তাজ ইসলাম
এই লেখাটা যখন লিখছি তার আগেই দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইউটিউবে অনুষ্ঠানের সংবাদ, ভিডিও প্রচার হয়ে গেছে। তবু মনে হয় আরও কিছু লিখতে হবে।
দৈনিকের রিপোর্টার তার দায়িত্ব পালন করেছেন, ইউটিউবার ভিডিও আপলোড করেছেন। সচেতন জনতা জেনে গেছেন কে কি বলেছেন, কে কি বক্তব্য দিয়েছেন। তারা জেনেছেন শহীদ সজলের মা, চোখ হারা কোন আহত যোদ্ধা বক্তব্য দিয়েছেন।বক্তব্য দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।
তবু মনে হয় কিছু লিখতে হবে, কিছু লেখার বাকি আছে।
আওয়ামী লীগ প্রশ্নে একজন শহীদের মা, একজন শহীদের স্ত্রী যখন মঞ্চে ওঠে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘শহীদের রক্তের কসম, এদেশে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না’।
অথবা যখন মাইক্রোফোন থেকে কাঁপা কণ্ঠে শহীদের আত্মীয়ের বাকরূদ্ধ গলা বলে ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে’। তখন মনে হয় প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমারও কিছু কথা বলার আছে।
২৫ এপ্রিল ছিল শাহবাগে “ইনকিলাব মঞ্চ” আয়োজিত ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও শাপলা, পিলখানা ও জুলাই গণহত্যার বিচার দাবীতে শহীদি সমাবেশ’।
সমাবেশে উপস্থিত ছিলাম আমিসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই ।
‘ইনকিলাব মঞ্চে’র শহীদি সমাবেশের প্রচারণা চলছিল অনেক দিন যাবৎ। দেশব্যাপী তারা প্রচারণা চালিয়েছে। বিলি করেছে হাজার হাজার হ্যান্ডবিল। আমরা পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম উপস্থিত থাকব।
‘ইনকিলাব মঞ্চে’র মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদীর সাথে এ নিয়ে সরাসরি কথাও হয়েছে।
একক সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতিতেই হাজির হয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনকে জানিয়েছিলাম।
আমি আশা করেছিলাম কোন একটা পক্ষ আহ্বান করবে আমাকে, আমাদেরকেসহ পরিচিতদের।
এই পয়েন্টে মনে হল আমাদের লোকদের একটু পরিকল্পনার অভাব থাকে। কোন একটি গ্রুপ অথবা একাধিক গ্রুপ পূর্ব যোগাযোগ করে উপস্থিত থাকতে পারে। উপস্থিত হয় বটে বিচ্ছিন্নভাবে।
সবশেষে কবি রহমান মাজিদ ও আমি যোগাযোগ রেখে একত্র হয়েছিলাম। আমি আমার বাসা থেকে রহমান মাজিদের সাথে একত্র হই মোহাম্মদপুরে। ওখান থেকে অটোরিকশায় হাজির হই দুইটার কাছাকাছি সময় শাহবাগে, তখনও শাহবাগের শূন্যস্থান জনতায় পূর্ণ হয়নি। তিনটায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা। একটু দেরীতে শুরু হল। তার আগে জনতায় টইটম্বুর অনুষ্ঠান স্থল। মিডিয়াকর্মীদের ছিল সরব উপস্থিতি। পুলিশ ছিল পর্যাপ্ত।
মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে পর্দায় দেখানো হল ডকুমেন্টারি। ১৯৪৭ থেকে ২০২৪। মাঝখানে ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগের বর্বরতার ২৮ অক্টোবর, বিশ্বজিৎ হত্যা, সবশেষে জুলাই গণহত্যার দৃশ্য। ইনকিলাব কর্মীরা নাটকের দৃশ্যে ফুটিয়ে তুলল জুলাইয়ের চিত্র।
তারা দেখাল হাসিনা ও কাদেরের পলায়ন চিত্র।
শুরু হল বক্তব্যের পালা। মঞ্চে উপস্থিত ছিল সারাদেশ থেকে আগত বহু শহীদ পরিবার। শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধারা বক্তব্য দিলেন। স্পষ্ট বলে দিলেন তারা জুলাইয়ের গণহত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এদেশে রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে। আহতরা, শহীদদের আত্মীয়রা দৃঢ়ভাবেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবী জানালেন। শহীদের মা, শহীদের বোন, শহীদের স্ত্রীর বাকরুদ্ধ বক্তব্যে শাহবাগের বাতাস ভারি হয়ে গিয়েছিল। দর্শক শ্রোতা অনেকেই অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। বক্তব্যের মাঝেই মুহুর্মুহু শ্লোগান উঠতে থাকে আওয়ামী লীগের বিচার চেয়ে, আওয়ামীলী গকে নিষিদ্ধ দাবি জানিয়ে। বক্তব্য দিয়েছেন, পিলখানার শহীদের আত্মীয়রা, শাপলার শহীদের আত্মীয়রা, জুলাইয়ের আহত যোদ্ধারা, শহীদ পরিবারসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। সবার দাবি আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধ করন। সবশেষে পেশ করা হয় ৪ দফা দাবি। এখানে আমরা পাঠকের জন্য একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট কপি করে দিলাম।
‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ ৪ দফা দাবিতে শাহবাগে ইনকিলাব মঞ্চের সমাবেশ
স্টাফ রিপোর্টার
২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
জুলাই অভ্যুত্থান, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও শাপলা চত্বরের ঘটনার বিচার এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিতে ‘শহীদি সমাবেশ’ করেছে ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল বিকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত এ সমাবেশে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। সমাবেশে বক্তারা বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দলকে নির্বাহী আদেশে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পরবর্তীতে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষিদ্ধ করার দাবি জানান তারা।
চার দফা দাবিগুলো হলো– ১. আগামী ১০০ দিনের মধ্যে জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার শুরু করতে হবে এবং আওয়ামী লীগকে নির্বাহী আদেশ, আদালতের রায় ও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। ২. শাপলা চত্বরের ঘটনার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহায়তায় একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে শহীদদের তালিকা প্রকাশ ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ৩. পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। ৪. দেশের সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিচারের বিষয়ে স্পষ্ট ধারা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সমাবেশ থেকে জানানো হয়, এ দাবিতে আগামী ১০০ দিন দেশের ৬৪ জেলায় গণসংযোগ চালানো হবে। দাবি পূরণ না হলে আগামী ৩৬শে জুলাই (৫ই আগস্ট) ‘মার্চ ফর বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে শাহবাগ থেকে সচিবালয় ঘেরাও করা হবে। এ সময় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, কিছু মহল থেকে বলা হচ্ছে যদি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না আসে তাহলে ভারত কি মনে করবে? আমরা স্পষ্ট ভাষায় আধিপত্যবাদী ভারতের দিকে আর তাকাবো না। শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে পিলখানা ও শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ভারত গণহত্যাকারী শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেয়া পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।
ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে তাদের দেশে যে সকল খুনিকে জায়গা দিয়েছে তাদের বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। যে ছাত্র-জনতা রাজপথে জীবন দিয়ে খুনি হাসিনাকে দেশ ছাড়া করেছে তাদের হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের নাম নেয়া এ অন্তর্বর্তী সরকারের মুখে মানায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন– এ প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রতিযোগিতায় নামুন। এবহ-ত কে ভয় করুন, যদি এ জেনারেশনের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের ইমোশন নিয়ে খেলার চেষ্টা করেন, তাহলে এ জেনারেশন সকল ক্ষমতা মোকাবিলা করে যে কাউকে ক্ষমতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামাতে পারে। সমাবেশে জুলাই অভ্যুত্থানে চোখ হারানো এক আহত ব্যক্তি বলেন, আমি চোখহারা জুলাই যোদ্ধা হয়ে বলতে চাই, আওয়ামী লীগের কোনো পুনর্বাসন হতে পারে না। যারা তাদের পুনর্বাসন করতে চায়, তারা যেন ভারত বা পাকিস্তানে চলে যায়। আমরা বাংলাদেশপন্থিরা নতুন দেশ গঠন করবো। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা এ বি জোবায়ের বলেন, আমাদের জুলাই এখনো শেষ হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। আমরা চাই, নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক এবং গণভোটের মাধ্যমে দলটিকে চিরতরে বিদায় করা হোক। তিনি শাপলা চত্বর ও বিডিআর হত্যাকাণ্ডসহ সব ঘটনার দ্রুত বিচার এবং জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবিও জানান।
তিনি আরও বলেন, কেউ কেউ আজ টাকার পাহাড় গড়েছে, অথচ আমরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। কেউ আমাদের আশা বিক্রি করতে পারবে না। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সেক্রেটারি শেখ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা আশা করিনি ২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে আমাদের সভা করতে হবে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে, তাদের পুনর্বাসনের আগে আমাদের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলবে। শহীদ সাইমের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে কী অপরাধ করেছিল যে যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল? ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যেন আর কখনো এ দেশে রাজনীতি করতে না পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন– পুসাবের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ জাকারিয়া, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আব্দুল ওয়াহেদ, শহীদ সজলের মা, শহীদ সাইমের পরিবারের সদস্যসহ আরও অনেকে। তারা সবাই একইসঙ্গে আহত ও শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের দাবি জানান।’
শাহবাগের অনুষ্ঠান শেষ করে সম্মিলিত জনতা রাজপথে নেমে আসে মিছিল নিয়ে। বিশাল মিছিলের স্লোগানে কেঁপে ওঠে রাজপথ।
তার আগেই পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে,তাদের কাছে সংবাদ এসেছে নিষিদ্ধ লীগের হুমকি আছে ইনকিলাব মঞ্চে হামলার। উপস্থিত জনতা কুখ্যাত আওয়ামীলীগকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েই মিছিলে নামে। রাজপথে তখন আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের স্লোগান, আওয়ামী লীগের বিচারের স্লোগান। মিছিল বাংলামোটর এসে থামে। ওখানে আবার বক্তব্য হয়। সমগ্র মিছিলের সম্মুখে ‘ইনকিলাব মঞ্চে’র মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদীর নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। মিছিলে চলতে চলতেই দেখা হয় কবি আফসার নিজাম, কবি হাসনাইন ইকবাল, কবি নোমান সাদিক, কবি লোকমান হোসেন জীবন, কবি বোরহান মাহমুদ, কবি শাহাবুদ্দিন শিহাব, নাট্যকার হুসনি মোবারক, কবি সীমান্ত আকরামসহ অনেকের সাথে। বাংলামোটর থেকে আমি চলে আসি বাসায়। তখনও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল একেকজন শহীদ পরিবারের কান্না। বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল একজন শহীদ মাতার একটি কথা, ‘ শহীদের রক্তের কসম, আমার শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে এই আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে দিব না। শহীদের রক্তে লেখা হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ। ‘
নিষিদ্ধের দাবি জানান পিলখানার শহীদ পরিবার, শাপলার শহীদ পরিবারের সদস্যরা। আওয়ামী লীগের বিচার আর নিষিদ্ধ দাবিই ছিল সবার চাওয়া। সরকারের কাছে ইনকিলাব মঞ্চ পৌছে দেন এই দাবি ও আল্টিমেটাম।