spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যঅন্তরে যাদের বিদ্বেষ বিষ

লিখেছেন : তৈমুর খান

অন্তরে যাদের বিদ্বেষ বিষ

তৈমুর খান 

কাশ্মীরের পহেলগাঁও ঘটনায় ২৭ জন নিরপরাধ হিন্দু ধর্মের মানুষের মৃত্যু খুব দুঃখের। সব শ্রেণির মানুষই এই মৃত্যুর জন্য কাতর হয়ে পড়েছে এটা বলাই বাহুল্য। এই মৃত্যুর জন্য চূড়ান্তভাবে আমরাও ব্যথিত ও তীব্র শোকাহত হয়েছি। খবর পাওয়ার  সঙ্গে সঙ্গেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক জ্ঞাপন করে এবং অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে একটা পোস্ট করেছিলাম এর বাইরে আর বেশি কিছু করার সামর্থ্য নেই আমাদের। এরকম একটা পজিটিভ পোস্ট করার প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যেই যেসব মন্তব্য আসতে থাকে এবং রিপোর্ট করতে থাকে তাতে হতাশ ও বিপন্ন বোধ করি। কয়েকটি মন্তব্য ছিল এরকম:

১)এসব লোক দেখানো শোক প্রকাশ। যাদের রক্তমজ্জায় সন্ত্রাস মিশে আছে তাদের মুখে এসব কথা সাজে না।

২) আপনারাই টেররিস্ট এর প্রশ্রয়দাতা। আপনাদের কোরানেই উল্লেখ আছে সূরা তাওবার ৫ নং আয়াতে বিধর্মীদের খতম করার কথা।

৩) ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে এখনো কেন পাকিস্তান যাননি? আমাদের শান্তিতে থাকতে দিন পাকিস্তান চলে যান। সেটাই আপনাদের দেশ।

৪) যতদিন এই মুসলমানরা এদেশে থাকবে ততদিন সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। এসব পোস্ট লেখার কোনো মানে হয়?

৫) কবিতা না লিখে বোমাবাঁধা শিখুন। ঢিল ছোঁড়া  শিখুন। মুর্শিদাবাদে শুরু করেছেন এবার সারা বাংলাকে অশান্ত করবেন।

৬) ফিলিস্তিন আর গাজার মতোই আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে শেষ পরিণতি।

 এইসব মন্তব্যের ভিড়ে পোস্টের রিপোর্টও বাড়তে থাকে এবং অবশেষে পোস্টটি ডিলিট করতে বাধ্য হই তা না হলে আমার ফেসবুক আইডি বন্ধ হয়ে যেত। আমার বন্ধুত্বের তালিকায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে এবং বন্ধুত্বের তালিকায় না থাকার মধ্যে থেকেও এরকম মন্তব্য আসতে শুরু করে। অন্তরে কতটা বিষ থাকলে, কতটা হিংস্রতা থাকলে তবেই এরকম ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রসূত কথাবার্তা বলা যায় তা ভাবছিলাম। তারপর একে একে তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে থাকি। 

 দীর্ঘদিন সাহিত্য নিয়েই বিশেষ করে কবিতা, প্রবন্ধ ও সমালোচনা নিয়েই জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছি। তরুণ কবিদের কবিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, পরামর্শ এবং সৌজন্য ও ভালোবাসার খামতি রাখিনি। খোলা মনে তাদের পাঠপ্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি তৈরি করার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছি। প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারেও জানিয়েছি। সাহিত্য সৃষ্টির আবেগ এবং মনন ক্রিয়ায় প্রায় সমবর্তী হয়ে উঠেছি। কিন্তু এরকম একটি ঘটনা, অর্থাৎ পহেল গাঁওয়ে নাম জিজ্ঞেস করে করে খুন করা, কলমা না বলতে পারলে খুন করার ঘটনায় বাংলাভাষী বুদ্ধিজীবী কবি-সাহিত্যিকেরাও একই সঙ্গে বসবাসকারী সমপথের পথিক মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি এরকম ব্যবহার করবেন বা এরকম বিষ উগরে দেবেন তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তারা এইসব বলার বা মন্তব্য করার সময় একবারও ভাবলেন না, আমি কাকে এই কথাগুলো বলতে যাচ্ছি! তিনি মানুষ হিসেবে কেমন, তার হৃদয়ের প্রসারতা কতখানি, তার সাহিত্যের দর্শন, স্বরূপ কতখানি জীবনবাদী সংস্কৃতির ধারক—এসব একবারও মনে রাখলেন না! সারাদিন ধরে তারা শেয়ার করলেন তসলিমার বিদ্বেষ বাণী “মুসলমানরা যতদিন পৃথিবীতে থাকবে ততদিন যুদ্ধ সন্ত্রাস থাকবে।” তারা সারাদিন শেয়ার করলেন আর. বাংলা টিভি চ্যানেলের ময়ূখরঞ্জ ঘোষের উক্তি “এক বৃন্তে দুটি কুসুম! কিসের কুসুম? খুব হয়েছে, আর না!” ইত্যাদি। সারাদিন ধরে বাজালেন এবিপি আনন্দের সুমনের কথা “সন্ত্রাসবাদীর ধর্ম হয়”।

 আর এইসবের কারণেই তারা সর্বশেষ সিদ্ধান্তে এলেন “মুসলমান মানেই টেররিস্ট”, “মুসলমানদের সঙ্গে কোনো বন্ধুত্ব নয়”, এবং “মুসলমানরা তাদের ধর্মের মধ্যেই সন্ত্রাসবাদকে লালন করে”। তারা এ কথা মেনে নিলেন সবাই যে ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদের ধর্ম। সুতরাং আমি যে আক্রান্ত হব তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই।

 কিন্তু ওদের প্রশ্নের সঙ্গে আমিও যদি পাল্টা প্রশ্ন করি তাহলে সেটার কি জবাব দিতে পারবে? তথাকথিত হিন্দু ধর্ম গরিব মুসলমানদের দাড়ি ধরে টান মেরে, কিল চড় লাথি ঘুঁষি মেরে জয় শ্রীরাম বলার জন্য যেভাবে অত্যাচার করে চলেছে সেটা কি তাদের ধর্মের মাহাত্ম্য? সেক্ষেত্রে ময়ূখ বা সুমন তাদের টিভি চ্যানেলে বসে কই বলে না তো এসবও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ! এসব সন্ত্রাসবাদীর ধর্ম! গদি মিডিয়ার রাজত্বে তারা যা খুশি বলে যাচ্ছে একটা দেশের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করার জন্য একটা রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা হয়ে। আজ প্রায় সর্বত্রই মুসলিম নির্যাতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ওয়াকাফ আইন পাস করিয়ে মুসলমানদের সম্পত্তি লুঠ করার যেমন একটা সরকারি প্রক্রিয়া, তেমনি নানা বিদ্বেষ মূলক কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের হীন বা নীচ হিসেবে প্রমাণ করার কৌশলও। হিন্দু ভোট এককাট্টা করার  জন্য নানা প্ররোচনামূলক বক্তব্যও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলিতেও হিন্দু-মুসলিমের বিভাজন এবং হিংস্র বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে। সৎসংবাদ পরিবেশন এর বিষয়টি এড়িয়ে কেবল রাজনৈতিক বক্তব্যই বেশি। মুসলমানদেরমুসলমানদের বাড়ির, কবরস্থান, মসজিদ, মাজার যেভাবে বুল্ডোজ করা হচ্ছে তা কোনো সংবাদমাধ্যমেই দেখানো হচ্ছে না। অথচ এসবও নাকি ধর্মেরই মাহাত্ম্য। দলিত আদিবাসীরাও উচ্চশ্রেণির মানুষদের দ্বারা শোষিত নিপীড়িত হচ্ছে তার সংবাদ কোথাও চোখে পড়ছে না। শুধুমাত্র মুসলমান সে যেমনই হোক তাকেই আক্রমণ করা তাদের লক্ষ। তসলিমার মতো মুসলিম বিদ্বেষী নারীর বক্তব্যকে বেশি বেশি তুলে ধরা হচ্ছে অথচ ওই মহিলা সমাজের মানুষদের প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরার এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার ধারে কাছেও যায় না।

 একটা জাতি, একটা দেশ, এমনকি একটা সভ্যতাও এভাবেই ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়। আর এই ধ্বংসের কারিগর দেশের শাসক একথা বলার অপেক্ষায় রাখে না। শাসক যদি মানবিক হতেন, প্রজাবৎসল  হতেন, দেশ দরদী হতেন, হিংস্রতা বিসর্জন দিতে পারতেন, সাংবিধানিক পথেই দেশকে শাসন করতেন তাহলে এই অবনমন দেখতে হত না। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, একটা দেশের শাসক হয়েও পক্ষপাতিত্ব মূলক তার নীতি, অমানবিক শাসন এবং ধর্মীয় মিথ্যাচার প্রভৃতি নিয়ে তিনি মধ্যযুগীয় বর্বরতার বাতাবরণ তৈরি করছেন। আর তার ফলেই তার অনুসারীরা এভাবেই উগ্র ও অসহিষ্ণুতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছে। অন্য ধর্মের মানুষকে এবং অন্য ধর্মকে সংহার করতে গিয়ে পরোক্ষে তারা নিজেকেই ধ্বংস করে চলেছে এই টুকু বোঝার বোধও তাদের নেই।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প
নয়ন আহমেদ on যুদ্ধশিল্প
কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন