spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধসমকালীন আফগানিস্তানের কবিতার রূপরেখা : তিন

লিখেছেন : মাসুদুল হক

সমকালীন আফগানিস্তানের কবিতার রূপরেখা : তিন

মাসুদুল হক

গ. যুদ্ধের কষ্ট ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি:

আফগান কবিতায় দীর্ঘকালীন যুদ্ধের পরিণতি, উদ্বাস্তু সমস্যা, পরিবার-বিচ্ছেদ এবং মানুষের আবেগময় কষ্টের অভিব্যক্তি দেখা যায়। কবিরা সাধারণ জনগণের ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন। যুদ্ধের কষ্ট এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আফগান কবিতায় বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। আফগানিস্তানে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে কবিরা তাদের কবিতায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার নানা কঠিন মুহূর্তের অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন। বিশেষত, উদ্বাস্তু সমস্যা, পরিবার-বিচ্ছেদ, এবং মানুষের গভীর কষ্ট এসব বিষয় আফগান কবিদের কবিতায় ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে। আফগান কবিদের কবিতার মাধ্যমে আমরা মানবতার প্রতি তাদের সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও দুঃখের চিত্র দেখতে পাই।এখানে কয়েকজন আফগান কবির কবিতা এবং তাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. সামসুর রহমান ফরুজি (Samsur Rahman Farooqi) আফগানিস্তানের একজন বিশিষ্ট কবি, লেখক এবং সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি ১৯৩০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তানের কাবুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৮সালে মৃত্যুবরণ করেন। ফরুজি আফগান কবিতার ক্ষেত্রে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন, তার কবিতায় আফগান সমাজের বাস্তবতা, যুদ্ধের করুণ পরিস্থিতি, মানবিক দুঃখ এবং সংগ্রামের বিষয়গুলি গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।
ফরুজির কবিতায় যুদ্ধের পৈশাচিকতা, মানুষের মধ্যে সহানুভূতি ও ভালবাসার অভাব, এবং দুঃখ-কষ্টের চিত্র পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। তার কবিতায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধ, যুদ্ধে নিঃশেষিত শহর, নারী ও শিশুদের কষ্ট এবং তাদের সংগ্রাম প্রকাশ পেয়েছে।তিনি কবিতায় লেখেন:
“কোথায় সেই শান্তির গান, কোথায় সে দিনের আলো,
যুদ্ধের আগুনে ছাই হয়ে গেছে, সব কিছু, সব কিছু।
মৃত্যু আসে আজকাল ভালোবাসা ছাড়া,
হাসি হারিয়ে গেছে, কষ্টেরা নতুন পদ্ধতিতে আছড়ে পড়ে।”
এই কবিতায় ফরুজি যুদ্ধের কারণে আফগানিস্তানে সৃষ্ট ধ্বংস, হতাশা এবং মানবিক সংকটের দিকটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধের পরিণাম কিভাবে মানুষের হাসি, ভালোবাসা এবং শান্তিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তা তার কবিতার মূল ভাবনা।
সামসুর রহমান ফরুজির কবিতায় যুদ্ধ, উদ্বাস্তু সমস্যা, এবং মানুষের কষ্টের বিষয়াবলি প্রবলভাবে যেমন উপস্থিত ,তেমনি তাঁর কবিতায় আফগানিস্তানের জনগণের ভোগান্তি এবং মানুষের যন্ত্রণা চিত্রিত। তাঁর এই ধারার একটি কবিতার অংশ এরকম:
“এরা আমাদের শহর পুড়িয়েছে,
এরা আমাদের সারা জীবন ছিন্নভিন্ন করেছে।”
এখানে যুদ্ধের পরিণতি এবং তার ভয়াবহতা উঠে এসেছে।

২. মাহমুদ কাবুলী(Mahmud Kabuli) আফগানিস্তানের একজন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক, যিনি তাঁর কবিতায় আফগান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, যুদ্ধের কষ্ট, মানবিক অনুভূতি এবং সংগ্রামকে অত্যন্ত গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি ১৯১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি আফগানিস্তানের কাবুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
মাহমুদ কাবুলী তাঁর কবিতায় যুদ্ধের ফলে আফগান সমাজে যে শোচনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা তুলে ধরেন। তাঁর কবিতাগুলিতে আক্ষেপ, ক্ষোভ, দুঃখ, এবং আশা সবকিছুই মিশে থাকে। বিশেষভাবে আফগানিস্তানের দীর্ঘকালীন যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘর্ষের প্রভাব তাঁর লেখায় স্পষ্ট। তিনি যুদ্ধের বিপর্যয়, মানুষের কষ্ট ও ভয়াবহ পরিস্থিতি ব্যক্ত করেছেন।
মাহমুদ কাবুলীর কবিতায় যুদ্ধের কষ্ট এবং মানবিক অনুভূতির মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক দেখা যায়। যুদ্ধ শুধু রাষ্ট্র বা জাতির জন্য বিপর্যয় আনে না, এটি ব্যক্তিগত জীবনে অগণিত শোক, দুঃখ এবং অনিশ্চয়তা নিয়ে আসে। তাঁর কবিতায় এসবের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লিখেছেন:
“সত্যিকারের যুদ্ধে, কোনো বিজয়ী থাকে না,
শুধু ক্ষতবিক্ষত আত্মা আর অশ্রুসিক্ত চোখ থাকে।”
যুদ্ধের ফলস্বরূপ মানুষের যে আধ্যাত্মিক ক্ষতি হয়, তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই যে, তিনি একদিকে যেমন মানবতার প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন, তেমনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তিনি জানতেন যে, যুদ্ধ একেবারেই শত্রুদের না, বরং নিজের জনগণের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।আরেকটি উদ্ধৃতি:
“যুদ্ধের শব্দ নয়,
এটি বেদনায় ভরা শ্বাসের আওয়াজ,
প্রতিটি গৃহের প্রতিটি কোণে
কান্না আর রক্তের নিঃশব্দ ঝর্ণা।”
এটি স্পষ্টভাবে যুদ্ধের বেদনাদায়ক চিত্র এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে। কবি এই যন্ত্রণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানুষের ভেতরের অশান্তি, নীরব কান্না, এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির কষ্ট ফুটিয়ে তুলেছেন।

৩. আতাল্লা মুজাদ্দেদি( Atallah Mujaddedi)
আফগানিস্তানের একজন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। তিনি ১৯৪৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তানের কাবুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৮ সালের ১৫ জুন মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর কবিতায় আফগানিস্তানের দীর্ঘকালীন যুদ্ধ, নির্যাতন এবং মানবিক বেদনা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি তাঁর কবিতায় এমন একটি সময়ের চিত্র অঙ্কন করেছেন যেখানে সাধারণ মানুষ এবং শিশুদের জীবন যুদ্ধের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তার কবিতায় মানবতার প্রতি সহানুভূতি ও মর্মস্পর্শী অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। তিনি যুদ্ধকে শুধু একটি শারীরিক ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে দেখেননি, বরং তিনি একে মানবতার সংকট ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক হিসেবে তুলনা করেছেন। তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যাক:
“যুদ্ধের বীভৎসতা, মৃত্যুর কান্না,
শোকের সমুদ্র
—এ সব কিছু ছিঁড়ে ফেলতে আমি চাই।”
এখানে মুজাদ্দেদি যুদ্ধের তীব্রতার সাথে মানবতাবাদী একটি আহ্বান জানাচ্ছেন, যেখানে তিনি কষ্ট ও শোকের অবসান চান।
অন্যত্র তিনি লেখেন:
“কত মানুষ হারালাম,
কত কিছু দেখলাম,
কিন্তু যুদ্ধের পর আমি জানলাম—
মানবতা কখনও হারায় না।”
– এই কবিতায় যুদ্ধের পরেও মানবিক চেতনা ও আশার উপস্থিতি তুলে ধরেন তিনি। এতে যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের যে ক্ষতি হয়, তার সঙ্গে মানবিক চেতনা বিজয়ী হওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
আতাল্লা মুজাদ্দেদি তার কবিতার মাধ্যমে আফগান জনগণের সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং শক্তির কথা বলেছেন। যুদ্ধের কষ্টের মাঝে তিনি ঐক্য এবং মানবিক সংহতির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন।
৪.ফজলুল্লাহ ওয়ায়েন (Fazlullah Wayan; ১৯৪৭-১৯৯১)আফগানিস্তানের একজন খ্যাতনামা কবি ছিলেন, যিনি তার কবিতায় আফগানিস্তানের যুদ্ধ, কষ্ট, এবং মানবিক অনুভূতিগুলোর চিত্র অঙ্কন করেছেন। তার কবিতা গভীরভাবে জাতীয় ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলনের পাশাপাশি তিনি আফগানিস্তানের যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজের প্রতি এক ধরনের মর্মস্পর্শী প্রতিবাদও করেছেন। উদাহরণ:
“যুদ্ধের সাথে, আমাদের জীবন চিরতরে পরিবর্তিত,
ভাগ্য আমাদের ক্ষতবিক্ষত করেছে,
এখন আমরা কোথায় যাব?”
তিনি কেবল আফগান যুদ্ধের শিকার মানুষের কষ্টের কথা বলেননি, বরং সেইসব লড়াইয়ে মানবিকতার জয়দর্পণও করেছেন। তিনি লেখেন:
“ভাঙন, রক্ত, আর অশ্রুর মাঝে
একটি ছোট্ট ফুল যেন আশা হয়ে উঠে।”
এখানে যুদ্ধের বিপর্যয়ের মধ্যেও একে অপরকে ভালোবাসা এবং মানবিকতা রক্ষার আহ্বান প্রতিফলিত হয়েছে।
এছাড়া, আফগান কবিদের কবিতায় উদ্বাস্তু সমস্যা, পরিবার-বিচ্ছেদ এবং যুদ্ধের ফলে মানুষের অভ্যন্তরীণ কষ্টের চিত্র এক গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। তাদের কবিতাগুলি মানবতার বেদনা ও যুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্র প্রস্থাপন করে, যা সারা বিশ্বে পাঠকদের কাছে যুদ্ধের বিভীষিকা এবং মানুষের কষ্টের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করে।

[ চলবে ]

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প