খোরশেদ মুকুল
‘জন্মদিনে সত্যিকার অর্থেই তার কথা ভীষণ মনে পড়ছে যার কাছে মরণের পরে চলে যাবো। সেই মহান আল্লাহকেই সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছি। জীবনে কতো কিছুই না করেছি, গান গেয়েছি, লিখেছি, দুষ্টুমি করেছি, আরো কতো কী। এখন সব খেলা শেষ। তাই খেলা শেষের আগে যার কাছে যাব তার কথাই ভাবছি। আল্লাহ বলেছেন মানুষকে ভালোবাসতে, মানুষের পাশে থাকতে। সেই চেষ্টাটাই করি আমি সবসময়। আর এই দেশে সবাই যেন মিলেমিশে থাকতে পারি। মনে মনে এই দোয়াই করি পরপারে যেন আমার বাবার সঙ্গে দেখা হয়।’ নিজের আশিতম জন্মদিনে এভাবেই জীবনের উদ্দেশ্য আর প্রত্যাশা অবলিলায় ব্যক্ত করেন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের পুত্র একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, প্রবন্ধকার, ঔপন্যাসিক, গবেষক, সম্পাদক, সংগ্রাহক, উপস্থাপক, সমাজসেবক, ব্যবসায় নির্বাহী, অনুবাদক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী। বরেণ্য এই সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব শিল্প—সাহিত্য—সংস্কৃতির প্রায় সব শাখায় সমানভাবে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করেন বাংলা—ইংরেজি—উর্দু—এ তিন ভাষাতেই।
বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে নায়ক হবে, পেয়েছিলেন প্রস্তাবও। পরিচালক এহতেশাম তাঁকে দেখে একবার সিনেমায় নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজি হননি তিনি। নায়ক না হলেও প্রায় পাঁচ যুগ ধরে তিনিই লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে মাতিয়ে রেখেছেন আমাদের সংগীতভুবন। তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ মুহাম্মদ হোসেন খসরু, ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খানসহ বিখ্যাত অনেক সংগীতগুরুর কাছে। নিয়েছেন ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম। তাঁর কণ্ঠে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদী, চটকা, মারফতী, বাউল, হাসনগীতিসহ প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার মাঠেঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানাঢঙের লোকগীতি বিশেষ ব্যঞ্জনা পায়। তাঁর অন্যতম আগ্রহের ব্যক্তি মুসলিম জাগরণের কবি, জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বিশ্বাস করেন, কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রচনার মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে যত আহ্বান জানিয়েছেন, ইসলামের মহত্ত্ব প্রচারে যে অবদান রেখেছেন, তা যদি যথাযথভাবে এবং সঠিক উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে পৌঁছানো যায়, তবে জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক, কবি জালালউদ্দিন রুমির মতোই সবাই কাজী নজরুল ইসলাম ও তার চিন্তাকে সাড়ম্বরে গ্রহণ করবেন। তাই তিনি নজরুল সংগীতের কেবল প্রসারই নয়, সামগ্রিকভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে কাজী নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে জানাতে, বিশেষ করে তার সমগ্র রচনাপাঠে আগ্রহী করে তুলতে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা এককথায় অসাধারণ—অতুলনীয়।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী ১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের কুচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ২ ভাই ১ বোন। বড় ভাই সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, বোন কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসী। পিতা আব্বাস উদ্দীন আহমেদ পল্লীগীতি সম্রাট। ইসলামী গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ইত্যাদি সঙ্গীত সাধনায় তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ শিল্পী। এদেশের পল্লীসঙ্গীতকে তিনিই প্রথম বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় করেছেন। তাঁর সুরেলা সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়েছেন মহাচীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক রাষ্ট্রনায়ক। চাচা আব্দুল করিম ছিলেন পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি গানের জনপ্রিয় শিল্পী। স্ত্রী আসমা আব্বাসী এবং দুই কন্যা সামিরা আব্বাসী ও শারমিনী আব্বাসীকে নিয়ে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর এক সুখের সংসার। ব্যক্তিজীবনে প্রত্যেকেই স্ব—স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। আসমা আব্বাসী শিক্ষাবিদ এবং একজন গুণী লেখক হিসেবে পাঠকসমাজে সুপরিচিত। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাতিজি তিনি।
এ পর্যন্ত মুস্তাফা জামান আব্বাসীর প্রায় ৫০টির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রন্থের একাধিক সংস্করণও বের হয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো—‘মোহাম্মদ স.—এর জীবনী’; ‘মুহাম্মদের নাম’; জালালউদ্দীন রুমীর কবিতার অনুবাদ ‘সুফা কবিতা’; বাংলার ভাওয়াইয়া গান ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’; প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড; মাওলানা রুমীর জীবনী ভিত্তিক উপন্যাস ‘রুমীর অলৌকিক বাগান’; শিল্পী—লেখকদের জীবনী ‘জীবন নদীর উজানে’; সংগীত বিষয়ক প্রবন্ধ ‘প্রাণের গীত’; বাংলার লোক সংগীতের ইতিহাস ‘ভাটির দেশের ভাটিয়ালী’, জাপানের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা ‘জাপান: সূর্য উঠেছে যেখানে’। উপন্যাস: ‘হরিণাক্ষি’, ও ‘নদী উপনদী’, কাব্যগ্রন্থ ‘যুগলবন্দী, ‘সেতারে নয় কবিতায়’ (আসমা আব্বাসীর সঙ্গে), সুফি কবিতা: রুমি, নিফফারী, সুলতান বাহু ও অন্যান্য’। রম্য রচনা: ‘স্বপ্নরা থাকে স্বপ্নের ওধারে,’ ‘গোধূলীর ছায়াপথে’ ও ইংরেজিতে নবীর জীবনী ‘দি নেম অব মুহাম্মদ স., সাহিত্যমহলে উচ্চ প্রশংসিত। ভ্রমণ কাহিনি: ‘চেনা অচেনা চীন’, ‘আমেরিকার টুকরো স্মৃতি ও ইংরেজি ‘মাই ফাদার্স লাস্ট ড্রিম এন্ড আদার এসেস’। কোহিনূর পাবলিশার্স চট্টগ্রাম প্রকাশ করেছে: ‘নজরুল—আব্বাউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’ যেখানে নজরুল সংশ্লিষ্ট ৮০টি ও আব্বাসউদ্দিন সংশ্লিষ্ট ৪৫টি—সর্বমোট ১২৫টি ছবি রয়েছে যা ইতোমধ্যে পাঠকসমাজে সাড়া ফেলেছে।
সম্পাদনা করেছেন ‘লোকসংগীত সংবাদ; ‘৫০ বছরের বাংলা ভাষা’, ‘দুয়ারে আইসাছে পালকী’ (আব্দুল লতিফের লোকসংগীত), সংগীত অ্যালবাম ‘ধন ধান্যে পুষ্পভরা’ এবং আব্বাসউদ্দীন আহমদের ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা ও দিনলিপি’।
উপস্থাপক মুস্তফা জামান আব্বাসী বিটিভিতে ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘আমার ঠিকানা’, ‘লৌকিক বাংলা’, ‘আপন ভুবন’ লোকসংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেন। দর্শকের ড্রইংরুমে দীর্ঘদিন এই অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গ্রাম বাংলা থেকে তুলে আনা শত শত শিল্পী।
তিনি ঢাকা রোটারি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট এবং রোটারী জেলা—৩২৮০—র গভর্নর ছিলেন। অংশ নিয়েছেন ব্যাংকক, ম্যানিলা, টোকিওসহ বিভিন্ন শহরের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রোটারী সম্মেলনে। ১১ বছর ধরে তিনি সংগীতে বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। এছাড়া লোকসাহিত্য পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো, ঢাকা ক্লাব ও গুলশান ক্লাবের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির সদস্য, গুলশান ইয়থ ক্লাব ও গুলশান সোসাইটি সম্মানিত সদস্য ছিলেন ।
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর কালজয়ীর গানগুলোর মধ্যে ‘ওরে নীল দরিয়া’ এবং ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ অন্যতম। এছাড়া আরেকটি লোকগীতি ‘জ্বলেয়া গেইলেন মনের আগুন’ তাঁর কণ্ঠে গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর কণ্ঠে লালন ফকিরের গান ‘এমন মানবজনম আর কি হবে’ ভিন্ন এক মাত্রা পেয়েছে। এরকম আরও বেশ কয়েকটি গান সুবাস ছড়িয়েছে বরেণ্য এই গায়কের কণ্ঠে। এরমধ্যে ‘তুমি কেন বোঝ না’, ‘আমার কার জন্যে প্রাণ’ উল্লেখযোগ্য।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি বাংলাদেশের মাটির গান শুনিয়েছেন মানুষকে। সংগীত পরিবেশনের জন্য ৪০টির বেশি দেশ ঘুরেছেন তিনি। তারমধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, কোরিয়া, মায়ানমার, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, লিবিয়া, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইরান, ইরাক, তুর্কি প্রভৃতি দেশ অন্যতম। গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন সেখানকার মানুষকে।
সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেন একুশে পদক (১৯৯৫)। চ্যানেল আই—রবি আজীবন সম্মাননা (২০১১), লালন পরিষদ অ্যাওয়ার্ড, সিলেট মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, নজরুল একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, মানিক মিয়া অ্যাওয়ার্ড, আব্বাসউদ্দিন স্বর্ণপদক (চট্টগ্রাম), বেঙ্গল স্যানিটারি অ্যাওয়ার্ড, নাট্যসভা অ্যাওয়ার্ড; চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, ২০১১; চ্যানেল আই নজরুল মেলা আজীবন সম্মাননা, ২০১৩; এপেক্স ফাউন্ডেশন পুরস্কার; বাংলা শতবর্ষ পুরস্কার, বিটিভি’র গোল্ড মেডেলসহ অসংখ্য পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন।
উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীত পরিবারে জন্ম নেওয়া বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী ১০ মে, ২০২৫ইং রাজধানীর বনানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকার আজিমপুরে একই কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর বাবা পল্লিগীতির অগ্রপথিক আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মা লুৎফুন্নেসা আব্বাস। বাবা—মায়ের কবরে দাফন করা হয়েছে তাঁদের সন্তান দেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে।
কবি ও প্রাবন্ধিক