। বেয়াক্কল, আবার ইশারায় আমারে এখনই ডাকতেছে!

ইশকুল ছুটির পর ক্লাসঘরের মতো সুনসান অসাড়। দুপারে কে আবার আমারে সাক্ষী রাখল, কার মওতের খভবর মাইকে ক্যানভাস করতেছে। ধূর, কান নাই পাতলাম!

শুধু মনে মনে কাঠগোলাপডার  ডালে এই কাঠফাডা দুপারে কাকডারে ফিরাইতে চাইতেছিলাম। সে  তো রাজি হয় না !

কার চোখ রাঙানির নিচে চাপা পড়ার আগেই এই কলোনির হগগলেই যেন ইন্দুরের মতো গরতে ঢুইকা পড়ছে!

অবশ্য এইগুলা  পুরা আমার মনের হুদাহুদি কথাবার্তা।

আসল কথা  আর কেউ জানতে পারে!

জানালার পরদা লাগাই দিলাম। বাহিরের সব কিছুই যেন আর নাই।

বিছানায় যাই।শুইলেও কী আর ঘুম আইসবো চক্ষে !

খুলনায় যাইব আজ রাতে।

আনুম, আনুম করি করি, কামালের লন্ড্রি হইতে শার্ট দুইডা আর আনা হইল কই!

তবুও

‘ওর তো পুরো গীতাঞ্জলি মুখস্থ ছিল।’

‘আহা, কতবার তার মুখে কত কবিতা শুনছি!’

 ‘আখলাক ভালো ছিল।’

নামাজ কালাম তো  পড়তই।দুনিয়াবি তারে গ্রাস করে নাই।’

তলস্তয়  উপর প্রবন্ধও আছে।ওর কবিতার বই নিয়ে দৈনিক রোববারে বিশাল রিভিউ পড়লাম, একমাসও হয়নি ’

‘ওকে তো কোনোদিন কারও সাথে হড়া-গন্ডগোল করবার দেখি নাই। ’

 ‘ক্রিকেট পাগল ছিল, গান আর সাহিত্য নিয়েই থাকত। ’

‘আমিও হেইডাই জানি।  হে যে খুনডা করছে—জানলা কেমনে?’

‘পত্রিকায় পড়লাম।’

 ‘পত্রিকারে তুমি বিশ্বাস কর?’

‘আরে, ওর তো জেল হয়ে গেছে!’

 ‘এই দ্যাশের আইনআদালতরে বিশ্বাস কর?’

‘কিন্তু…ও তো খুনটা করতেও পারে, পরিস্থিতি হয়তো বাধ্য করেছে। তবুও…’

  ‘শ্যাষ কোনো খবর জানো? ’

‘হাইকোর্টে আপিল করবে।ওর ছোটবোন আমার অফিসে চাকরি করে। জেলে  ও দেখা করেছে। নামাজ পড়ে। সাহিত্যের বই পড়েই সময় কাটছে। ’

‘খুনটা সে নিজে হাতেই করছ কি না কে জানে! ’

 ‘তাই বইলা…যেই হাতে খুনের ছুরি, হেই হাতে গীতাঞ্জলি?’

‘এর পেছনে অন্য কারও হাত আছে।ওকে নিশ্চয় এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’

 ‘ হেইডার সম্ভাবনাই বেশি।কিন্তু কেন? ’
‘ কত মানুষই তো বিনা বিচারে জেল খাটে! পুলিশকে কেনা—জাস্ট টাকা আর ক্ষমতার ব্যাপার।’

‘আগের আমলে যেই ব্যাডা দশ বছর জেলে আছিল, হেই ব্যাডাও তো ক্ষমতা বদলের লগে লগে নির্দোষী হইয়া গেল।’

‘তার মানে তো আর এই নয় যে অন্যায়কারী বিলুপ্ত হয়ে গেছে ।’

‘জিনিসখান হইল ন্যায়-অন্যায় অপরাধ লইয়া না।’
‘ভিকটিমের যাতনা বুঝতে চাই?’

‘ভিকটিম কে, আর অপরাধী কে—তার চালুনি কবে ঠিক হইব?’

‘চাইবার জানি না আমরা, ঠিকঠাক মতো।’

‘চাইলেও কি হবে? হটকারী আর দখলবাজরা থাকবেই।’

‘ইতিহাস উল্টায় কয়বার?’

‘আমরা তবুও আশাবাদী।’

‘আমরা তবু-তে আটকাই গেছি।এই তবু’র লাইগাই রাইত হয়, দিনও বিহান বেলার ভিতরে আটকাই রয় না!’

‘তবুও। ’
‘তবুও..’

ছেড়া ফুলপ্যান্ট

‘আব্বু, আমার প্যান্টটা নিয়ে আসো?’

‘আহারে বাবা, ঐটা তো সানমুনেই রাখি আসছি।’

‘আমি কি ’পরে যাবো এখন কোচিং-এ?’

‘আরেকটা আছে না?’

‘যেটার কথা বলতেছ, সেইটা তো নিয়ে গেলে। আরেকটা কলেজের সামনে ওষ্ঠা খেয়ে পড়ে ছিড়লাম। আমার প্যান্ট কয়টা জানো না!’

‘ঠিক আছে, দেখতেছি।’

সত্যিই ছেলের যে প্যান্ট দুইটাই, তা ভুলেই গেছি। হিসাবে একটা ছিড়লে তো আরেকটা থাকার কথা। ওর পরীক্ষা চলতেছে। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। ওকে আর আমি দরজির দোকানে নিই না। তাই ওর পুরোনো একটা প্যান্ট নিয়ে মাপের অর্ডার দিয়েছি। একটা পলিথিন ব্যাগে ভরে সানমুন দোকানে রেখে এসেছি। সানমুনের দর্জি বকুল ভাই। আমার বহুদিনের চেনা।

এখন মুরগি কিনতে আসছি হাতিরপুল বাজারে। ছেলের ফোন পেয়ে বকুল ভাইরে ফোন দিই সাথে সাথে।

‘ভাই, যে প্যান্টটা একটু আগে আপনার ঐখানে রাখি আসছি মাপ দেয়ার জন্য, ঐটা নেয়ার দরকার। মাপটা রাখছেন?’

‘হ, রাখছি ভাই। কাউরে পাডাই দেন।’

ছেলেরে ফোনে বলি,

‘আব্বু, এক ঘন্টার মধ্যেই নিয়ে আসতেছি।’

ফোনে শুনতেছি সাইডে ওর মাও রাগত স্বরে বকতেছে।

‘আমরা কি বড়লোক রে! সাবধানে চলতে ফিরতে পারস না! কত কষ্টে টাকা-পয়সা মৌমাছির মতো একটু একটু জমাই, আর চোখের পলকেই আচানক বিপদ আসি মওয়ালের মতো ধোয়া দিয়া মিনিটেই মধুটা টা নিয়া নেয়।’

আমার নিজেই যাইতে হবে সানমুনে প্যান্টটা ফিরত আনতে। আজকাল পোলাপানে শার্ট-প্যান্ট ছিড়লে একদম নতুন একটা লাগে। আমাদের সময় আমরা কত প্যান্ট রিপু করে পরতাম। অবশ্য এই কালে ফ্যাশন করে ছিড়া জিনস প্যান্ট পরে কত ছেলে মেয়ে! দেখলে আমারও হাসি পায়, আমার ছেলেরও হাসি পায়!

কমলালেবু
বাজারে গেলে কারা যেন আমাকে চারদিক থাইক্যা টানি ধরে। মনটা মনের বৃত্তের ভিতর কেন্দ্রে জোর করি পুতি রাখার লাগে।
পাছে সবার আগে তোর জিনিসগুলা আমি কিনতে যেন ভুলিনা যাই! আজ মনটা আরও ভালো নাই।

হয়তো তোকে কোনোদিন বলি নাই।তোরে বলে কী হবে, তুই তো এখনও বড় হোস নাই।আর বড় হইলে হয়তো তখনও বলা হই উঠবে না।
কারণ তুই বিশাল সময় ঘোড়ার পিঠে চড়বি। তোর ঘোড়াখান টগবগ ছুটতে থাকবে কতনা প্রান্তিরে সবুজদিকে।কারণ ভিতর একটা সবুজ হারা কমলালেবু জাগি রয়।তুই ও তোর ঘোড়া ছুটবে সবুজের দিকে।

এখনই তুই সবুজ রঙ দেখলে খুশি হস। ঐ তো তোর মা—তার ছেলের প্রিয় রঙ সবুজ, সবুজটিয়া আনছে আড়ং থাইকা সেদিন।
অথচ তোরই কথা তোরে কইব! তোর মনোযোগ হয়তো অন্য জরুরি কিছুতে থাকবো!

ফলের দোকানে দাঁড়াইছিলাম। বেদানা, আপেল, মালটা, তরমুজ, কলা, আঙুর, কমলালেবু … আরও আরও ফল তাকায় আছে আমার দিকে।
কারে ফেলাই, কারে কিনি।ফলগুলা যেই যেই গাছের, তারা এই ফল ছেলেমেয়েরে হারাই ফেলছে। যখনই কোনো ফল কিনি, মনে হয় কোনো ফলগাছের হারানো পুত্র রে আমি কিনি!
মজনু ভাই আমার ফলের দোকানদার। অন্যদের থাইকা ফল কিনি না। বাজারেও মানুষ তার নিজের মতোন একটা মানুষ রে খুঁজতে বাদ রাখে না!

এক হালি কমলা দেন। দুই হালি লই যান একবারে। মজনু ভাই আমার মনের কথা জানে। তাই নিলাম।

তোর জ্বর আজ দুই দিন হইল। তোর কাশি যেন লাগি থাহে বারো মাস। তবু কমলার রস আর বেদানার রস জ্বর হইলে তুই ভালোই টানিস।
অনেক পোলাপান খাওয়াইয়া খুব জ্বালায়।  তোর এই ছোট জীবনে এপর্যন্ত একবারই কাঁদছিস। আগে কান্না থাকা ভালো। কান্না সামনে থাকা খারাপ!

তোর মা ১ বছর অফিসে যায় না। সারাদিন তোর পাশে শুই রয়। তোর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায় থাকে। তোর নানি সেদিন কইলো তোর মারে,
নিজের ছেলের দিকে একটানা তাকায় থাকলে দিন আর রাত তফাৎ করবি কেমনে?

মা, আমি ওর মধ্যে আমার দিনরাতগুলা জমা রাখি।

আমাদের ঘরে একটাই শিশু । সে তো তুই।কেউ আমাদের ঘরের ভিতর না ঢুকলে বাহির হইতেছে—জানা-বুঝার কোনো উপায় নাই।
শান্ত পুকুরের জলের মতো ঢেউহীন এই ঘর।

বাবা হওয়া মানে এক পাহাড় কমলালেবু পুত্রের জন্য লাগায় রাখা। কোনোদিন সেই কমলালেবুর সংখ্যা বাবা গোনো না।

লাইনটা রাতে ডাইরিতে লিখলাম। তারপর কাটলাম। কারণ পেছনের কিছু ডাইরিই বেশি বহন করে। কমলা যেমন তার হলুদ রসরে বহন করে চলে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প