শান্তা মারিয়া
জন্মদিন মানে কি বিশেষ কিছু? প্রতিদিন লাখ লাখ শিশু জন্মায়, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করে। জন্মদিনে সবসময়ই মনে হয়, আমার তো জন্ম নাও হতে পারতো। শিশুবেলাতেই মরেও যেতে পারতাম। হাফ সেঞ্চুরি ক্রিজে টিকে থাকার পর মনে হয় আরও একটি বছর চলে গেল। আমি অবশ্য অনেক বছর বাঁচতে চাই। অন্তত শত বর্ষ। জন্মদিনে বেশি মনে পড়ে শিশুকালের কথা।
আমি বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান আমার ভাই আহমদ ইয়ুসুফ আব্বাস উদয়। আমি তার চেয়ে আট বছরের ছোট। আমার জন্ম হয় ২৪ এপ্রিল ১৯৭০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভোর সাড়ে চারটায়। ফজরের আজান পড়ছে তখন। এর মধ্যেই বাবা আমার জন্মের ঘোষণা হিসেবে আজান দিলেন। আশপাশে থাকা কয়েকজন বললো, ‘সে কি শুনলাম তো মেয়ে হয়েছে। ছেলের জন্ম হলেই শুধু আজান দিতে হয়, এটা জানেন না?’ বাবা এককথায় তাদের বললেন, ‘আমার কাছে দুই সন্তানই সমান’।
মেয়ের জন্ম হওয়ায় বাবা ও মা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। আমার ভাই একটু মন খারাপ করেছিল। কারণ তার ইচ্ছা ছিল ছোটভাই হলে তাকে বক্সিং শেখানোর। তার ধারণা ছিল আমাকে হাসপাতাল থেকে কিনে আনা হয়েছে। বারে বারে মাকে অভিযোগ জানাতো, ‘ছোটবাচ্চাই কিনে আনা হলো যদি, তাহলে একটু বড়সর ছেলে বাচ্চা আনলে ভালো হতো, মারপিট করা যেত। এত নরম নাইলনের পুতুলের মতো বোন দিয়ে কী হবে?’ তবে কিছুদিনের মধ্যে তার এই মনখারাপ কেটে গিয়েছিল। বিশেষ করে যখন ভাইয়ার পছন্দে আমার ডাকনাম রাখা হলো ভ্যালিয়া। এটা হলো তার তন্ময় হয়ে সোভিয়েত গল্পের বই পড়ার ফলাফল। মা-বাবাও প্রথম নারী নভোচারী ভ্যালেনটিনা তেরেসকোভার এই ডাকনামটি পছন্দ করলেন। বাবা সারাজীবনই আমাকে ভ্যালেনটিনা বা ভ্যালেন বলে ডাকতেন।
এরপর শুরু হলো আসল নামকরণের পালা। বাবা নাম রাখলেন ‘ঊর্মিমালা ঢেউয়ের মালা ঊষা নদীর কূলে’। মা বললেন, এত বড় নাম রাখা যাবে না। রাখলেন চন্দ্রাবতী দেবী। মা বললেন, পুরানো আমলের বাংলা সিনেমার নায়িকা মনে হচ্ছে। এরপর বাবা জিদ ধরলেন কুন্দনন্দিনী শান্তা মারিয়া নামটা রাখতেই হবে। মা বললেন, শান্তা মারিয়া তো কলম্বাসের জাহাজ। বাবা ব্যাখ্যা করলেন, কুন্দনন্দিনী হলো বঙ্কিমের বিষবৃক্ষের নায়িকা। এই নামে বাঙালি ঐতিহ্য রক্ষা হবে। আর শান্তা মারিয়া হলো আন্তর্জাতিক। শান্তা শব্দটি আর্যধারার। আর মারিয়া হলো সেমেটিক ধারার। উচ্চারণও সহজ। শান্তা মারিয়া নামটি বিশ্বের যে কোন দেশের মানুষ উচ্চারণ করতে পারবে। মা মন্তব্য করলেন, সারা বিশ্বের মানুষের আমার মেয়ের নাম ধরে ডাকাডাকির দরকারটাই বা কি? কিন্তু বাবা তখন আমার ভবিষ্যত নিয়ে অতি উচ্চাশা পোষণ করায় মায়ের আপত্তি ধোপে টিকলো না। কুন্দনন্দিনী শান্তা মারিয়া বহু বছর বহাল রইলো। আকিকাও হলো ওই নামেই। কুন্দনন্দিনী অংশটি অবশ্য বাদ পড়েছিল কয়েক বছর পরে। বাংলা উপন্যাসের সিরিয়াস পাঠক মা সেটি বাদ দিয়েছিলেন একটা কুসংস্কার থেকে। বিষবৃক্ষে কুন্দনন্দিনীকে বিষ খেয়ে মরতে হয়েছিল, সেটা মা কখনও ভুলতে পারেননি।
ছোটবেলায় জন্মদিন মানেই ছিল বিশাল আনন্দের দিন। এপ্রিলমাস এলেই দিনগোনা শুরু করতাম। জন্মদিন মানেই বেলুন ও রঙিন কাগজ দিয়ে ঘর সাজানো। খানবাহাদুর সাহেবের মেয়ে বলে আমার মায়ের মধ্যে কিছুটা সাহেবিয়ানা ছিল। তিনি আমাদের জন্মদিনে পায়েস রাঁধতেন না। বরং বার্থডে কেক ছিল অবধারিত।
তখন জন্মদিনে পোলাও কোর্মা রাঁধার রেওয়াজ ছিল না।জন্মদিনে হতো ‘টিপার্টি’। আমার ধারণা এটা ইংরেজ আমলের রীতির অবশেষ। আমাদের বন্ধুদের বা কাজিনদের জন্মদিনে একই মেন্যু।
টিপার্টিতে থাকতো চানাচুর, মিষ্টি, কলা বা কমলা, বিস্কিট, সামোসা, সিংগারা, বা নাস্তা জাতীয় খাবার। কারও কারও জন্মদিনে পরোটা ও মাংস বা শামীকাবাব দেওয়া হতো।বিকেলবেলা পার্টি শুরু হয়ে সন্ধ্যায় শেষ। গানবাজনার আয়োজনও থাকতো অধিকাংশ সময়ে। গানবাজনা মানে যে যা পারে।
জন্মদিনে আমরা উপহার পেতাম বই, খেলনা, প্রাইজবন্ড। এখন মনে হয় নিজের ও পরিবারের সকলের সুস্থতাই আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার। যতদিন বাঁচি যেন সুস্থ থাকি, কর্মক্ষম থাকি।
জন্মদিনের একটা মজার ঘটনা বলি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। একবার এক যুবক আমার প্রেমে পড়লেন।সংগত কারণেই তার নামটা বলছি না। তিনি রীতিমতো ফিলমি স্টাইলে ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসার উদ্যোগ নিলেন।
আলুবাজার মহল্লার বাড়ি।সে বাড়ির সামনে ম্যানহোল থেকে সুয়ারেজের পানি প্রায়ই উপচে পড়ে গলি ও রাস্তা সয়লাব হয়ে যেত।তার মধ্যে জলীয় ও স্থলীয় দুরকম পদার্থই ছিল।
তো সেই ফিলমি যুবক বিশাল ফুলের তোড়াসহ আমাদের বাড়ির টিনের গেট অবধি পৌছানোর আগেই পড়লেন সেই সুয়ারেজের পানিতে। তারপর সেই অবস্থায় প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকলেন। তৎক্ষণাৎ তাকে বাথরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।বাবার পায়জামা ও শার্ট পরে তিনি বাথরুম থেকে বের হলেন।ফুলগুলোও ময়লাযুক্ত হওয়ায় ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হলো। ভাগ্য ভালো কেক আনেননি। নাহলে সেটাও যেত। সেই ভদ্রলোক আরও কয়েকবার এরকম ব্যর্থ চেষ্টার পর আমার আশা ত্যাগ করেন। আজ তিনি নিশ্চয়ই ভাবেন‘ভাগ্যিস’।
এবার জন্মদিন করছি একা একা। ভীষণ মন খারাপ লাগছে। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন আমার জন্মদিন কখনও কাউকে ভুলতে দিতেন না। শাহিন রিজভিও কোনদিন ভোলেন নি।
অনেকগুলো বছর এই পৃথিবীতে পার করে দিলাম। তবে এমন আর কিই বা বয়স হয়েছে আমার? এখনও আশা রাখি হয়তো কখনও মঙ্গলগ্রহে যেতে পারবো। কিংবা নিদেনপক্ষে দক্ষিণ মেরু অথবা আমাজনের গহীন অরণ্য। নিজেই নিজেকে জানাই শুভ জন্মদিন।