spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতামুসা আল হাফিজ এর কবিতা

লিখেছেন : মুসা আল হাফিজ

মুসা আল হাফিজ এর কবিতা


…………
শকুন
………….

(ইমতিয়াজ মাহমুদ বন্ধুবরেষু)

পাহাড়ে পুরনো গাছ। মরা ডালে ইতস্তত বাসা শকুনের।
শকুনটির কোনো নাম নেই;- সে জন্মেছিল এক বজ্রপাতের রাতে,
যখন ঝরনা কাঁদছিলো মানুষের মতো।
শকুনের দুই চোখ শত বছরে পুরনো আয়নার মতো
আয়নায় শুধু ভাসে হাড়, ধ্বংস, মরণ আর
সেইসব মিছেমিছি আলোর লহর — মানুষ যাকে বলে প্রগতি।

ইদানী সকাল হলেই শকুনটি উড়ে যায় মাঠের ধারে।
যেখানে এক বুড়ো চাষী প্রতিদিন হাল টানে, ঋণের বোঝা নিয়ে।
তাকে ছুঁয়ে আসা বাতাসের কাছে শকুনের প্রশ্ন-
বুড়োটা পড়বে কবে? আর কত দিন?
বাতাস বললো , যাও, জীবনকে মরণের অপেক্ষা দিয়ে
পেরেশান না করে জঙ্গলে চলো, মরেছে হরিণ।
শকুনটি মরা হরিণের চোখে চোখ রাখলো।
হরিণটি তখনো উষ্ণ, কেবল থেমেছে নিশ্বাস।
বুকে বাজছে মাতৃস্নেহ!
শকুন থেমে যায়। খায় না।
চোখ মেলে দেখে — আকাশ আজ নীল নয়
বরং কেমন একটা অস্পষ্ট বেদনার ছায়া।
তার মনে পড়ে বাল্যকাল … মা শিখিয়েছিল —
খাবে তুমি, তবে খিদে নিয়ে নয়, উপলব্ধি নিয়ে খাবে।
শকুনটি ভাবে— জীবন মানে কেবল লাশ নয়,
জীবন মানে মৃত্যু দেখার ধৈর্য।
সুখ মানে হাড় নয়, বরং
একটা সদ্যমৃত হরিণের পাশে বসে থাকা —
নীরবে, নিঃশব্দে, গ্রাস না করে।
সন্ধ্যা নামে, পাহাড় ঢেকেছে রক্তভেজা দীর্ঘ ছায়া।
শকুনটি ঠোঁট গুটিয়ে বসে আছে— জন্মের মতো নীরব।
চাঁদ ওঠে না, তবু শালগাছের পাতা কেঁপে ওঠে হাওয়ায়, আর
দূরের কোন কুয়ো থেকে শোনা যায় বৃষ্টিহীন জলগান!
শকুনটি বসে থাকে
মনের এক অরণ্যে —
যেখানে ছায়া মানে আলোর মর্সিয়া।
সে ভাবে —
মানুষ ঋষির মতো চাষ করে বটে-
কিন্তু কোনো শিকড় নয়, ছায়াই ফলায়?
তারা দেখে না
ভূগর্ভে প্রতিটি কান্নার বীজ থেকে জন্মায় অদৃশ্য গিরগিটি —
সে রং বদলায়, দংশন করে,
আর বলে — এটাই জীবন।
মানুষ চাঁদ দেখে বটে, খোঁজে শুধু আলো।
তারা কি বুঝে —
চাঁদ আসলে বিশাল হাড়,
যার মাঝে ঘুমিয়ে থাকে মৃত সময়ের স্তূপ!!
লোকেরা মরে গেলে বলে মরণ
জীবিত মরণকে বলে প্রগতি!
যেখানে মন পচে যায় আর হৃদয় টিকে থাকে
ঋণের গন্ধে,অভ্যাসের দংশনে, আত্মপলায়নে!
শকুন খায় না আজ, চেয়ে থাকে আকাশে —
যেখানে প্রতিটি নক্ষত্রই একেক প্রাচীন চোখ,
যারা মৃত নয়, তবু কাঁদে—
মানুষের লাগি!
জীবনেও মরা যারা
মরণেও মরা!

……………..
পাখিরাজ্যে
……………..

পাহাড়ের ছায়ায় পাখিরাজ্য

সবুজের মিনারে বসে রোদ পান করে পাখি,
ঝিঁঝিডাক আর বাতাসের গন্ধে আঁকে
বেঁচে থাকার ছন্দ।
সেখানে ঈগল ন্যায়ের সেনাপতি,
নির্মোহ ঘুঘু ছিলো বিচারের কাজী
কাকেরা খবরের ধারাভাষ্যে ,
আর ময়নারা বহন করতো কূটনীতির দুতিয়ালি!
কিন্তু হঠাৎ,
আধুনিক হতে হবে বলে পাখিরাজ্যে ঝড়-
চড়ুইয়ের চোখে চকচকে পুঁজি,
টিয়া রপ্ত করেছে মিছে কথার রান্না,
ময়নার মুখে নেই হৃদয়ের ভাষা!
বাজপাখি নেমে এলো শিকারির কৌশলে,
সংশয়ী কবুতর ভুলে গেল
সাদা ডানার সরলতা।
দৃষ্টির ভঙ্গি গড়ে দেয় আত্মতা
আত্মতাকে শাসন করে নিজস্ব শয়তান
এবং তারপর –
চড়ুইরা দল বেঁধে দল ভাঙলো—
‘আমরা পাহাড়ি’, ‘তোমরা সমতলী’ !
সবাই ব্যস্ত পরিচয়ের খাঁচা নিয়ে।

ঝাঁকে ঝাঁকে গাঙচিল উড়ে গেল
সমুদ্র ছেড়ে—
অন্য পাখিদের সভ্য বানাবার-
কলোনি বানাবে।

পাতার ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলির বদলে
বর্ণবাদের ধোঁয়া।
দোয়েল চুপ।
কাক এখন সংবাদ নয়, গুজব রটায়।
ময়নার মুখে নীতিভাষ্য,
নিজে যা মানে না।
রাজ্যটি রাতের আলোয় ঘুমাতে ভুলে গেছে
ঘরগুলো চকচক করে,শুধু নেই বন্ধনের মন!

ভাঙনগুলো নির্জন ঝরনার ধারে কাঁদে।

তাদের কান্নার পাশে এক আবাবিল
প্রশ্নের স্পর্ধায় বললো —
পথ কি খতম?
নাকি ব্যাকরণ বদল করে ,
আনা যায় উড়ালের নতুন তাহযিব?
আবাবিল পথ পায়, আর পথে ডাকে—
বন্ধুগণ! আমাদের ডানায় আগুন লেগেছে,
সেই ডানা দিয়েই আকাশ স্পর্শ করা যায়,
যদি আগুনকে আলোতে বদলে দাও!
পাখিদের রাজ্য জুড়ে স্বভাবের ধ্বংসস্তূপে,
অত:পর জন্ম নেয়
গানের পাখিরা—

ডানা মেলে ফেরে তারা সরল আদিতে
প্রত্যেকেই খুঁজে নেয় ভাঙচুর নিজেকে
সকলেই হতে পারে আবারো সবার!

………………
তরুলতা জেগে আছে?
………………

ধানের শীষে পোকা নেই,
শালিক বসে আছে বাঁধানো পুকুরে—
কিশোরটি মাছ ধরতে এসে জালে তোলে
স্যাঁতসেঁতে পলির স্তর।
যা নদীর শরীর ছিল এক সময়।
বাঁশঝাড়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে নদী,
যেন এক গর্ভবতী স্তব্ধতা—
তার মধ্যে গজিয়ে উঠছে
চুল্লির ধোঁয়া, প্লাস্টিকের রোশনাই!
আর খাল প্রকল্পের শুভ উদ্বোধ! ”
নৌকার জায়গায় ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে
তিন চাকার পায়ের নিচে রক্তমাখা বেগুন,
বৃদ্ধ চাষী চাকাকে বলে, থামো !
কিন্তু তার আওয়াজ বাতাসের কাছে ভাষাহীন।
কামারশালায় একটা পোকা দাউ দাউ শব্দে মরছে,
সেই শব্দে নদী সাড়া দেয়—
নড়াচড়া করে তার হাড়ের ধুলা,
নিশ্বাসের মতো সাদা ধোঁয়া ওঠে বাতাসে।

করুণ রাত নামে, যেভাবে
কালো পলিতে চাপা পড়ে গর্ভবতী হাঁস।
কেউ বলে না,
এইখানেই ছিল নদী- ঘাট,
এইখানে ভেজানো হতো নবজাতকের নাভি—
জানে শুধু বাতাস ,
জানে মাটি,
আর ভাঙা নৌকার বুকের পুরনো কাঠ
পানি নেই, আছে ভেজা স্মৃতি।
তরুলতা এখনো জেগে আছে—
কোনো ঘোষণাপত্রে নয়,
অকাল খরায় পুড়ে যাওয়া চাষির শ্বাসে,

প্রকৃতি জেগে আছে শিশুদের পিপাসার রাতে
কান্নার জলে , দু:স্বপ্নে।

…………….
বুলবুলি
…………….

একটা পাতার গায়ে হেলান দিয়ে পাখিটি ভাবছি
পাতা কি জানে, এই সকালই তার শেষ?
বুলবুলি গান গাই
যেন নদীরও আগে ছিল এক নদী,
যার কিনারার সুর শোনা যায়, কিনারা দেখেনি কেউ!

বুলবুলি ডাকি কাউকে যতোই দূরের হোক-
বুলবুলি ডাকছি খুব কাছ থেকে!

পাখিদের কেউ শেখায় না প্রেম,
তবু তারা ভালোবেসে ফেলে বাতাসের রঙ।
বুলবুলির ঠোঁটে লেগে আছে না-বলা কিছু কথা,
যেন হারানো এমন কারো কণ্ঠরব,
যার নাম কখনো লেখা হয়নি কোনো কাগজে।
গাইতে গাইতে ভুলে যাই নিজেকেও,
হয়তো এটাই তার মুক্তি—
নিজেকে ভুলে যাওয়া, অথচ রয়ে যাওয়া
পাতায়, শব্দে, দুপুরের নিশ্বাসে ।
গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
বুলবুলি উড়ে যাই না
উড়ে যাওয়ার ভান করে আসলে দাঁড়িয়ে রই—
কোথায় যাবে সে? কোন আকাশের তলে?
আকাশকে সে চেনে না,
কিন্তু আকাশ তাকে নজরদারি করছে—
প্রতিটি ডানায়, প্রতিটি বিরামে।
ওহে অচেনা বন্ধন ও বৈরিতা
কোথাও যাবো না বুলবুলি। কারণ সে জানে –
ডানা মানেই গমন নয়,
কখনো-কখনো ডানা শুধু প্রশ্ন ও প্রতিরোধ!
বুলবুলি গান গাই,
গান শুধু গান নয়, অনন্ত অসমাপ্ততা—
যার প্রতিটি স্বর ভেঙে পড়ে শেষ না হওয়া যন্ত্রণায়!

বুলবুলির রক্ত ঝরে । ঝরা রক্ত গান হয়ে যায়।
যা সমস্ত বিহ্বলতা পার হয়ে পৌছে যাচ্ছে
হৃদয়ের সেই ধামে ,
যেখানে সময়ও পারছে না পৌছাতে!

…………..
উন্নয়ন!
…………..

নদীর ঘাটে বুলডোজার
তার ছায়ায় দুটো শালিক –
কী সুন্দর, কিন্তু ডাকে না, নাচে না—
যেন গলার স্বর কেউ পালিশ করে দিয়েছে আর-
পাখিনৃত্য শুনেছে মহাপ্রকল্পের –
ইশতেহার!

…………….
সাগরে
…………….

নীল অন্ধকারে, রঙিন গভীরে ঝিনুক শহর —
শহরটিতে সূর্য সোজা পৌছে না,
খরিদ করতে হয় আলো ।

শহরটি দখল করলো কিছু মাছ।
রক্তমাখা চুনিতে বাঁধানো কাঁটা,
রাক্ষশের লোভের মতো দাঁত।
গলা দেখায় না, তবু সাগর কাঁপে তাদের হুঙ্কারে।
তাদের রাজা ছিল আরো বড় মাছ,
দাঁতে মোহর, চোখে চুম্বক।
বলত: “আমি জানি কোথায় মৎস্যসুখ।
হুকুম তামিল করো, নয়তো হারিয়ে যাবে ঝড়ের হুমকিতে।

রাজার বাহিনী খোলস খুলত কচ্ছপের,
ট্যাক্সের নামে মুক্তা ছিনিয়ে নিতো ঝিনুকের বুক থেকে—
বলতো মুক্তা দিয়ে সবার ভবিষ্যৎ কেনা হবে।
কিন্তু ভবিষ্যৎ কেউ দেখতো না।
রাজার প্রতিটি ভাষণ সাজানো -গুছানো। বলতো সে-
আপনারা স্বাধীন! কিন্তু কেবল সমুদ্রের শৃঙ্খলা মানবেন।
শৃঙ্খলার নামে শৃঙ্খল রচনা করতো স্কুইড-মন্ত্রীরা,
তাদের কালি প্রহরে প্রহরে মুছে দিতো নিয়মের চিহ্ন—
কেউই খেয়াল করত না – আইন বদলেছে।

একদিন মুগ্ধ নামের নীলকান মাছ,
দরিয়ার মনের ভেতরে
খোঁজে পেল সেই কিতাব, যেখানে লেখা আছে
শৃঙ্খলহীন আদিম শৃঙ্খলা- ইনসাফ!
প্রবালের পাতায় লেখা আদিগ্রন্থে
না আছে রাজা, যার ইচ্ছের নাম আইন!
আছে জোয়ার-ভাটার সরলতা, আর
বহুবর্ণিল পাখনাদের নিজ নিজ বিকাশ।
মুক্তা লুণ্ঠন কিংবা খোলস খুলে নেবার
কোনো বাহানা চলবে না।

মুগ্ধ চায় সাগরের আসল ফিতরাতে ফিরে যেতে
সে ডেকে আনলো বাকরুদ্ধ নাগরিকদের
বললো: চলো, উদ্ধার করি নিজেদের প্রকৃত জিন্দেগী!

রাজা ভাবলো—তুচ্ছ ছোট মাছ, তার সুর আর যাবে কত দূর?
মারদাঙ্গা বাহিনী দেখলেই পালাই পালাই!
যাও, তাদের উপর বিছিয়ে দাও সেই ভাষা , যা তাদের বোবা করে রাখবে!
দাঁত বাগিয়ে এলো লেজ-পালক বাহিনী,
তারা ঘিরে ফেললো প্রবাল নগরী,
কালি ছুড়ে মারলো স্কুইডরা,
আটবাহু অক্টোপাস যারে তারে ধরে!

কিন্তু প্রতিবার ঢেউ উঠছে পিঠে পিঠ মিলিয়ে—
সার্ডিনেরা একসাথে ঘুরছে,
ঘূর্ণিপাক গড়ে তুলেছে ম্যাকারেলের ঝাঁক
বিক্ষোভের বানান বুনেছে গালপার ঈল
মরতে মরতে জেগে উঠেছে কোরালের ঝাঁক
ডলফিনের গতি ও ঐক্যে ভেঙে গেছে হাঙরের দাঁতের অহম

শোষিতের মিলিত ঢেউ রাজাকে কাঁপিয়ে দিলো!
ঝিনুকেরা অসহযোগে, বন্ধ এখন মুখ,
কেউ মুক্তা দেয়নি আর—
তখনই রাজা বুঝলো-
আমার রাজত্ব দাঁড়ানো ছিলো তাদের নিরবতায়!
সম্মতি এখন নেই, কোনো আদেশই কাজ করবে না।
রাজার সকল অস্ত্র-শস্ত্রে ভয়ের অন্ধকার
আর শোষিতের কণ্ঠে জ্বলে আলো।

সমুদ্র ডামাডোল শেষে হাসলো। বললো—
আলো যার নয়, তার হাতে ঝিনুকেও আলো জ্বলে না—
সে বরং পুড়ে যায় লুণ্ঠিত আলোর মুখ দেখানোর অভিনয়ে!

নিপীড়নে ঝড় আছে বটে। কিন্তু ইনসাফের বর্ণমালা তারচেয়েও ঝড়ো!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ