spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের কেন জরুরি

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের কেন জরুরি

আবু তাহের সরফরাজ

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুই হাজার টাকায় বাজারের ব্যাগ ভরতো না। অথচ এবারের রমজান মাসে পাঁচশো টাকায় বাংলাদেশের মানুষ ব্যাগ ভরে বাজার করেছে। অবশ্য রমজানের আগে ও পরে বাজার ব্যবস্থায় খানিকটা অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়ে যায়। তবে তুলনামূলক হিসাব কষলে দেখা যাবে, সেটা আওয়ামী সরকারের সময়ের চেয়ে বেশ স্থিতিশীল। রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের বিশেষ তদারকি ছিল। এরপর মনে হয় সেই তদারকি কিছুটা ঢিমেতালে চলছে। ফলে, নিত্যপন্যের বাজারে জিনিসপত্রের দাম ওঠানামা করছে। তবে কোনোভাবেই এই দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে না। এটাই ইউনূস সরকারের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় সাফল্য। কারণ, প্রতিদিন তিন বেলা আমাদেরকে খেতেই হয়। খাদ্যদ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকলে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। কথায় বলে, পেটে খেলে পিঠে সয়।

দেশের মানুষ দেখেছে, স্মরণকালের মধ্যে এ বছর ঈদযাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি নির্বিঘ্নে। রাজধানী ঢাকা থেকে ঘরমুখি মানুষ ঈদের আনন্দ নিয়েই নিজ নিজ পরিজনের কাছে ফিরতে পেরেছে। মহাসড়কে কোত্থাও কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। আগের বছরগুলোর চেয়ে এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কিছুটা কম। এ বছর সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৪০। নিহতের সংখ্যা ৩৫২ এবং আহতের সংখ্যা ৮৩৫। গত বছর মানে ২০২৪ সালে ঈদযাত্রায় এই দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪১৯। নিহতের সংখ্যা ৪৩৮ এবং আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৪২৪। ২০২৩ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩৪১। নিহতের সংখ্যা ৩৫৫ এবং আহতের সংখ্যা ৬৪২। সড়ক দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় মোটাদাগে কোনো পার্থক্য না থাকলেও একটু হলেও কমেছে বলেই পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যাচ্ছে। ঈদযাত্রায় যেসব সমস্যার মুখোমুখি মানুষকে হতে হয়েছে সেসব সমস্যার জন্য সরকার দায়ী নয়। দায়ী আমরাই। আমাদের নির্বুদ্ধিতা ও লোভি মনেবৃত্তি। সম্ভবত এটাই আমাদের জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সংবাদে পড়েছি, ঈদযাত্রায় বাড়তি বাসে ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে আহত করেছে বাসের হেলপার। এ ঘটনার পর কী হয়েছে, জানি না। তবে এটুকু বোঝাই যাচ্ছে, যে-কোনো কিছু বাড়তি পেতে চাওয়া এই জাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই দেশে প্রত্যেক মানুষই ওৎ পেতে বসে আছে আরেকজন মানুষকে ঠকাবে বলে। যুগ যুগ ধরে দেশে এই ব্যবস্থা চলে আসছে। দুর্নীতি বাঙালির মজ্জাগত। ফলে, প্রত্যেক মানুষকে ধরে ধরে ব্যক্তিগতভাবে শুদ্ধ করে দেয়া ড. ইউনূসের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু বিধি-বিধানের মাধ্যমে সকলকে পরিচালিত করতে পারেন। তিনি সেটা করছেনও। এখন তার বিধান না মেনে কেউ যদি চামে-চিক্কনে দুর্নীতি শুরু করে, তার দায় কিন্তু ড. ইউনূসের ওপর বর্তায় না।

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের প্রতিটি সেক্টরে যে হরিলুট ব্যবস্থা চালু ছিল, সেই ব্যবস্থা কিন্তু এখন আর নেই। তবে একেবারেই যে নেই, তা নয়। কিছু কিছু সেক্টরে দুর্নীতি চলছে তো চলছেই। এখনো সরকারি অফিসে কোনো কাজের জন্য গেলে ঘুষ দিতে হয়। না-হলে কাজ উদ্ধার হয় না। শিক্ষা-ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। ‘সিঁথি’ শিরোনামের অতি নিম্নমানের একটি কবিতা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পতিত রাজনৈতিক দলের কোনো পরিচয় না দিয়েই পাঠ্যপুস্তকে ওই অভ্যুত্থান নিয়ে নিবন্ধ লেখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, যে দলকে সারা দেশের মানুষ একজোট হয়ে দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছে সেই দলকে এখনো ড. ইউনূসের সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণ মানুষ আন্দোলন করেছি, রক্ত ঝরিয়েছিল, সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সেটা তাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে।” এ ধরনের কথা বলে ড. ইউনূস তার ব্যর্থতার তালিকাকে আসলে দীর্ঘ করছেন। সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এই দেশের মানুষ চিরতরে ঝেঁটিয়ে দিয়েছে। অথচ এখনো দলের নেতাকর্মীরা দেশের ভেতর নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদে দেখি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের স্থানীয় কোনো নেতাকে প্রকাশ্যে দেখলে জনগন তাকে পাকড়াও করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। কেন তারা এমনটি করছে? করছে কারণ, আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ রয়েছে। দেশের মানুষের এই মনোভাব বুঝতে পারছেন না ড. ইউনূস। অথচ বাংলাদেশের স্বার্থে বিষয়টি তার বোঝা উচিত ছিল। তিনি বিজ্ঞ ও দূরদর্শী। ফলে, বিষয়টি তার না-বোঝার কোনো কারণ নেই। তবে কি তিনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে সময়োপযোগি কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না? হতেও পারে। চলমান পরিস্থিতির দিকে একটু খোলা চোখে তাকালে আমাদের সিদ্ধান্ত এমনটিই আসবে। সেনাপ্রধান হিসেবে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন ওয়াকার-উজ-জামান। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে তিনি গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তার কিছু অপকর্ম এরই মধ্যে জাতি জেনেও গেছে। ইউনূস সরকারের ব্যর্থতার এই জাতীয় ফিরিস্তি অনেকই দেয়া যায়। তবে একটু সূক্ষ্ম হিসাব মিলিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারবো, সরকারের যেসব ব্যর্থতা আমাদের সামনে প্রকটিত তার জন্য সরাসরি ড. ইউনূস দায়ী নন। মূলত এর পেছনে তার কয়েকজন উপদেষ্টার কারসাজি রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এখনো পতিত আওয়াম লীগের একনিষ্ঠ সেবাদাসরা রয়ে গেছে। ফলে, নানা দিকে নানা কৌশলে চলছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আমরা জেনেছি যে, ইঊনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না সেনাপ্রধান। শেষমেশ তিনি ‘বুকে পাথর চাপা’ দিয়ে ইউনূসকে মেনে নিতে সম্মত হন। জাতির প্রশ্ন, প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন সে বিষয়ে সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল কেন? সেই সিদ্ধান্ত তো দেশের মানুষের। এই ঘটনার মধ্যে সেনাপ্রধানকে কে ঢোকালেন? খড়যন্ত্রের শুরু সেখান থেকেই। ফলে, ড. ইউনূস যতই চেষ্টা করুন না কেন বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করতে, তার যাত্রাপথে কাঁটা বিছিয়ে দিতে ষড়যন্ত্রকারীদের অভাব নেই।

দেশের কিছু কিছু সেক্টরে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা আমাদের দৃষ্টিগোচর হলেও এরই পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি, কয়েকটি সেক্টরে বর্তমান সরকারের সফলতা। বিগত সরকারের সময়ে বিদ্যুতের লোড-শেডিংয়ে দেশের মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। আর এখন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ আমরা পাচ্ছি। এখন-তিন দিন পরপর বিদ্যুৎ চলে গেলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসে। এই অবস্থা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে দেশের মানুষ কল্পনাও করেনি। সেই সময় বিদ্যুৎ ছিল সোনার হরিণ। অথচ বিদ্যুৎ সেক্টরের কোটি কোটি টাকা হাসিনা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সাথে নিয়ে লোপাট করেছে। উন্নয়নের নানা বুজরুকি তুলে দেশের মানুষকে ছেলেভোলানো কিসসা শুনিয়েছে। ড. ইউনূস কিন্তু সেই রকম কিছুই করছেন না। তিনি আন্তরিকভাবেই দেশের সমৃদ্ধি ও জনগণের কল্যাণে নিরলস কাজ করে চলেছেন। বিভিন্ন দেশে তার সরকারি সফরগুলোর দিকে তাকালে আমরা সেই চিত্র দেখতে পাই। আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ মহলে ড. ইউনূসের রয়েছে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা। বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই মুহূর্তে তার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি বাংলাদেশে আরেকটি নেই। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তিনি উৎসাহী করে তুলছেন। ইউনূসের প্রতি বিশ্বাসের কারণেই বিদেশি ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এই প্রক্রিয়া হুট করেই হয়ে যায় না। একটু সময় লাগে। কিন্তু সেই সময় কয়েকটি রাজনৈতিক দল ড. ইউনূসকে দিতে রাজি নয়। তারা অতি দ্রুত দেশে নির্বাচন চায়। তাদের ভাষ্য, ড. ইউনূস অনির্বাচিত সরকার। অথচ চূড়ান্ত সত্য হচ্ছে, দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী ও জনতাই তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচিত করে। তাদের নির্বাচনে পরবর্তীতে দেশের মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মতি দিয়েছে। আমরা জানি যে, ড. ইউনূস এই দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত ছিলেন না। বারবার বিশেষভাবে অনুরোধ করার ফলেই তিনি দেশে এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমরা জানি, ড. ইউনূস নির্লোভ। তার রয়েছে প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ ও শিক্ষা। তার মার্জিত কথা ও আচরণের সাথে দেশের মানুষ পরিচিত। আর তাই আমরা দেখি যে, বায়তুল মোকাররমের ঈদ জামায়াতে উপস্থিত মুসল্লিরা তার সাথে করমর্দন করছেন আর প্রত্যেকেই অনুরোধ করছেন, প্লিজ স্যার, পাঁচ বছর আপনি ক্ষমতায় থাকুন… প্লিজ স্যার, পাঁচ বছর আপনি ক্ষমতায় থাকুন। দেশের মানুষের এই আহ্বান ও সমর্থন কি নির্বাচন নয়? নাকি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ভোটকেই নেতা নির্বাচনের একমাত্র মাধ্যম বলে মনে করে? এহেন নির্বোধরাই যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশ শাসন করে যাচ্ছে। এবং করবেও। করবে কারণ, দেশের মানুষ মূর্খ। মূর্খ বলেই তারা ভোট দিয়ে শোষক নির্বাচন করে।

অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই দেশের গণ-মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। এ বিষয়ে যারা দ্বিমত পোষণ করে যারা দ্রুত ভোটের আয়োজন করতে বলছেন তারা আসলে লুটেরা। গণতন্ত্রের ছদ্ম আবরণে দেশকে লুটেপুটে খাওয়াই তাদের অভিসন্ধি। ড. ইউনূস যে প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন সেটাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। বিশ্বের অনেক সমৃদ্ধ দেশে এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও দেশের মানুষের কল্যাণই প্রধান বিষয়। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দল বিবেচ্য নয়। আসলে গণতন্ত্রের কিছু সমস্যা রয়েছে। সেই সমস্যাগুলো না-বুঝলে এই দেশের মানুষের মুক্তি কখনোই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল মানে অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণ। একটি দল রাষ্ট্র-ক্ষমতা গ্রহণ করলো। এরপর ওই দলের কেন্দ্রিয় নেতা থেকে শুরু করে আঞ্চলিক পর্যায়ের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে ভরণ- পোষণ করতে শুরু করে দলীয় সরকার। এজন্য সরকারি প্রত্যেকটি কর্মকাগু দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়েই সম্পাদিত হয়। চলে হরিলুট। বাস-ট্রাক-ট্যাম্পো স্ট্যান থেকে শুরু করে রিকশা স্ট্যান্ড পর্যন্ত দখলে নিয়ে নেয় দলীয় পাতিনেতারা। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে বড় বড় মার্কেট সবই তাদের দখলে। নদী তাদের দখলে। বনাঞ্চল তাদের দখলে। এক কথায়, গোটা দলের নেতাকর্মীরা দেশের হত্তাকত্তা হয়ে ওঠে। দেশের মাটি, জল ও গাছপালা যেখানে যা আছে সবকিছুই তাদের অর্থ উপার্জনের উৎস। বলা তো যায় না, পাঁচ বছর পরের নির্বাচনে যদি দল আবারও ক্ষমতা না আসতে পারে! ফলে, চলমান সুবর্ণ সুযোগ কেউ-ই ছাড়ে না। ছাড়ার কথাও নয়। কেননা, এই দেশের মানুষের চরিত্র হচ্ছে, যে রাস্তা দিয়ে হাঁটে সেই রাস্তার পেছনের মাটি কেটে বেচে দিয়ে সেই টাকা গুণতে গুণতে মনের আনন্দে সে এগিয়ে যেতে থাকে। পেছনের মানুষটি যে এগোবে সেই রাস্তা আর রাখে না। তার পেছনের মানুষটাও অবশ্য একই কাজটি করতে থাকে। কিন্তু সামনে এসে দ্যাখে, তার হাঁটার রাস্তা নেই। এভাবেই চলছে এই দেশ। যে যত সামনের সারির নেতা, তার ট্যাঁকে তত বেশি লুটের টাকা। সরকার দলীয় নেতাকর্মী ছাড়া দেশের বাদবাকি মানুষের তখন ত্রাহি অবস্থা। প্রাণান্ত খেটেও তারা ঠিকমতো দিন গুজরান করতে পারে না। অথচ কোনো পরিশ্রমক ছাড়াই সাধারণ মানুষের পরিশ্রমে ভাগ বসিয়ে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা রাজার হালে দিন কাটায়। এটাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র। এটাই বাংলাদেশের তথাকথিত নির্বাচিত সরকারের চেহারা। অথচ উন্নত বিশ্বে গণতন্ত্রের চেহারা আলাদা। সংসদ সদস্যের মেয়াদ পূর্ন হবার আগেই স্থানীয় জনগণ ভোটের মাধ্যমে নতুন সংসদ সদস্য নির্বাচন করে নিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা সম্ভব হয় না।

গণতন্ত্র আসলে শিক্ষিত মানুষের রাষ্ট-ব্যবস্থা। যে রাষ্ট্রের জনগণ শিক্ষিত ও বিচারবোধ সম্পন্ন, গণতন্ত্র সেসব মানুষের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ভোটার হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে আমরা বিবেচনা করি বয়েস আঠারো বছরের বেশি হয়েছে কিনা। বয়েস হলেই কি মস্তিষ্কের ঊর্বরতা বাড়ে? বাড়ে যে না তার প্রমাণ বাংলাদেশের জনগণ। এই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সাধারণত হয় না। সরকারি দল যে-কোনো উপায়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে পরবর্তী ধাপে আবারও ক্ষমতা গ্রহণের জন্য তীব্র মরিয়া হয়ে ওঠে। এজন্য হেন অপকর্ম নেই যা তারা করে না। জনগণের ভোটের অপেক্ষায় তারা বসে থাকে না। আবার সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করার বিবেচনাবোধ জনগণের থাকে না। দেখা যায়, আশি বছরের বুড়োকেও পিঠে চাপিয়ে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। এর আগে তার হাতে পাঁচশো টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, অমুক মার্কায় সিল মাইরা দিবা। টাকা খেয়ে সিল মারার এই কাজটি দেশের বেশির ভাগ মানুষই করে। করে কারণ, ভোট দেয়া ছাড়া এই দেশের মানুষের আর কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। যার হাত দিয়ে টাকা নিয়ে কথামতো নির্দিষ্ট মার্কায় সিল মেরে আসে সারা বছর তার কাছ থেকে টিসিবির কার্ড থেকে শুরু করে দুস্থ ভাতা নিশ্চিত হয়ে যায়। এই লেনদেনই এই দেশে জনগণ ও স্থানীয় পর্যায়ের সরকার দলীয় পাতি নেতাদের সম্পর্ক। এই বাইরে আর কোনো ফিকির এই জাতি করতে পারে না।

তো দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল মানেই দলীয় পোষ্যদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব। এই অর্থায়ন তো সরকার প্রধান তার পকেট থেকে দেবে না। সরকার যেমন লুটপাট করে বিদেশে টাকা জমাচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য একই উপায়ে দলীয় নেতাকর্মীরাও লুটপাট করছে দেশের মাটি, জল, গাছপালা ও সাধারণ মানুষের পরিশ্রমে ভাগ বসিয়ে। এই দেশে গণতন্ত্রের এটাই স্বাভাবিক ধারা। এমনটিই চলে আসছে ৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে। বাংলার মানুষ দেখেছে, এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই যারা সরকার গঠন করে লুটপাট ছাড়াই দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে গেছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে রাষ্ট্র-ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। শোষণ ও বঞ্চনার কারণে দেশের সাধারণ মানুষের পিঠ তখন দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। তাই তারা আন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলেছিল। কিন্তু এরপর যে লাউ সেই কদু। শেষমেশ আমরা দেখলাম, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই ২০২৪ সালে এসে সাধারণ মানুষ আবারও গর্জে উঠল। তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে ভোটাভুটির মাধ্যমে রাজনৈতিক দল নির্বাচনের প্রক্রিয়া যতদিন চলবে ততদিন সাধারণ মানুষ শোষিত হতেই থাকবে। এর থেকে বাঁচার বিকল্প কোনো উপায় এই জাতির সামনে খোলা নেই।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস আপাতত আমাদের হাতে সেই বিকল্প। তার কোনো রাজনৈতিক দল নেই। দলীয় পোষ্যও নেই। ফলে, লুটপাট করবে কে? ইউনূস নিজে এই অপকর্ম করবে না। দেশজুড়ে তার বিপুল সংখ্যক পোষ্যবাহিনী নেই যে তারা লুটপাট করবে। তাহলে কারা করবে লুটপাট? আমরাই করবো। কারণ, আমরা প্রত্যেকেই ওৎ পেতে বসে আছি আরেকজনকে ঠকিয়ে কিভাবে নিজে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে উঠবো। যতই আমরা বলি না কেন, সাধারণ মানুষ খেয়ে-পরে থাকতে পারলেই সুখি থাকে। এই দেশের মানুষের হা কৃষ্ণ গহ্বরের মতো। যতই খাবে হা আরও বাড়বে। ফলে, জাতীয় উন্নয়ন যদি আমাদের আন্তরিক কামনা হই তাহলে এই মুহূর্তেই আমাদেরকে শপথ করতে হবে যে, আমরা কেউ-ই আর দুর্নীতি করবো না। দেশের প্রতিটি মানুষ আমার ভাই। আমার সন্তান। প্রত্যেককে তার প্রাপ্য দিয়ে নিজের যেটুকু সেটা নিয়েই আমি সন্তুষ্ট থাকবো। যদি এই শপথ আমরা করতে পারি তাহলে রাষ্ট্র-প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসকে আমাদের জরুরি। তাকে যদি আরও পাঁচটি বছর আমরা ধরে রাখতে পারি তাহলে দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কেউ-ই আটকে রাখতে পারবে না।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি
কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা