আহমাদ মাযহার
শঙ্খ ঘোষের ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’, শিশিরকুমার দাশ ও শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ ও স্পেন’ এবং কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ আমাদের পড়া হয়ে গিয়েছিল আশির দশকেই। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সে পড়া ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনতথ্য জানবার অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়ার মতো! কিন্তু রাজু আলাউদ্দিন একটু অন্য ধাতের মানুষ। তিনি পূর্বকথিত দিকপালদের বইগুলো পড়ে থেমে যাননি। স্পানঞল ভাষায় গোটা রবীন্দ্র বিশ্বকে আবিস্কার করেছেন। সে আবিস্কারে কেবল নিজে বিস্মিত হয়ে থেমে থাকেননি। সে বিস্ময়ের ভাগ আমাদেরও দিতে চেয়েছেন। রাজু আলাউদ্দিন সার্বক্ষণিক লেখক অনুবাদক ও গবেষক, এবং তিনি অক্লান্ত! এ কথা মনে হলো তাঁর দক্ষিণে সূর্যোদয়: ইস্পানো আমেরিকায় রবীন্দ্র চর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ বইটা নেড়ে চেড়ে দেখতে গিয়ে। দেখলাম বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধ পত্রিকান্তরে পড়া হয়েছিল বটে কিন্তু তাঁর রবীন্দ্র-আবিস্কার বিপুল এবং নতুন। রবীন্দ্রনাথ যে স্পানঞল ভুবনে এতটা বিখ্যাত একজন মানুষ তা রাজুর বইটা না পড়লে জানা সম্ভব হতো না! ‘দক্ষিণে সূর্যোদয়’ বইটি সেই রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়ে দেয়! রাজুর স্পানঞল রবীন্দ্রনাথ এতটা বিস্তৃত ও গভীরভাবে আলোচিত যে স্বল্পসময়ে তা বোঝাই সম্ভব নয়! তাই সে চেষ্টায় ক্ষেমা দিলাম!
২.
রবীন্দ্র গবেষক কথাটা বললে আমাদের সাধারণত রবীন্দ্র পুজারীদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে রবীন্দ্রান্ধ ভক্তকুলের কথা। ফলে রাজুকে রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ বললে সেই কাতারেই তাঁকে ফেলে রাখা হবে যা আমি চাই না! তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত এবং আংশিক অনূদিত ‘রবীন্দ্রনাথ: অন্য ভাষায় অন্য আলোয়’ বইয়ে আমরা পাই ভিন্ন এক রবীন্দ্রনাথকে। কারণ অন্য ভাষার ও অন্য আলোয় রবীন্দ্রনাথকে দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে রাজু আলাউদ্দিনের সাধকস্বভাবের জন্য! বিভিন্ন ভাষার লেখকেরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যে এত কথা বলেছেন তা জানা সম্ভব হয়েছে রাজুর জন্য! এরকম একজন মানুষকে রবীন্দ্রান্ধ ভক্তদের মতো স্থূলতাবিহারীদের দলে ফেলা যায় না।
৩.
ক্যালেন্ডার নির্দেশিত তারিখ অনুসারে রাজু আলাউদ্দিন রবীন্দ্রনাথের দুইদিন আগে জন্মেছেন। বাঙালিদের আনুষ্ঠানিক উদযাপন-সংস্কৃতিতে প্রাতিষ্ঠানিক আবহে, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে কিংবা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন এতটাই প্রাসঙ্গিক যে অন্য আরো উদযপনেরও যে গুরুত্ব আছে তা আমরা বিস্মৃত হই! রাষ্ট্রাচারে মূলত বাংলা সনের নির্দেশনার উপস্থিতি নিয়ম রক্ষার বেশি না হলেও রবীন্দ্র জন্মসূত্রে বাংলা সনের প্রাসঙ্গিকতা বেশি বলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আটই আগস্ট নয় পঁচিশে বৈশাখের কথা আমাদের মনে পড়ে। কিন্তু রাজুর জন্মদিন সূত্রে তেইশে বৈশাখের কথা মনে পড়ে না। রাজু আলাউদ্দিনের জন্মদিন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখের তাৎপর্য এই যে, আমাদের রবীন্দ্রনাথকে যেমন প্রয়োজন তেমনই মনে রাখা দরকার রাজু আলাউদ্দিনকেও! কারণ সমকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যের ভুবনে ‘নিমগ্ন সাহিত্যিক সত্তা’র সৃজনশীল উৎসারণে রাজু আলাউদ্দিন একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম!
রাজু আলাউদ্দিন প্রসঙ্গে ‘নিমগ্ন সাহিত্যিক সত্তা’ কথাটি যে ব্যবহার করা হলো তার একটি নিগূঢ় কারণ আছে। আমাদের সাহিত্যে হয়তো মেধাবী মানুষ কিছু আছেন যাঁরা সুশৃঙ্খল বৌদ্ধিকতায় এমন কিছু রচনা করতে সক্ষম যা হয়তো আয়োজনে নিখুঁতের কাছাকাছি, সরলভাবে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে থাকে। উপস্থাপনের নিপুণতা ও দক্ষতায় হয়তো তাঁদের বেশ সৃষ্টিশীলও মনে হয় কিন্তু তাঁদের সত্তা খনন করতে গেলেই ধরা পড়বে হয় তাঁরা আপাত জনপ্রিয় কোনো আদর্শের ফ্রেমবন্দি না হয় ক্ষমতা কাঠামোর সূক্ষ্ম সমর্থনে আত্মবিক্রয়কারী! বড় বড় মাধ্যমে তাঁদের কণ্ঠনাদকে বহুগুণিত বিষ্ফারে ব্যঘ্রগর্জনে রূপান্তর করা হয় বলে তাঁদের উপস্থিতি যতটা প্রবল মনে হয় নিমগ্ন সত্তাকে হয়তো ততটা চোখে পড়ে না! যদিও বহুপ্রজতাসূত্রে রাজু আলাউদ্দিনকে এখন আর স্বল্পনিনাদকণ্ঠ মনে করার কারণ নেই তা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতাকাঠামোর প্রযুক্তি প্রভাবিত বিষ্ফারপ্রক্রিয়ার বাইরে থাকেন বলে হয়তো কিছুটা চাপা পড়ে যান! কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারি রাজু আলাউদ্দিন আমাদের সময়ের অন্যতম প্রকৃত ‘নিমগ্ন সাহিত্যিক সত্তা’!
প্রশ্ন হলো ‘নিমগ্ন সাহিত্যিক সত্তা’ কে? নিমগ্ন সাহিত্য সত্তা তিনি যিনি তাঁর সচেতন ও অচেতন উভয় সত্তার দ্বারা নির্দেশিত সাহিত্যিক! তিনিই নিমগ্ন সাহিত্যিক সত্তার অধিকারী যাপিত জীবনের সকল বাস্তবতাকে নিয়ে ও অতিক্রম করেও যাঁর সাহিত্যিক সত্তা মাথা উঁচিয়ে থাকে! তিনি দক্ষতায় হয়তো কোনো কোনো আদর্শ নির্দেশিত, ক্ষমতাবান অথবা আপাত সফল সাহিত্যিকের চেয়ে কম দৃশ্যমান থাকতে পারেন তাঁর সার্থকতাকে উপলব্ধির মানুষেরা অন্তরালবাসী হতে পারেন, সেই সাহিত্যিক নিজেও থাকতে পারেন কম উল্লিখিত বা অনুল্লিখিত; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই সাহিত্যকে সত্তায় নিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেন। রাজু আলাউদ্দিন তাঁদেরই স্বল্পসংখ্যকদের একজন! রাজু আলাউদ্দিন তাঁদেরই প্রতিনিধি। সাহিত্যিকতায় তাঁরা অর্জুনচক্ষু বলে ওপরিতল জাগতিকতায় তাঁদের কখনো কখনো আপাত ভ্রান্তও মনে হতে পারে, মনে হতে পারে ব্যর্থও; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্রিক! রাজু আলাউদ্দিন আমাদের তেমনই একজন ‘নিমগ্ন সাহিত্যিক সত্তা’!
জন্মদিনের শুভলগ্নে তাঁকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই!