কাজী জহিরুল ইসলাম
কবিতা লেখার অপরাধে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এমন ঘটনা বাংলাদেশে একবারই ঘটেছে এবং তা ঘটিয়েছেন কবি দাউদ হায়দার। দাউদ হায়দারকে নিয়ে আমাদের কবিতাবেলায়, মানে যখন আমরা আশি/নব্বইয়ের দশকে কবিতা কবিতা খেলতে শুরু করি, অনেক রহস্য ছিল, কিংবদন্তি ছিল। কথিত আছে তিনি খুব কম বয়সেই বিখ্যাত হয়ে গেছেন। এ-প্রসঙ্গে একটি গল্প প্রচলিত আছে। দাউদ হায়দার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যান তখন শিক্ষক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার নামে বাংলাদেশে একজন বিখ্যাত কবি আছেন তাঁর সম্পর্কে কিছু জানো? এটা সত্য না গুজব এই প্রশ্ন আমি দাউদ হায়দারকে করেছিলাম, যখন জার্মানির বার্লিনে ২০০০ সালের গ্রীস্মে আমি তাঁর একদিনের আতিথ্য গ্রহণ করি। দাউদ ভাই জানিয়েছিলেন এটি সত্যি ঘটনা। তবে কবি আল মাহমুদ আর দাউদ হায়দার যখন একসঙ্গে ১৯৭৪ সালে জেলে ছিলেন তখন কালো বেড়াল সংক্রান্ত ঘটনাটি তিনি ডাঁহা মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেন এবং আল মাহমুদকে মিথ্যুক বলেন। ঘটনাটি আমি মাহমুদ ভাইকে নিয়ে লেখা আড্ডার গল্পে লিখেছি, যারা সেই লেখাটি পড়েননি তাঁদের জন্য এখানে আবার লিখছি। এক সন্ধ্যায় দাউদ হায়দার জেলখানায় একটি কালো বেড়াল দেখে খুব ভয় পান, ভয়ে চিৎকার করতে করতে মাহমুদ ভাইয়ের কাছে চলে আসেন। মাহমুদ ভাই তখন তাঁকে বলেন, দাউদ তুমি সামান্য একটি বেড়ালকে ভয় পাও আর আল্লাহকে ভয় পাও না? উল্লেখ্য তখন আল মাহমুদও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, জাসদের মুখপত্র গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই তিনি আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং এক বছর জেল খাটেন।
যে কবিতাটির জন্য দাউদ হায়দারকে ধর্মীয় মৌলবাদীরা নাস্তিক আখ্যা দেয় এবং হত্যা করতে চায় তাঁর নাম ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়।’ এটি একটি দীর্ঘ কবিতা। এই কবিতায় তিনি যীশু এবং মোহাম্মদ, দুজন নবীকের গালি দেন, গালি দেন গৌতম বুদ্ধকেও। যতদূর জানি তিনি নিজেই তখন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক, ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, সংবাদের সাহিত্য পাতায় এই কবিতাটি ছাপা হয়। যদিও তিনি তিনটি ধর্মের অনুভূতিতেই আঘাত করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরাই তাঁর বিরুদ্ধে চড়াও হয়। তাঁর জীবনাবসান হতে পারে এই আশংকা থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে নিরাপত্তাজনিত কারণে গ্রেফতার করে এবং কারা-অন্তরিণ রাখে। অতি অল্প সময়ের কারবাস থেকে তাঁকে ২০ মে সন্ধ্যায় বের করে আনা হয় এবং ২১ তারিখ সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি প্লেনে তুলে কোলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই প্লেনে দাউদ হায়দার ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিলেন না। কোলকাতার অচেনা পরিবেশে তিনি লেখক এবং আমলা অন্নদাশংকর রায়কে তাঁর আশ্রয়দাতা হিসেবে পান। দীর্ঘদিন পর ১৯৮৭ সালের ২২ জুলাই প্রখ্যাত জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের সহায়তায় দাউদ হায়দার বার্লিনে পাড়ি জমান এবং রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেই থেকে তিনি জার্মানির বার্লিনেই আছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবী, শুধু যেতে পারছেন না নিজের দেশে।
২০০০ সালের আগস্ট মাসে আমি একদিন প্রিস্টিনা থেকে লাফ দিয়ে ভিয়েনার প্লেন ধরি। হাতে একটি মানচিত্র, বুকে বিশ্বজয়ের সাহস। শোনব্রুন প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে ইউরোপের রক্তের দাগ খুঁজতে খুঁজতে প্রসারিত করি যাত্রাপথ। এক সকালে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি বার্লিনের জুয়োলজি স্টেশনে। আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়ায় কবি দাউদ হায়দার স্টেশনে চলে এসেছিলেন। সারাদিন তাঁর সঙ্গে ঘুরি, চষে বেড়াই বার্লিন শহর, কখনো ইস্ট বার্লিন, কখনো ওয়েস্ট বার্লিন। ভেঙে দেওয়া বার্লিন প্রাচীরের রেখার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ি ইতিহাসের গিরিখাদে।
এখন তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, চেষ্টা করেছিলেন? জানতে চাইলে দাউদ হায়দার বলেন, এখানকার বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতাই করছে না। তিনি এ-ও জানান যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ আছে কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তিনি নিজেকে আবেগশূন্য মানুষ হিসেবে আমার কাছে উপস্থাপন করেন। বলেন, যখন মা মারা যান, তখনো আমি কাঁদিনি। দেশে যাওয়ার ইচ্ছে হয় তবে না গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। ঘরে রাজ্যের বই, তাঁর ব্রিটিশ বালিকাবন্ধু তখন নেই, লন্ডনে, আমরা জমিয়ে আড্ডা দেবার সুযোগ পাই। স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টটির বইয়ের তাকগুলোতেই আমার চোখ, ভিএস নাইপল, গুন্টার গ্রাস, মার্কেজ কত কত বিখ্যাত লেখকের বই সেখানে। নাইপলের বইটির পাতা উল্টাতেই টের পাই এই বইগুলো শুধু বিখ্যাত লেখকেরই নয়, বইগুলোও ভীষণ মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অধিকাংশ বইই লেখকের সাক্ষর করা এবং লেখকের হস্তাক্ষরে দাউদ হায়দারের নাম লেখা। তিনি খুব স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড এবং কড়া কড়া কথা বলেন। তাতে মনে হবে কারো জন্য তাঁর ভালোবাসা-টাসা নেই কিন্তু এই ধারণা একদমই ঠিক নয়। আমি যখন সন্ধ্যায় বার্লিন থেকে ট্রেন ধরি, ব্রাসেলসে যাব, তিনি নিজ হাতে চিকেন স্যান্ডুইচ বানিয়ে আমাকে প্যাকেট করে দিয়ে দেন যাতে আমি রাতে ট্রেনে খেতে পারি। অথচ সেইদিন সকালেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।
তখন আমি আলবেনিয়ান লেখক ইসমাইল কাদারে সম্পর্কে কিছু কিছু জানি এবং তাঁর কিছু লেখাও পড়েছি। তাঁর ডিটেইল বর্ণনা আমার ভালো লেগেছে, একথা দাউদ ভাইকে বলি। কাদারে আলবেনিয়ান হলেও ফ্রান্সে থাকেন, ফরাসী ভাষায়ই লেখেন, তাই মুসলমান হওয়া সত্বেও তিনি নোবেল পাবেন বলে আমার ধারণা। দাউদ ভাই বলেন, না, এবার ভিএস নাইপল পেতে পারেন। সে বছর ভিএস নাইপল পাননি, পেয়েছেন চীনে লেখক গাও জিংজিয়ান। কিন্তু এর পরের বছরই, ২০০১ সালে, ভিএস নাইপল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্ব সাহিত্য যে মোটামুটি তাঁর নখদর্পনে এটা আমার বুঝতে বাকি রইল না।
২০০২ সালে অন্নদাশংকর রায় মারা যাওয়ার পর তিনি অসাধারণ এক গদ্য-স্মৃতিকথা লেখেন ঢাকার একটি দৈনিকে। লেখাটি পড়ে আমি কেঁদেছি। তিনি যে আবেগশূন্য মানুষ নন, তা তাঁর এই রচনাটিই প্রমাণ করে। দাউদ ভাই আমাকেও আবেগ কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন। বলেন, আবেগ কোনো কাজে দেয় না। আবেগকে শূন্যে নামিয়ে আনুন। তারপর কবিতা লিখুন, দেখবেন, কবিতা অন্য রকম হয়ে উঠবে। দাউদ হায়দার সম্পর্কে তাঁর অনুজ জাহিদ হায়দার একদিন আমাকে বলেন, দাউদ স্টান্টবাজিটা ভালো জানে। কোন কথায় বাঙালি মুসলমান ক্ষেপে যাবে এবং তিনি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবেন এটা দাউদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। মাঝে মাঝে আমারও তাই মনে হয়। এই মনে হওয়াটা আরো স্পষ্ট হয় যখন তিনি সাপ্তাহিক ২০০০-এর কোনো এক বিশেষ সংখ্যায় লক্ষ্ণৌ-এর বাইজিবাড়ির সঙ্গে মক্কার কাবাঘরের তুলনা করেন। তিনি কিন্তু রোমের ভ্যাটিকান বলেননি, বা অন্য অনেক কিছুই বলা যেত, বলেননি। বলেছেন কাবাঘরের কথা। তিনি ঠিক ঠিক জানেন কোন জায়গাটায় আঘাত দিলে হৈ চৈ হবে। আমি জানি একজন মানুষ গালি দিলে কাবার পবিত্রতা নষ্ট হয় না। আল্লাহকে গালি দিলে আল্লাহর বিশালতা কমে যায় না, মোহাম্মদকে কটু কথা বললেই তাঁর চরিত্র কলঙ্কিত হয় না, কিন্তু তা সত্বেও আমি মনে করি এই কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকাই ভালো। কারণ লক্ষ কোটি মানুষ তাঁর নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে ঈশ্বরকে, ধর্মাবতারকে, ধর্মতীর্থস্থানকে। পাশাপাশি আমি এটাও মনে করি, কেউ আপত্তিকর কিছু লিখলেই তাঁকে শারীরিকভাবে আঘাত করা উচিত নয়, এমন কি তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীল একটি বাক্যও না ছুঁড়ে সে কি বলেছে বা কি লিখেছে তা ভালো করে জানা উচিত, পড়া উচিত এবং যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করা উচিত। আমি মনে করি না কোনো বই বা রচনা নিষিদ্ধ করা উচিত। যা মন্দ এবং অকল্যাণকর তাঁর সমালোচনা করে লেখা যেতে পারে। মানুষই ঠিক করুক কোনটা গ্রহণ করবে আর কোনটা বর্জন করবে। মানুষ যাতে তাঁর বিবেচনাবোধ ঠিক মত প্রয়োগ করতে পারে সেজন্য প্রতিটি মানুষকে সেইভাবে তৈরী করতে হবে, শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এটিই মানুষের প্রধান সামাজিক দায়িত্ব।
২০১৩ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কে বইমেলা হয়। আমি তখন এখানকার প্রায় কাউকেই চিনি না। বাংলা প্রকাশের হুমায়ূন কবীর ঢালী জানালেন, তিনি আসছেন, আমার লেখা ছোটোদের বই ‘ছয় ঠ্যাঙঅলা নীল সাপ’ তাঁর সাথে আসছে। আমি নিজের লেখা বইটা একটু ছুঁয়ে দেখবো বলে মেলায় যাই, খুব অল্প সময়ের জন্য। দেখি দাউদ হায়দার মেলার প্রবেশ মুখে, সিঁড়িতে, বসে তাঁর বই থেকে কবিতা পড়ছেন, একদল তরুণ – প্রবীন তাঁকে ঘিরে কবিতা শুনছেন। তারাও পৃথিবীর নানান দেশ থেক এসেছেন নিউ ইয়র্কের বই মেলায়। দৃশ্যটি আমার খুব ভালো লাগে। আমি এগিয়ে যাই, কথা বলি, কুশল বিনিময় করি। ২০১৫ বা ১৬ সালে তিনি আবারও নিউ ইয়র্কে আসেন। লেখক হাসান ফেরদৌস তাঁর বন্ধু, এলে হাসান ভাইয়ের বাড়িতেই ওঠেন। আমি তাঁকে আমার বাসায় আমন্ত্রণ জানাই। তিনি এবং হাসান ভাই আসেন। আমরা পুরো একটি সন্ধ্যা একসঙ্গে কাটাই। দাউদ ভাই জানান বার্লিনে বসেই তিনি আমার বেশ কিছু কবিতা পড়েছেন এবং তাঁর ভালো লেগেছে। সন্দেহ নেই আমি এতে আনন্দিত এবং আপ্লুত হই। তিনি একটি কবিতার নাম বলতে পারায় আমি নিশ্চিত হই, চাপাবাজি করছেন না। আমি আমার সদ্য প্রকাশিত বই থেকে বেশ কিছু কবিতা পড়ে শোনাই। আমাদের ব্যাকইয়ার্ডে বারবিকিউ করি, আমরা একসঙ্গে বিয়ারে চুমুক দেই, আমরা কবিতায় চুমুক দেই, আমরা সন্ধ্যায় নিভতে থাকা নিউ ইয়র্কের শেষ আলোটাকে আমাদের বিয়ারের গ্লাসে ঢেলে দিই।
দাউদ ভাই আর আমি নিউ ইয়র্কে দর্শনীর বিনিময়ে একটি যৌথ কবিতা সন্ধ্যা করার চেষ্টা করি। প্রস্তাবটি ছিল হাসান ফেরদৌসের। কারণ দাউদ হায়দারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এতে করে তাঁর হাতে কিছু টাকা তুলে দেওয়া যাবে। এখানকার একজন সাহিত্য সংগঠককে কথাটি জানালে তিনি দাউদ ভাইকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে সাহস পান না। এতে তাঁর সংগঠন জনপ্রিয়তা হারানোর হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমি এতে কষ্ট পাই। একজন কবিকে মানুষ ভালোবাসবে, এটিই আমার প্রত্যাশা। কবি যদি ভুল করেন, মানুষ কবিকে এমন ভালোবাসা দেবে যাতে কবি সেই ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারেন।
দাউদ হায়দারের অন্য সহোদরেরা, জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার, মাকিদ হায়দার এবং জাহিদ হায়দার, সকলেই কবি এবং লেখক। এ প্রসঙ্গে কবি শহীদ কাদরী একটি মজার জোকস বলেন। একদিন ফজল শাহাবুদ্দীন জাহিদ হায়দারকে বলেন, জাহিদ শোনো, তোমরা সব ভাইই তো কবি, তো একটা কাজ করো, সব ভাইয়ের কবিতা একসাথে করে একটা সংকলন বের করে ফেলো, এর নাম হবে ‘হায়দরি হাক’। বলেই শহীদ ভাই হাসেন। আমিও হাসি। লেখকেরা অন্য লেখকদের নিয়ে এরকম হাসি-ঠাট্টা করেই থাকেন। পাঁচ ভাইয়ের সকলেই ভালো লেখেন এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁরা সকলেই প্রতিষ্ঠিত।
যে কবিতার জন্য দাউদ হায়দারকে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছে আজ থেকে ৪৪ বছর আগে। এই লেখার সাথে আমি সেই কবিতাটি জুড়ে দিলাম। প্রত্যাশা করছি এই ৪৪ বছরে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আজ আমরা এই কবিতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারব। শুধু কবিতাটি থেকে আপত্তিকর দুটি লাইন মুছে দিলাম। সংবাদে ছাপা হওয়া কবিতাটি আমি দেখিনি। অনলাইন সার্চ করে এটি সংগ্রহ করেছি। এর সঙ্গে দুটি প্যারাগ্রাফ ইংরেজী আছে, আমি নিশ্চিত নই, মূল কবিতায় এই ইংরেজী প্যারা দুটি ছিল না পরে সংযোজিত হয়েছে। এখানে একটু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন সাদেক একদিন ইনবক্সে আমাকে বলেন, দাউদ হায়দারের কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায় কবিতাটি আমার কাছে আছে কিনা। আমি বলি, আমিও খুঁজছি, আপনি পেলে আমাকে দেবেন। তিনি পরদিন আমাকে ইনবক্সে কবিতাটি পাঠান। আরো অনেকেই বলেন যে এটি এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। পরে আমি দাউদ ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলি। তিনি বলেন না, ওটাতে অনেক ভুল আছে। সঙ্গে যে কিছু ইংরেজি, অগুলো কি মূল কবিতায় ছিল? তিনি ব্লেন না মূল কবিতায় ইংরেজী ছিল না। আমি মূল কবিতাটি চাই। তিনি বলেন, তাঁর কাছেও নেই এবং তিনি এ-ও বলেন, এটি কোথাও নেই। ইংরেজি অংশটি মুছে দিয়ে অনলাইনে পাওয়া কবিতাটিই এখানে দিয়ে দিলাম। যে দুটি লাইন নিয়ে আপত্তি উঠেছিল সেই লাইন দুটিও দিচ্ছি না।
জন্ম আমার কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়
ভেসে এসেছি তোমাদের এই তিলোত্তমা শহরে
কল্পিত ঈশ্বর আমার দোসর; পায়ে তার ঘুঙুর; হৃদয়ে মহৎ পূজো
চুনকামে মুখবয়ব চিত্রিত; আমি তার সঙ্গি,
যেতে চাই মহীরুহের ছায়াতলে, সহি নদীজলে; ভোরের পবনে।
ঈশ্বর একান্ত সঙ্গি; জ্বেলেছি ধূপ লোবানের ঘরে। তার পায়ের ঘুঙুর সে
আমাকে পরিয়ে পালালো, আমি উঠলুম আমি।
ভেতরেও সে বাহিরেও সে; আমার আমি হয়ে চলেছি আমি,
মরণের নক্ষত্র দোদুল্যমান কালো ঘণ্টার রাজধানীতে বর্শার মতো দিন।
রাত্রির অলীক নটী, অন্ধদ্বন্দ্বে নাচায় ভাই; আমার বিশ্বাস ছিল
প্রতিধ্বণী নেই, তিমিরে আমার যাত্রা; দেখা হয় আলখেল্লায়
[ লাইন মুছে দেওয়া হয়েছে -১]
[ লাইন মুছে দেওয়া হয়েছে – ২]
আমি প্রত্যেকের কাছে পাঠ নিতে চাইলুম; তোমাদের চৈতন্যে যে লীলাখেলা
তার কিছু চাই এবেলা। দেখলো ঈশ্বর দেখলো আদম।
আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আরে কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।
আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা
বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি
একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)।
এই তো সনাতন নিয়ম; ব্যতিক্রম নেই পরিবর্জিত অজাত শত্রু আমার।
প্রেম সে কি? কোথায় থাকে? কার জরায়ু থেকে নেমে আসে?
কেউ নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো?
বারবার আমি বেয়োগের চৈতন্যে বাহু রাখি। স্মৃতি আমার অকাল পাথর।
জীবে প্রেম? মানুষে মানুষে ভালবাসা? প্রেম অশ্রু আমার
ভোঁতা। এ্যরিষ্টোটল, প্লেটো, আমার চৈতন্যে; তাদের চৈতন্যই
আমার বিশ্বাস।
কীটসের কথাই ঠিক; ঈশ্বর মরেছে আমার শৈশবে,
অতএব সে আমায় ঘুঙুর পরিয়ে পালালে সে আজ নেই,
তার জারজ সন্তানেরা অলীকের চৌমাথায় বসে পাণ্ডুর প্রেমের কথা বলে।
লোক জমে, বাহবা দেয়; ঔষধ কেনে; ঘরে ফেরে; দেখি সব ফিকে।
আমি জনমে জনমে শূন্য গর্ভে ফিরে আসি।
নূপুর মিশ্রিত অধীর সঙ্গীতের বিরহের কাল বৈশাখীর শ্বাশতের করি না বন্দনা।
আমাতে উল্লাস আছে লগ্ন নেই; সার্থক বুদ্ধিতে বিষ্ণু দে আজ কবি
আমার প্রিয়; অপ্রিয় সুধীন দত্তও নয় বটে,
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এড়াতে পারেননি এ বড় দুঃখের কথা।
যুগল স্তনে যৌবন দেখা দিলে তুমি বল প্রেম স্মৃতি।
একি তোমার নিজস্ব অভিলাষ? মাঝে মাঝে রাত্রি কালে হেঁটে যাই;
কোথা যাই সঠিক জানি না।
পথ জানে না আমার গন্তব্য কোথায়; আমি তার কোন কেন্দ্রে গিয়ে
আশ্রয় নেবো। এমন মমতা দেখে খুঁজে ফেরে চরণ চিহ্ন; চরণ চিহ্ন
সহসা হারিয়ে যায়।
শোণিতে খেলা নেই নিস্ক্রিয় নিশ্চল।
আমি তোমায় খুঁজেছি; সীমান্তে আত্মদান করেছ কিনা জানি না,
মহাকাল আমার পদতলে। নিমীলিত চক্ষে আকাঙ্ক্ষার স্পষ্টতা।
পুরানে আমার বিস্ময়; কি করে অসাধ্য সাধন করা যেত?
আমার বন্ধুদের চেয়েও বুদ্ধিদীপ্ত? আপন বিশ্বাসে আমার কাটলো
মিথ্যা তাই বলি, প্রেম মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা।
সব কবিই একই ফুটবল নিয়ে ঘুরছেন গোল স্টেডিয়ামে, রেফারী নেই
হ্যান্ডবল, ফাউল ধরছেন কেউ? আমরা দর্শক কিছুই বুঝি না খেলা দেখি
আশা মিটে গেলেই ঘরে ফিরি। গোল করার কায়দাও মনে রাখি না।
কিন্তু সবাই তো চৌকস খেলোয়াড় বলটা কাটতে পারেন ভালো;
তবে কেন ঘুরছেন?
সহীসের ঘোড়ার সাথে জীবনানন্দের দেখা হোলো একদিন
মধ্যরাতে আমার সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে গেলো-
মনে তার প্রেম ছিল?
মূল্যহীন মূল্যবোধের কতটুকু বিজয়?
আমি দৃষ্টির আড়ালে উচ্চরিনাঃ বলি বিশাল জনসভায়-
তিমিরে আমাদের যাত্রা; তুমি জানো না জানো কিছুই এসে যায় না
এই উড়নচণ্ডীর, উড়নচণ্ডীরাই মহাপাগল, পাগলের কথার
দাম বিশ্বব্যাংকও জানে না।
সাবিত্রী তুমি কি বহ্নির কাছে নতজানু হবে? অমরত্ব হারাবে,
এসে আমার হাতে হাত রাখো; অমৃতের দিকে চোখ ফিরিও না
তোমায় সামনে বসিয়ে মন্থর করে এঁকে যাবো
সমস্ত শরীর চুল চিবুক।
এখন আঁকাবোকা সব শেষ
সামনে যে অন্ধকার আগামী উৎসবে আরো দ্বিগুণ হবে।
প্রতীক্ষায় লাভ নেই, আমার বক্ষে মাথা রাখো শোন আগমনী বার্তা
কালো মৃত্যুর দিন সমাগত,
তুমি শান্তির প্রেমের কথা বলো। বলেছে আদমের সন্তানেরা শান্তি কোনোদিন
আসবে না, কৌতুক নয়। অন্ধ সংসারে সেই কোরে প্রেম।
পাতালে গিয়েছ কোন দিন? কিংবা আকাশ নীলিমায়?
দেখেছ এ্যাপোলো? মন্বন্তরে সেকি যায়নি ভেসে? স্বরচিত গানে
আনন্দ পাও? ইন্দ্রপাল লক্ষ কোরেছো কোনদিন?
বিজ্ঞাপন বড় সুন্দর একদিন কৃষ্টি হবে পায়রা আসবে কার ঘরে? কোন ঘরে
তোমারই স্মরণে?
তোমার মুখে, স্তনে কিসের দাগ? ঘোমটায় কোথায় চলেছো তুমি?
পেছনে আমার ভাই; অন্ধ ছন্দে সেই কৃষ্ণ; রাধা নেই,
আমার পদপ্রান্তে নিঃসঙ্কোচে লুটাক আদমের সন্তান; ঈভের প্রেম
ফাঁদের অলীক প্রেমে আমি আলো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়
তোমাদের শ্বাশতীরে খুঁজে পাইনি। কেউ পায়না চলে গেছে,
সব চলে গেছে, চলে যায়; বুঝি তাই বলে যাই
[কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়, কবিঃ দাউদ হায়দার, প্রকাশকালঃ ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪]
হলিস উড, নিউ ইয়র্ক। ২৬ মার্চ ২০১৮।
রক্ত টগবগ করা দিনগুলোতে তিনি যে কবিতা লিখেছিলেন সেটি থেকে এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে আর সঠিক পথে পা বা বাড়াননি কেনে।
বাংলাদেশ তাকে নবীজির উপর কুৎসা রটনাকারী হিসেবেই চেনে। মূলত ইসলাম অবমাননাকারী হিসেবে তিনি চিহ্নিত হয়ে রইলেন।
মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।