spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধসমকালীন আফগানিস্তানের কবিতার রূপরেখা : চার

লিখেছেন : মাসুদুল হক

সমকালীন আফগানিস্তানের কবিতার রূপরেখা : চার

মাসুদুল হক

ঘ. মুক্তচিন্তা ও ধর্মীয় প্রভাব:

ধর্মীয় ভাবনা ও আধ্যাত্মিকতা আফগান কবিতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি নাস্তিকতা এবং সামাজিক উন্নতির ধারণাও উঠে আসে।
আফগান কবিতা ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় ভাবনা ও আধ্যাত্মিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও, আধুনিক যুগে নাস্তিকতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, এবং সামাজিক উন্নতির ধারণা কবিতায় ফুটে উঠেছে। এ পরিবর্তনগুলি বিশেষত আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। কিছু আফগান কবি তাদের কবিতায় ধর্মের প্রতি আস্থাহীনতা, সমাজের অবক্ষয় এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছেন। উল্লেখ্য, মুক্তচিন্তার এই ধারা আফগানিস্তানের কবিতায় উত্তরাধিকার সূত্রে এসেছে ওমর খৈয়ামের দর্শনমনস্ক কবিতার ধারা থেকে। কবিতায় এ ধারা আলোচনার জন্য আমরা সমকালীন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য আফগান কবির কবিতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করছি।
১.আহমদ শামস (Ahmad Shams) আফগানিস্তানে আধুনিক কবিতার এক গুরুত্বপূর্ণ কবি ও লেখক, যিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে সমাজ, ধর্ম এবং নাস্তিকতার বিষয়ে গভীর চিন্তা প্রকাশ করেছেন;তাঁর কবিতায় ধর্ম এবং নাস্তিকতার প্রতি তাঁর অবস্থান স্পষ্ট। তিনি একদিকে ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। শামসের কবিতায় মানুষের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা এবং ধর্মীয় শাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ স্পষ্টভাবে উঠে আসে। উদাহরণ:
“ধর্মের কপালে লেখা একটাই কথা—
জীবন নয়, মৃত্যুর পরেই তোমার সঠিকতা।
কিন্তু আমি বলি, জীবনটাই অমূল্য,
মৃত্যু পরবর্তী কিছু নেই,
এই অন্ধ বিশ্বাসের ছক ভাঙতে চাই।”
কিংবা:
“বিশ্বাসের বন্দী নয় আমি,
যেই আলোর পেছনে ছুটে চলে সে
আলোকেই আমার পথ।
আমি বিশ্বাস করি, কেবল পৃথিবী এবং মানুষ—
বাকিটা কিছুই নয়, এটি মিথ্যে, এক জাল!”
এই উদ্ধৃতিগুলি প্রমাণ করে যে, শামস তাঁর কবিতায় নাস্তিকতা এবং ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তাঁর লেখায় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ এবং মানবিক স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার প্রতি একটি সমর্থন স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তিনি সমাজের প্রথাগত ধর্মীয় ধারণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন এবং মানুষের আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীন চিন্তা আরও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।

২. সালিম আতশ (Salim Atash)আফগানিস্তানের আধুনিক কবি, যিনি ধর্মীয় প্রচলিত ভাবনার বাইরে গিয়ে সমাজের পরিবর্তন এবং নৈতিকতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।তিনি ১৯৪৩ সালের ২২ মার্চ আফগানিস্তানের কাবুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৩ সালে ১ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।তার কবিতায় ধর্মীয় প্রথা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা অন্তর্নিহিত প্রতিবাদ রয়েছে। তিনি তার কবিতায় লিখেছেন:
“আমার বিশ্বাস, ঈশ্বর কোনো আলাদা শক্তি নয়,
প্রতিটি মানুষের মাঝে তার পরিচয়—
তবে যে ধর্মের জন্য যুদ্ধ, সে ধর্ম নয়।”
এখানে তিনি ধর্মের ভুল ব্যবহার এবং সামাজিক অশান্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
সালিম আতশের কবিতায় মুক্তচিন্তা ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ভূমিকা দেখা যায়। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাজনৈতিক অসঙ্গতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর কবিতার মধ্যে ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে একটি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন চিন্তা চর্চার বার্তা ফুটে উঠেছে।
তাঁর কবিতাগুলোতে সাধারণত এমন থিম উঠে এসেছে যা মানুষের স্বাধীনতা, সমাজের অন্ধকার দিক এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে। একাধিক কবিতায় তিনি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছেন। যেমন, তাঁর একটি কবিতায় তিনি বলেন:
“ধর্মের নামে মানুষের জীবন কেন বারবার কেটেছে, প্রশ্ন করতে কি আমাদের প্রাপ্য নয়?
না কি আমরা সবাই পুতুল,
যাদের প্রতিটি আঙুল ঘোরায় ধর্মের অশুভ সুতোর খেলা?”

৩. এহসানুল্লাহ আফজাল (Ehsanullah Afzal; ১৯৪৭-১৯৮০) একজন প্রখ্যাত আফগান কবি এবং সাহিত্যিক, যিনি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তচিন্তা প্রচারের জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁর কবিতায় তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার এবং সমাজের নানা অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞান এবং আধুনিকতা রক্ষার কথা উঠে আসে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সমাজের অন্ধবিশ্বাসের ফলে মানুষের মুক্তি বাধাগ্রস্ত হয় এবং সত্য ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন। তাঁর কবিতার দৃষ্টান্ত:
“ধর্মের নামে যত নির্দয়তা,
মানুষের জীবনে অন্ধকারের আবরণ,
ঐ অন্ধকার ভেদ করেই তো
মুক্তির আলো আসবে, দেখবে সবাই।”
এখানে তিনি ধর্মের নামেও অন্ধবিশ্বাস এবং নির্দয়তা দেখানোর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং সমাজের অন্ধকার ভেদ করার জন্য মুক্তি ও আলোর প্রত্যাশা করেন।
অন্যত্র লেখেন:
“যখন আমরা মুক্তি পাবো,
চিন্তা ও বিশ্বাসে হবে স্বাধীনতা।
ভয় নয়, নিজে চিন্তা করে পথ চলা,
এই সত্যটা চিরকালই অমলিন।”
এই কবিতায় তিনি মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তার মতে, ব্যক্তি যদি নিজের চিন্তা শক্তির ওপর ভরসা করে, তাহলে সে সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হতে পারবে।
আধুনিক আফগান এই কবি, প্রচুর ধর্মীয় মুক্তি ও নাস্তিকতার ধারণা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তিনি ধর্মীয় ভন্ডামি এবং অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখেন:
“ধর্মের নামে যে দ্বন্দ্ব, তা কখনো শেষ হবে না,
যখন সবাই বুঝবে, ঈশ্বর আমাদের ভিতরে।
এটাই আসল পথ, বাকি সব তো কিছুই নয়।”
এখানে তিনি ধর্মীয় দ্বন্দ্বের সমালোচনা করছেন এবং মানুষকে অভ্যন্তরীণ জ্ঞান ও যুক্তির দিকে অবগাহনের আহ্বান করছেন।
আফগান কবিতায় ধর্মীয় ভাবনা ও আধ্যাত্মিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে সাম্প্রতিক কবিতায় আমরা নাস্তিকতা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ধারণাগুলিকে আরও বেশি স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। ঐতিহাসিকভাবে ধর্ম আফগান কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু আধুনিক কবিরা সমাজের সমস্যাগুলি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করছেন।

[ চলবে ]

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প