মাসুদুল হক
আফগানিস্তান, তার দীর্ঘ ইতিহাস ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে, একটি সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্যিকভাবে বৈচিত্র্যময় দেশ। যদিও দেশটি বহু বছর ধরে যুদ্ধ ও অস্থিরতার শিকার, তবে এর সাহিত্যিক পরিসরে কবিতা বরাবরই একটি শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষত আফগান কবিতা, যা সাধারণত ফার্সি, উর্দু ও তাজিক ভাষায় লেখা হয়; তার ভেতরে মানুষের দুঃখ, আশা, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার অঙ্গীকার ভরপুর। সমকালীন আফগানিস্তানের কবিতা সেই সংগ্রামী সাহিত্যের ধারাবাহিকতা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
আফগানিস্তানের সমকালীন কবিতা মূলত দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি প্রভাবিত। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে শুরু করে, পরে তালিবান শাসন, ২০০১ সালের মার্কিন আগ্রাসন এবং বর্তমান তালিবান সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্যে আফগান জনগণ চরম সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। এই অস্থির পরিবেশে কবিতা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। কবিরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে যুদ্ধ, পীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
যদিও কবিতা প্রথাগতভাবে রোমান্টিক বা নিখাদ সৌন্দর্যের প্রতি নিবেদিত হতে পারে, কিন্তু আফগান কবিতা বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যুদ্ধ, দুঃখ, শোক ও মৃত্যুর চিত্র কবিতার মাধ্যমে বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। কবিরা নিজের পরিচয় এবং জাতির চেতনার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য তাদের কাব্যিক ভাষাকে যুদ্ধের মধ্যে শান্তির পক্ষে একটি আহ্বান হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
সমকালীন আফগানিস্তানের কবিতার বৈশিষ্ট্য অনেক দিক থেকেই বিশেষ এবং তা আফগান সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে যুক্ত। এই বিষয়গুলোকে চিন্তায় রেখে সমকালীন আফগানিস্তানে কবিতার রূপরেখা তুলে ধরা হলো।
ক. রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা:
আফগান কবিতার মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও সামাজিক অসমতার মতো বিষয়গুলি প্রধানভাবে উঠে আসে। কবিরা তাদের কবিতায় যুদ্ধবিরোধী, মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বার্তা দেন।আফগান কবিরা এই বিষয়গুলোকে তাদের কবিতায় তুলে ধরে, সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছেন। এখানে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আফগান কবির কবিতা এবং তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো:
১.রুহুল্লাহ মাজদ (Ruhullah Majd) একজন প্রখ্যাত আফগান কবি এবং সাহিত্যিক। তিনি ১৯৮৪ সালের ৩ জানুয়ারি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবিতার মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের গভীর প্রতিফলন রয়েছে। তিনি আফগান সমাজের পরিবর্তন এবং স্বাধীনতার পক্ষে লিখেছেন এবং রাজনৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যিক জীবন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী, বিশেষ করে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন, পরে তালিবান এবং আধুনিক আফগানিস্তানের সংকট। তার কবিতার মধ্যে যুদ্ধের কষ্ট এবং মানুষের দুর্দশা ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতায় সমাজের নিচুতলা এবং সাধারণ মানুষের অবস্থা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় দারিদ্র্য ও যুদ্ধের প্রতি প্রতিবাদও পাওয়া যায়। যেমন, তিনি তার ” অমর সংগ্রাম” কবিতা লেখেন:
“যুদ্ধের মাঠে জীবন দেয়া হলো,
কিন্তু সংগ্রাম কখনও মরবে না।”
কিংবা:
“এরা আমার দুঃখের কথা শোনে না,
তারা তো শুধু যুদ্ধের শব্দ শোনে।”
এখানে তিনি যুদ্ধের অন্ধকার দিক এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরছেন।
২.মাওলানা আশরাফ আলী (Ashraf Ali) ছিলেন আফগানিস্তানের একজন প্রভাবশালী কবি এবং সাহিত্যিক। তিন ১৮৮৫ সালে আফগানিস্তানের কাবুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫৯ সালে।তিনি ২০ শতকের আধুনিক আফগান কবিতার অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। মাওলানা আশরাফ আলী তার কবিতায় আফগান সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় চেতনার গভীর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
তিনি আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিও গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং তার কবিতার মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। তিনি অতি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এই দুঃখ-দুর্দশাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যেমন, তিনি লেখেন:
“যে রাজা শাসন করে ন্যায়ের পথে,
সে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়,
কিন্তু যে শাসক শুধুই ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ করে,
সে দেশের কল্যাণে কখনও পৌঁছাতে পারে না।”
এই কবিতার মাধ্যমে তিনি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা দেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে, প্রকৃত নেতা কেবল মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারেন, আর ক্ষমতার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া দেশ এবং জাতির জন্য অকল্যাণকর।
তার কবিতায় সাম্প্রদায়িকতা, নারীর অধিকার, এবং মানবাধিকারের গুরুত্ব উঠে এসেছে। যেমন,
“নারীর অশিক্ষা, শোষণ, নিপীড়ন—
এগুলো এক সমাজের হারানো মানবতা।”
এখানে তিনি নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া শোষণ ও নিপীড়নকে সমাজের বড় একটি সংকট হিসেবে তুলে ধরেছেন।
৩. সাদিক পাস (Sadik Pas) আফগান কবিতা ও সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি আফগানিস্তানের প্রখ্যাত কবি, লেখক, ও সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত।১৯৩০ সালে আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবিতার মধ্যে জাতীয়তা, স্বাধীনতা, ও মানবাধিকার বিষয়ক গভীর চিন্তা-ভাবনা পাওয়া যায়। সাদিক পাস আফগানিস্তানের রাজনীতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও তার লেখনির মাধ্যমে অনেক কিছু তুলে ধরেছেন। যেমন:
“আমাদের হৃদয়ে যে আগুন জ্বলছে,
তা কখনো নিভবে না।
আমাদের স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম চলছে,
তা শেষ হবে না।”
কিংবা:
“আমি জানি,
আফগানদের সংগ্রাম কখনো শেষ হবে না,
শত্রু যতই শক্তিশালী হোক,
আমাদের মাটিতে ভর করে উঠবে
একদিন মুক্তির সূর্য।”
কিংবা:
“যুদ্ধের দাগ আমাদের শরীরে,
কিন্তু শান্তি আমাদের হৃদয়ে।”
তার কবিতার মূল ভাবনা আফগান জাতির ঐক্য, স্বাধীনতা, এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তিনি মানুষের সংগ্রাম ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে তার কবিতায় শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন।
৪. মুহাম্মদ আলী( Mohammed Ali) আফগানিস্তানের কবি;যিনি ১৮৮০ সালের ৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৭ সালে ৫ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়।তাঁর সাহিত্যিক জীবন ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী।তিনি আফগানিস্তানে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের পক্ষে ছিলেন এবং তার কবিতায় জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা, এবং সমাজের উন্নতির কথা বলেছেন। মুহাম্মদ আলী একসময় আফগানিস্তানের সরকারী চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন এবং কিছু সময় ধরে তিনি সরকারি দফতরগুলোতে কাজ করেছেন। তাঁর কবিতায় আফগান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, যুদ্ধের ক্ষতি, রাজনৈতিক প্রেরণা ও জনগণের জন্য সংহতির বার্তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তার কবিতায় তীব্র প্রতিবাদ, দেশপ্রেম, এবং সামাজিক পরিবর্তনের আহ্বান শোনা যায়। যেমন:
“এরা কি জানে আমাদের মাটি,
কেমন কেঁদেছিলো একদিন,
আমাদের মুক্তির জন্য,
যুদ্ধের ভিতর হারাতে হয়নি জীবন।”
কিংবা:
“অন্যায় শাসকের শেকলে,
আমরা বেঁচে থাকি দুঃখ-কষ্টে,
তবে একদিন ভাঙবো সেই শেকল,
যেদিন উঠবে আমাদের জয়ধ্বনি।”
কিংবা:
“হাজারো অভাবের মধ্যে,
একমাত্র তোমায় চেয়েছি,
সমাজ, তুমি যদি সুখী হও,
তবেই আমি শান্তি পাবো।”
এই কবিতাগুলি তার রাজনীতির প্রতি এক গভীর ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রতিফলন। তার কাজ আফগান সমাজের পরিবর্তন ও উন্নতির জন্য সংগ্রামের লক্ষ্যে ছিল।
এই কবিরা তাদের কবিতার মাধ্যমে আফগান সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাদের কবিতা শুধু যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক সংগ্রামী বার্তা দেয়। এই ধরনের কবিতা আফগান জনগণের চেতনা ও সংগ্রামকে নতুন রূপে তুলে ধরে, যা তাদের সাহস ও আশা যোগায়।
[ চলবে ]
অভিনন্দন অভিনন্দন অভিনন্দন
পড়লাম অনেককিছু । বাংলা রিভিউয়ের পড়ার শেষ নেই দেখছি! এতো এতো লেখা! আর কি চমৎকার সব লেখা! সারাবেলা কেটে যাবে মনে হচ্ছে!
আফগান কবিদের নিয়ে লেখাটাও ভালো লাগলো—
“আফগান কবিতা বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যুদ্ধ, দুঃখ, শোক ও মৃত্যুর চিত্র কবিতার মাধ্যমে বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। কবিরা নিজের পরিচয় এবং জাতির চেতনার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য তাদের কাব্যিক ভাষাকে যুদ্ধের মধ্যে শান্তির পক্ষে একটি আহ্বান হিসেবে ব্যবহার করেছেন।”
চমৎকার আয়োজন… অভিনন্দন