তাজ ইসলাম
মবজাস্টিজ শব্দটি সম্প্রতি বেশ পরিচিতি পেয়েছে।
মবজাস্টিজ বলে এখন ঠোঁট কাঁপায় অনেকে। খেয়াল করলে দেখা যাবে যারা এ নিয়ে বেশি উচ্চ বাচ্য করছে তারাই বাংলাদেশে মবজাস্টিজকে প্রতিষ্ঠিত করেছে স্লোগান তুলে, গণজমায়েত করে, অবস্থান করে, এবং তা করেছে সরকারি মদদে।
গ্রামে শালিশ দরবার হয়। শালিশ দরবারের মাতব্বরগণ অনেকে থাকে নিরক্ষর। কিন্তু তারাও শহুরে রাজনৈতিক শিক্ষিতদের তুলনায় অনেক বোধ সম্পন্ন। তাদের কাউকে যদি রায় নির্ধারণ করে বিচার মানেন, তারা তা গ্রহণ করবেন না, সে শালিশ তারা করবে না ।
রায় আপনি দিয়ে দিলে তাদের করণীয় কী থাকে?
‘বিচার চাই, আর ফাঁসি চাই ‘এই দুটো বাক্যের মাঝে আলবৎ ফারাক আছে। আপনি বিচার চাইবেন। বিচারিক প্রক্রিয়ায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বিচারক রায় দেবেন, শাস্তি যা প্রাপ্য তা দেবেন, জেল জরিমানা ফাঁসির রায় দেবেন । তা না করে আপনি, আপনারা জমায়েত হয়ে ফাঁসি চেয়ে স্লোগান দিবেন, নিয়ম পরিবর্তন করে, পূর্বের রায় পরিবর্তন করে রাজপথের দাবি আদালতে বাস্তবায়ন করবেন! এর চেয়ে বড় মবজাস্টিজ আর কি হতে পারে। আগে মব করলেন, মবকে রায় বলে চালালেন।
শাহবাগে এই প্রক্রিয়াটাই চালু হল ২০১৩ তে গণজাগরণ মঞ্চের তত্ত্বাবধানে। তারা ফাঁসি চাইল, আদালত ফাঁসি দিল! নজিরবিহীন কাণ্ড!
ফাঁসি প্রাপ্তরা দোষী কি নির্দোষ তা অন্য তর্ক।
উন্নত বিশ্বে যেখানে মৃত্যুদণ্ডকেই অপছন্দ করা হয় সেখানে বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চ ফাঁসি চেয়ে চেয়ে আদালতকে নতজানু করতে বাধ্য করল।
শাহবাগ বাংলাদেশে আইনকে রাজপথে নামিয়ে আনল, বিচারকে স্লোগানে পরিণত করল। ইসলামপন্থী, বাংলাদেশপন্থীদের জন্য আতঙ্ক হয়ে হাজির হল গণজাগরণ মঞ্চ।
গণজাগরণ মঞ্চ হাজির হল ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে।
স্লোগানে, ব্লগে তাদের বিদ্বেষ ছড়াতে থাকল প্রবলভাবে।
এই উগ্র শাহবাগীদের মূহুর্তের মধ্যে আড়ালে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তারা দমন হয়েছিল, শাহবাগ থেকে পালিয়ে ছিল, অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থানে।
হেফাজতে ইসলামের লাখ লাখ কর্মী প্রবেশ করেছিল রাজধানী ঢাকায়। প্রথমে তারা অবরোধ করে ঢাকাকে। প্রবেশপথগুলো দখলে নেয়।তারপর তারা সমবেত হয় শাপলা চত্বরে। সারাদিন শেষে রাতে অবস্থান নেয় লক্ষ জনতা। এই অবস্থানই কাল হয়ে দাঁড়ায় হেফাজতকর্মীদের জন্য।
রাতের আঁধারে তৎকালীন আওয়ামী সরকার হাজার হাজার বুলেট ছুঁড়ে মতিঝিলের পিচঢালা পথ রক্তের নদী করে তাড়িয়ে দেয় হেফাজত কর্মীদের।
এই জমায়েতে ছিল দেশের আলেম ওলামা, নিরীহ ছাত্র, ধর্মপ্রাণ মুসুল্লি। অসংখ্য,অগণিত লাশ সেদিন গায়েব করে সরকারের বাহিনী।
রাস্তার আলোক বাতি নিভিয়ে ভুতুরে পরিবেশে চতুর্মুখী আক্রমনে কত! মানুষ শহীদ হয়েছিল সেদিন তার সঠিক তথ্য আজও অজ্ঞাত। এই সংখ্যাটা জানা জরুরি।
যারা জীবন দিল তারা অজ্ঞাত কেউ নন। তাদেরও সমাজ আছে,পরিবার আছে। ছিল তার একটি পরিচয়। তারা শহীদ হলেন অত্যাচারীর বুলেটে। কে শহীদ হলেন? কতজন শহীদ হলেন তার সঠিক তথ্য জানা গেল না আজও।
শহীদদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা ছিল সময়ের অপরিহার্য কাজ। হয়নি, কিন্তু তা হওয়া জরুরি।
আহত, নিহতদের পক্ষ থেকে খুনি ও জালেমদের বিচার নিশ্চিত করা ছিল জরুরি।
এই তথ্য তালিকা বিচার কার্যের জন্য উপযোগী দলিল । কাজটি করা হয়নি, কিন্তু করা খুব জটিল ছিল না, এখনও সম্ভব।
সহজভাবে করা যায়।
৫ মে ২০১৩ সালে শাপলার ঘটনায় একটি মাদ্রাসা থেকে কতজন ছাত্র নিখোঁজ তা প্রকাশ করা কওমি প্রতিটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের প্রকাশ করা উচিত। এটি একটি উপায়।
হেফাজতের একেবারে ওয়ার্ড কমিটি থেকে কতজন কর্মী শাপলার ঘটনায় নিখোঁজ তা প্রকাশ করা উচিত। ওয়ার্ড যোগ হবে, ইউনিয়ন যোগ হবে, থানা যোগ হবে। এভাবে পরিসংখ্যান আগাবে।
প্রত্যেক গ্রামে শাপলার ঘটনায় কতজন মুসুল্লি নিখোঁজ হয়েছিল তা প্রকাশ করা উচিত।
এইসব সহজ তরিকা একত্র করলেই নিরূপিত হবে শাপলার শহীদের সংখ্যা।
শাপলার শহীদের সংখ্যা প্রকাশ হয়নি, হেফাজত নেতারা প্রকাশ করতে পারেনি সরকারি চাপে, মামলা-হামলার ভয়ে। ভয়, অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতা তাদের গ্রাস করেছে। সব মিলিয়েই তারা এ কাজে ব্যর্থ। অথচ এটিও তাদের ইমানী দায়িত্ব। তাদের ডাকে যারা জীবন দিল, যারা আহত হল, জুলুমের শিকার হল তা পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে হলে সব তথ্য লিখিত হতে হবে। শাপলার অধ্যায় ইতিহাসের গৌরবময় অংশ। প্রেরণার পাথেয়।
বিগত ১২ বছর পরিবেশ ছিল প্রতিকুল।
এখন অনুকুল পরিবেশ। এখন হেফাজত নেতাদের ইমানী দায়িত্ব নিয়ে এই শহীদদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা জরুরি।
প্রত্যেকটা অপরাধের বিচার চাওয়া উচিত। প্রতিটা অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। একেবারে পাড়া মহল্লায় সেদিন কে জালেম ছিল তা সনাক্ত করা উচিত। এরা ইসলাম, মুসলমান, দেশ, জাতির দুষমন।
অধিকার নামক মানবাধিকার সংস্থা ৬৫ জন শহীদের তথ্য প্রকাশ করেছিল। সরকার স্বীকার করেছিল মাত্র গোটা তিন জনের কথা। আদতে সেদিন শহীদ হয়েছে হাজার হাজার।
মেইনস্ট্রিম সংবাদ মাধ্যম সঠিক তথ্য প্রচার করেনি। হাসিনা সরকারের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সত্য প্রচার করার মতো পরিবেশ ছিল না বাংলাদেশে।
ঐ রাতেই বন্ধ হয়ে যায় দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি। বন্ধ করা হয় বহুল প্রচারিত দৈনিক আমার দেশ। গ্রেফতার করা হয় তার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। এর মাধ্যমে সংবাদ জগতকে রেড এলার্ট দিয়ে রাখে সরকার। মিডিয়া সব হজম করে যায়। কোন সত্যই আর প্রকাশ হয়নি।
সরকার
সেদিন শাপলা চত্বরে লক্ষ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে গুলির মাধ্যমে। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয় প্রায় ১৬৫০০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
মেইনস্ট্রিম প্রচার না করলেও ব্লগে লেখালেখি হয়েছে নামে বেনামে।
সামগ্রীক পরিবেশটা অনুধাবন করার জন্য ব্লগের একটি লেখা হুবহু তুলে ধরছি।
‘চিন্তিত দার্শনিকের ব্লগ
শাপলা চত্তর গণহত্যায় ১ লাখ ৬৫ হাজার বুলেট গ্রেনেড টিয়ারশেল ব্যবহার হয়
১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:১৯
শুধু ওপর থেকে নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিল পুলিশ-র্যাব-বিজিবি। একটা ‘ইয়েস কল’ আসার অপেক্ষা মাত্র। কলটি আসা মাত্রই ওরা নড়ছে না। তারপর ওপাশ থেকে যেই বলা হল- ‘আক্রমণে যাও’। এরপরে শুরু হলো সর্বাত্মক আক্রমন!! হাজার হাজার রাউন্ড গুলি টিয়ার গ্যাস ও গ্রেনেড ছুড়ে আগাতে থাকে যৌথবাহিনী।
গোলাবারুদের হিসাব:
৫ মের ওই অপারেশনে প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ খরচ হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের হিসাবে ৮০ হাজার টিয়ার শেল, ৬০ হাজার রাবার বুলেট, ১৫ হাজার শটগানের গুলি এবং ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে পিস্তল এবং রিভলবার জাতীয় ক্ষুদ্র অস্ত্রের গুলি খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩০০ রাউন্ড। সরকারের ৫ মের অপারেশনে র্যাবের ১ হাজার ৩০০ সদস্য, পুলিশের ৫ হাজার ৭১২ এবং বিজিবির ৫৭৬ জন সদস্য সরাসরি অংশ নেয়। এর বাইরে বিজিবির ১০ প্লাটুন ছাড়াও র্যাব এবং পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য ‘স্টাইকিং ফোর্স’ হিসেবে তৈরি ছিল। রাত ২টা ৩১ মিনিটে মূল অপারেশন শুরু হলেও রাত ১২টার পর থেকেই মূলত আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ধীরে-ধীরে শাপলা চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। পুলিশের পক্ষ থেকে ওই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’। র্যাবের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’।
আক্রমণ পরিচালনা :
ঘটনার রাত ১০টার দিকে তার নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল বেইলী রোড দিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন মোড়ে গিয়ে তারা প্রথম ‘ফায়ার ওপেন’ করেন। এ সময় তারা সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছুড়ে জমায়েতে থাকা লোকজনের মধ্যে আতংক সৃষ্টির চেষ্টা করেন। এ সময় হেভি ভেহিকেল মুভমেন্ট করে তাদের মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তিনি জানান, ধীরে-ধীরে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত যাওয়ার পর তারা প্রথম বাধার সম্মুখীন হন। এ সময় এপিসি থেকে একের পর এক গ্যাস চার্জ করা হয়। কিন্তু বাধ সাধে উল্টো বাতাস। বাতাসের কারণে গ্যাস চার্জের পর তারা সামনের দিকে এগুতে পারছিলেন না। এভাবে তারা নটরডেম কলেজ পর্যন্ত যান।
রাত ১টার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছিলেন। সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ার পর রাত দেড়টার দিকে অপারেশনের পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরেই তারা টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে অপারেশনের কৌশল ও প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশ এবং বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। রাত আড়াইটার দিকে শুরু হয় মূল অপারেশন।
অপারেশন শাপলার অজানা কথা :
৫ মে রাত ১০টা। পল্টন মোড় থেকে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত থেমে থেমে পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সংর্ষষ চলছিল। একপর্যায়ে পুরো এলাকা দখলে নিয়ে নেয় পুলিশ। তখন র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেননি। এলাকা দখলে নেয়ার পর পুলিশ চলে যায় মতিঝিল থানার সামনে। এই সময় হেফাজতের নেতাকর্মীরা অবস্থান করে থানা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে। নেতাকর্মীরা মাইকে স্লোগান দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে রাখে। পানির জার ও থালা-বাসন দিয়ে পিটিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। বারবার মাইকে ঘোষণা দিতে থাকেন-পুলিশ বা র্যাব আসলে তাদের কঠোরভাবে প্রতিহত করতে হবে। তাদের কিছুতেই ছাড় দেয়া হবে না। এসব ঘোষণা আসার পর কর্মীরা নানা রকমের স্লোগান দিয়ে পুলিশের দিকে আসার চেষ্টা চালায়। এদিকে অপারেশন শাপলা কিভাবে করা হবে তা নিয়ে পুলিশ-র্যাব ও বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেন।
এরপরে সরকারের হাইকমান্ড নির্দেশ আসে, যতই প্রাণহানি হোক না কেনো হলেও অভিযান চালাতে হবে। রাত সাড়ে ১২টায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়- অভিযান চালানো হবে। র্যাব-পুলিশ জানায়, তিনভাগে ভাগ হয়ে অপারেশন চালানো হয়। একটি অংশ নয়াপল্টন থেকে দৈনিক বাংলা হয়ে শাপলা চত্বরের দিকে, ২য় অংশটি নটরডেম কলেজের সামনের দিক থেকে শাপলা চত্বরের দিকে। আর ৩য় অংশটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হয়ে মূল মঞ্চের দিকে চলে যাবে। আর টিকাটুলি দিকে যাওয়ার রাস্তাটি শুধু খোলা রাখা হয়। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর রাত ২টা ২০ মিনিটে র্যাব সদস্যরা এসে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। আর বিজিবিকে রাখা হয় মতিঝিল জনতা ব্যাংক ভবনের সামনে।
অভিযান চলে যাদের নেতৃত্বে :
অভিযানে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান, র্যাব-১০-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান ও র্যাব-৩-এর অধিনায়ক মেজর সাব্বির, র্যাব-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল কিসমত হায়াত র্যাব- ৪ এর পরিচালক কামরুল আহসান। বিজিবিকে নেতৃত্ব দেন কর্নেল এহিয়া আজম খানসহ ৫ কমান্ডো অফিসার। আর পুলিশের পক্ষে ছিলেন- যুগ্ম কমিশনার শেখ মারুফ হাসান, উপ-পুলিশ কমিশনার (হেডকোয়ার্টার) আনোয়ার হোসেন। তারা মাঠপর্যায়ে সদস্যদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। সবার হাতে থাকে এসএমজি, একে ৪৭ রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।
আইন প্রয়োগকারী সদস্য সংখ্যা :
ওই অভিযানে র্যাবের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০। পুলিশের ছিল পাঁচ হাজার ৭১২ জন। আর বিজিবির ছিল ১৮ প্লাটুন। তাছাড়া যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পিলখানায় প্রস্তুত রাখা হয় বিজিবির আরও ১০ প্লাটুন সদস্য। হামলা রোধ করতে সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে বিজিবি ও র্যাব।
অভিযানের সঠিক সময় :
সিন্ধান্ত অনুযায়ী রাত ২টা ৩১ মিনিটে অভিযান শুরু হয়। প্রথমে পুলিশের ২টি এপিসিকে সামনে রাখা হয়। তারপর র্যাব ও পুলিশ ফায়ার করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুহুর্মুহু টিয়ার শেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু। এ সময় হেফাজতের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়, কোন কর্মী শাপলা চত্বর ছাড়বে না। তারপরও চলে তাদের বিদায়ী ভাষণ। অল্প সময়ের মধ্যে মঞ্চ লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়। একই সঙ্গে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও শটগানের গুলির প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে মতিঝিলসহ আশপাশ এলাকা। গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের তোপের মুখে মঞ্চ ছাড়তে শুরু করে হেফাজতের সদস্যরা। কেউ কেউ চলে যায় টিকাটুলির দিকে। আবার কেউ চলে যায় সোনালী ব্যাংকের ভেতরে, কেউ পাশের ভবনে, কেউ বা অলিগলিতে। হেফাজতের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে র্যাব-পুলিশের পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। অভিযানের সময় প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিসের একাধিক গাড়ি ও কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স। ৪০ মিনিটের মধ্যেই পুরো শাপলা চত্বর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কিন্ত পুলিশ-র্যাব ও বিজিবির অভিযান শেষ হয় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে। অভিযান শুরুর পর থেকেই কন্ট্রোল রুমে থেকে গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ। বিজিবি ও র্যাব মহাপরিচালকও তার বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে-ওয়্যারলেসে দফায় দফায় কথা বলেন। ওই দিন অঘোষিতভাবে সব র্যাব সদস্যের ছুটি বাতিল করে সদর দফতরে ডেকে আনা হয়।
যখন অপারেশন শুরু হয় টেলিভিশন চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়ার রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানরা ছিলেন অনেকটা আতংকে। তাদেরকে একমন স্থল থেকে আধা কিমি দূরে নিয়ে রাখা হয়। তাছাড়া অভিযান শুরু হওয়ার পর হামলার ভয়ে অনেকেই সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তাও করেনি। তাছাড়া ওইদিন দিনের বেলায় হেফাজত কর্মীদের হামলায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হওয়ার পর অন্য সাংবাদিকদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছিল।
রক্তক্ষয়ী সাড়াশি আক্রমনের পরে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা হেফাজত কর্মীদের খুঁজে খুঁজে বের করে গুলি করে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। হাজার হাজার হতাহতের মধ্যে নিহতদের লাশ আইনশৃঙ্খলার কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ট্রাকে করে সরিয়ে ফেলা হয়। সিটি কার্পোরেশনের সুইপার ও ফায়ার ব্রিগেডের হোসপাইপ দিয়ে রাস্তায় জমে থাকা রক্ত পরিস্কার করে সব সাফ করা হয়।
একুশে টিভির ক্যামরোম্যান জানিয়েছেন, লাশের সংখ্যা হবে প্রায় ২৫০০, এমনকি ৫ ট্রাক লাশ যেতে তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। এসময় ভিডিও করার কারনে তাকে ও তার সহকর্মীকে মারধর করে একুশে টেলিভিমনের ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে র্যাব। সময় টিভির কাছে লাশবোঝাই ট্রাকগুলোর ছবি আছে। বেসরকারী হিসাব মতে ২৫ ট্রাক লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মাতুয়াইলের দিকে, ১৬ ট্রাক লাশ যায় পিলখানায়।
এই বর্বরোচিত গণহত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেনি সরকার। বরং প্রেস নোট দিয়ে অবৈধ সমাবেশের জন্য হেফাজতকে দায়ী করেছে। বলা হয়, ঘটনার সময় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি এমনকি কোনো কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। অপরদিকে, দু’দিন আগে হাটহাজারিতে গণমোনাজাতে আল্লামা শফি শাপলা চত্তরের গণহত্যার জন্য সরকারকে দায়ী করে জালিম সরকারকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আল্লাহর গায়েবী মদদ কামনা করেছেন।
মন্তব্য ৯ টি রেটিং +২/-০
মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন
১| ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:২৭
মৃন্ময় বলেছেন: আল্লাহর গায়েবী মদদে সৃষ্ট সব গজবে শুধু আমার মত সাধারণ মানুষই মরছে,হ্যারা সবতো রাজার হালে আছে, কেমনে কি?
এখন আরেকটা গজব আসিতেছে আমার মত আরো কিছু মানুষ গত/অতীত হবে তাতে জালেম সরকার হোক আর হেফাজতে জামাত হোক কারো কোন ক্ষতি হইবনা।
২| ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৩০
সুজন দেহলভী বলেছেন: এতো গোলাবারুদ ব্যবহৃত হলো, মতিঝিলে গোলাবারুদের আঘাত চিহ্ন কৈ ?
১৩ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৬
চিন্তিত দার্শনিক বলেছেন: http://www.jugantor.us/2013/05/12/news0643.htm পড়ে দেখুন এইটা বিএনপি-জামাতের পত্রিকা না
৩| ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৩২
আল্লামা ইকবাল বলেছেন: কোন প্রাণহানি নাকি হয় নাই — এত বুলেট দিয়ে কি তাদের কাতুকুতু দেয়া হয়েছে ?
সরকারের লোক এভাবে নির্লজ্জ্ব মিথ্যা বলল – আর কিছু লোক তারপরও আওয়ামী লীগের সাফাই গাইতেছে । এই মুনাফেক সরকারকে যারা সমর্থন করে -তারাও একই পাপ করে ।
৪| ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৩৪
মোঃ রিয়াজুল ইসলাম (রিয়াজ) বলেছেন: একটি গনতান্ত্রিক দেশের সরকার কি ভাবে এটা করল ভাবতেই পারি না।
তো ভাই লেখার উৎস কি সেটা বললে আর বিশ্বাস যোগ্য হত কারন আমি ভাবতেই পারি না যে একটা যালিম সরকার এই ধরনের একটা গনহত্যা চালানোর পরও আমরা সবাই চুপ করে আছি। আমাদের চুশিলরা আচ চুপ। টিভির খবর দেখিনা গত ৬ তারিখ থেকে কি দেখব সব চ্যানেলই বিটিভি হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের ও একই অবস্থা।
৫| ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৩৬
মোঃ রিয়াজুল ইসলাম (রিয়াজ) বলেছেন: সুজন দেহলভী আঘাতের চিহ্ন যে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা মুছে ফেলছে সেটা কি আপনি পরেননি না আপনি যেগে যেগে ঘুমান। আপনি কি মানুষ না আমলীগ
৬| ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৩৭
মোঃ রিয়াজুল ইসলাম (রিয়াজ) বলেছেন: আপাতত প্রিয়তে নিয়ে রাখলাম তবে আমি সিউর যে পোষ্ট বেশিক্ষন সামুতে থাকবে না। তাই ব্যক কপিও সেভ করে রাখলাম আপনিও ব্যাপআপ নিয়ে রাখেন।
৭| ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৪১
বাঙ্গাল৭১ বলেছেন: মিথ্যা কথা বানানোর সময় কিছু সিষয়ে খেয়াল রাখলে তা অনেকটা সত্যের মত শোনায় ।
একুশে টিভির ক্যামেরাম্যানের জায়গায় এটিএন নিউজ লিখলে অনেকেই বিশ্বাস করত ।
বি: দ্র: বাংলাদেশের এই ২৫০০ হাজার এতিমের মা,বাবা,ভাইেবান, পাড়া প্রতিবেশী এমন কি গ্রামের লোকও নাই যারা দাবী করবে যে তাদের আত্নীয় মারা গেছে ?
পরামর্শ : লেখার সময় গাজা কমাইয়া খাইয়েন
১৩ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৬
চিন্তিত দার্শনিক বলেছেন: http://www.jugantor.us/2013/05/12/news0643.htm পড়ে দেখুন এইটা বিএনপি-জামাতের পত্রিকা না
©somewhere in net ltd.’
অপরাধের পরিমাণ, ধরণ জানা থাকলে শাস্তি চাইতে সুবিধা হয়।
বিচারের ম্যারিট উপস্থাপন করতে সহজ হয়।
লক্ষাধিক গুলির পরিসংখ্যান তৎকালীন সময়ে পত্রপত্রিকাতেও প্রকাশ হয়। আমার ম্মৃতি বলছে দৈনিক যুগান্তরে এ ধরণের রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল।
সেদিন শাপলায় একত্রিত হয়েছিল লক্ষ জনতা। এই লক্ষ জনতার সমাবেশে ছোঁড়া সব গুলি হাওয়ায় মিশে গিয়েছিল? সরকারী তথ্য মতে কোন হতাহত হয়নি তা বিশ্বাস করার মতো নির্বোধ দেশে আছে!
শাপলার ভুক্তভোগীরা তথ্য প্রকাশ করুন। হেফাজত নেতারা তা একত্রিত করে জাতীর সামনে সমগ্র সত্য তুলে ধরুন। প্রতিটা হত্যার বিচার চান।এটাই সত্যের দাবি। নতুবা ব্লগ বা অনত্র প্রচলিত কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করাও হেফাজত নেতাদের আংশিক দায়িত্ব হলেও আছে।
শাপলায় হেফাজতের সমাবেশের সময় ইন্টারনেট আজকের মতো এতো সহজলভ্য ছিল না। ছিলাম সারাদিন টিভির সামনে।
আমার কাছে মনে হয়েছিল ঢাকা অবরোধে ঢাকার প্রবেশপথগুলো ছেড়ে শাপলায় জড়ো হওয়া ছিল হেফাজতের প্রথম ভুল। তারা সরকারের ফাঁদে পা দিয়ে ফেঁসে গিয়েছিল। রাতে অবস্থান ছিল আরেকটি ভুল।
নেতৃত্বের অরাজনৈতিক জনবল ছিল পরিস্থিতি মোকাবেলার ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বাত্মক সহযোগিতার অভাব ছিল আরও একটি কারণ।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমন্বয় বা সহযোগিতা নিশ্চিত করতে না পারা ছিল দুর্ভাগ্য।
যে কারণেই হোক শাপলার ট্রাজেডি আওয়ামী লীগকে পরবর্তী সময় আরও জবরদস্ত আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। ইসলামপন্থীদের উপর, ইসলামী লেবাসীদের উপর নেমে আসে নির্যাতন,তৈরী হয় চরম বৈরী পরিবেশ।
শাপলার ব্যর্থতায় ফ্যাসিবাদ হয়ে ওঠে দুর্দমনীয়। এর শাস্তি সকলকেই ভোগ করতে হয়।
তারপর সরকার কওমী আলেমদের একটি অংশকে অনুগত করে ফেলতে সক্ষম হয়। তারা তোষামোদে ভাসিয়ে দেয় হাসিনাকে। খুনির গলায় পরায় কওমি জননীর তকমা।
২০১৩ থেকে ২০২৫ সাল দীর্ঘ সময়।আজও প্রকাশ পায়নি শাপলা শহীদদের নামের তালিকা। বিচার আর হবে কী!
সব সত্য প্রচার হোক।শহীদের পরিবার বিচার পাক,আহতরা,ক্ষতিগ্রস্তরা বিচার পাক,পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালু হোক সকল স্তরে। হেফাজত নেতা, সাধারণ মুসুল্লির নামে ঐসময়ে করা মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার হোক।
এবং চিহ্নিত হোক শাপলার সঙ্গে যেসকল কওমী অকওমী, আলেম, মুসুল্লি,নেতা আওয়ামী দোসর হয়েছিল তারা। চিহ্নিত হোক শাপলার শত্রু ও গাদ্দাররা। এইটা এই সময়ের উপযুক্ত দাবি।
শাপলা নিয়ে, ট্রাজেডি নিয়ে,বিশাল গণ জমায়েত শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার নানা কারণ নিয়ে হতে পারে বহুবিদ আলাপ। শহীদদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন সেসব আলাপের একটি।
বিচার ত্বরান্বিত করা আরেকটি আলাপ। হেফাজত কেমন নেতৃত্বে পূরণ করতে পারবে সময়ের চাহিদা আলাপের অংশ এসবও।
শাপলা এদেশের মুসলমানদের জন্য ট্রাজেডির ভেতরেই বড় একটি গৌরবময় ইতিহাস।এ ইতিহাস প্রচার করতে হবে।থাকতে হবে সত্যের সংরক্ষণ। রক্ত দান ও আত্মত্যাগের ইতিহাস জাতীকে উজ্জীবিত করে। হেফাজতকর্মীরা তাদের শহীদ ভাইদের খুনিদের বিচার চেয়ে সোচ্চার হোক। পরিচয় জানুক ভাই তার ভাইয়ের। নেতারা গাফেল হলে কর্মীরা সোচ্চার হোক। গাফিলতি দূর হবে। সময় এখনই। সময়ে করতে হয় সময়ের কাজ।অসময়ে হা-হুতাশ করে কোন ফায়দা নাই।
হেফাজত ইসলামের কর্মী ও সমর্থকদেরকে নির্বিচার হত্যা, নিষ্ঠুর নির্মমতার সব উৎসকে ছাড়িয়ে গেছে। আশেপাশের মানুষদের মধ্যে অমানুষিক হিংস্রতার আতংক ছড়িয়ে চুপ করানো হয়েছিল। অনেক পত্রিকা লিখেছিল বর্বরতম এই হত্যা সম্পর্কে। জনগন তাঁর অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতেই পারে। তাই বলে জনগনের রক্ষক কোন সরকার এভাবে রাতের আঁধারে রাষ্ট্রের সমস্ত অস্ত্রধারী বাহিনীকে নিরীহ মানুষের ওপর লেলিয়ে দিতে পারে?—এটা অবশ্যই ইতিহাসের নারকীয় বিভৎস ঘটনা। আর এজন্য ফ্যাসী-সরকার চিরকাল ধিকৃত হবে, নিক্ষিপ্ত হবে আস্তাকুঁড়ে।
হেফাজতের কাজ হওয়া উচিত, এক এক করে তালিকা প্রনয়ন করে জনসমক্ষে প্রচার করা।