রেজা তানভীর
এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারত সরকার এই হামলার দায় পাকিস্তানের ওপর দিয়েছে। তবে পাকিস্তান এ অভিযোগ অস্বীকার করে ওই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত এবং পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে বেসামরিক নানা বিধিনিষেধ ঘোষণার পরও কাশ্মীরের মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন।
তারা ভেবেছিলেন, পরিস্থিতি হয়ত এর চেয়ে খারাপ হবে না। কিন্তু গত সপ্তাহে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গুলি বিনিময়ের কারণে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন এর কাছে বসবাসকারী মানুষ।
কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই পাশের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। দুই পাশেই মানুষ আতঙ্ক থেকে বাঙ্কার সংস্কার করছে
ওই ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত পানিবণ্টন-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্থগিত করেছে এবং দুই দেশই একে অন্যের উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া কাশ্মীরে দুই দেশের নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলি হয়েছে।
এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত বেশ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আটারি সীমান্ত বন্ধ করা, কূটনৈতিক কর্মীদের সংখ্যা কমিয়ে আনা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা, পাশাপাশি ছয় দশকের পুরনো সিন্ধু পানি চুক্তির বাস্তবায়ন স্থগিত করা।
পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তান। দেশটি তাদের আকাশসীমা এবং ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে, যা ভারতের সাথে এ সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করার ইঙ্গিত দেয়।
ভারত থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানি নাগরিকদের, পাকিস্তানও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীরকে পুরোপুরি নিজেদের বলে দাবি করে। কিন্তু তারা এটির একেক অংশ শাসন করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে এ ভূখণ্ড।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, সরকারকে ক্ষমতায় বসানো ও অপসারণে দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনী নানা ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে। এখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী প্রতিবেশী এ দুই দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, “যখন বিশ্বব্যাপী ‘রিসেশন’ বা মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন ভারতের অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বৃহৎ অর্থব্যবস্থার মধ্যে ভারতে সবচেয়ে দ্রুত হারে বৃদ্ধি হচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরে সম্ভাব্য বৃদ্ধি ৭ শতাংশ। যুদ্ধ করে এই হার ধরে রাখা অসম্ভব।”
এখন পেহেলগামে যে ঘটনা ঘটল, সেই ঘটনা সম্পর্কে ভারতের বক্তব্য, এর পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। এবং পাকিস্তানের বক্তব্য, এর পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। এটা সম্ভবত কখনোই নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করা যাবে না যে এই ঘটনার পেছনে কার হাত রয়েছে। সাধারণত কাশ্মীরে সেটা করা যায়ও না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, “পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় যুদ্ধ বেধে যাওয়া ও হতাহতের তাৎক্ষণিক হুমকি তৈরি হয়েছে। এর বাইরে আরও বড় বিপদ রয়েছে। অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের যে বিপর্যয় ডেকে আনবে, তাতে যে দেশই নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করুক না কেন, স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হবে। এখন সময় হয়েছে, দুই দেশের যুদ্ধংদেহী কথাবার্তা বন্ধ করে উত্তেজনা প্রশমন ও সংকট সমাধানের পথ বের করা।”
পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতেও জোরালোভাবে চলছে পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা।
তবে এ নিয়ে ভারতের সাধারণ জনগণের মধ্যেও বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি এক ভারতীয় নাগরিককে এ বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করতে দেখা গেছে।
ভিডিওতে ওই নাগরিক বলেন, “সৌদি আরব সফর থেকে জরুরি অবস্থা ফেরার পর মোদির উচিত ছিল কাশ্মীরে যাওয়া, কিন্তু তিনি গেছেন বিহার রাজ্যে।”
ভারতীয় ওই নাগরিকের প্রশ্ন, যখন কারো বাড়িতে দূর্ঘটনা ঘটে তখন কি তার বাড়িতে যাওয়া উচিত নাকি অন্য ঘরে?
একই বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “পেহেলগামে মোদির ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ যদি ভারতীয় জনগণকে বোকা বানাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বিশ্বকে কীভাবে বোকা বানানো যাবে? মোদি তার উগ্রবাদী ও বিপজ্জনক মানসিকতা ভারতের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। মোদি শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতালিপ্সার জন্য ভারতকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।”