spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধসমকালীন আফগানিস্তানের কবিতার রূপরেখা : পাঁচ

লিখেছেন : মাসুদুল হক

সমকালীন আফগানিস্তানের কবিতার রূপরেখা : পাঁচ

মাসুদুল হক

ঙ. নারী ও তার অধিকারের গুরুত্ব:

আফগান সমাজে নারীদের অবস্থান নেই বললেই চলে। তবে তাদের স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে কবিতায় যথেষ্ট উচ্চকিত কণ্ঠস্বর লক্ষণীয়।আফগান সমাজে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্ন দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্ব পেয়েছে, বিশেষত তালিবান শাসনামলের পরিপ্রেক্ষিতে। আফগান নারীরা কঠোর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিধিনিষেধের মুখোমুখি এবং তাদের অধিকারের জন্য একাধিক কবি তাদের লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। তাদের কবিতা নারীর অবস্থান, সংগ্রাম ও অধিকার নিয়ে অনেক গভীর তত্ত্বসমৃদ্ধ। এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকজন আধুনিক কবির কবিতা লক্ষ্য করা যাক।

১. সাহার আফগানী (Sahar Afghani; জন্ম:১৯৭০) একজন আফগান কবি ও লেখিকা, যিনি কবিতায় আফগানিস্তানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র তুলে ধরেন। তার কবিতায় নারী এবং নারী অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি নারীদের মর্যাদা, অধিকার এবং স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেন, বিশেষত আফগান সমাজের প্রেক্ষাপটে যেখানে নারী অধিকার প্রায়ই খর্বিত থাকে। যেমন তিনি লেখেন:
“তুমি নারী, কিন্তু তোমার হৃদয়ে অনেক পুরুষের সাহস,
যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে তোমার চিত্ত ভাঙে না,
তুমি পরাভূত হতে জানো না,
তোমার প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিশোধের গন্ধ ছড়ায়।”
এই কবিতায় আফগানী নারীকে প্রতীকীভাবে শক্তিশালী এবং অনমনীয় হিসেবে চিত্রিত করেছেন। এখানে তিনি বলেছেন যে, নারীরা শুধুমাত্র শোষিত নয়, তারা তাদের সংগ্রামে এক শক্তি হিসেবে উত্থিত হয়। তিনি সমাজে নারীদের সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে তাদের সাহসিকতার ও আত্মবিশ্বাসের গুরুত্বকে চিহ্নিত করেছেন।
সাহার আফগানীর কবিতা নারীর মুক্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে কণ্ঠস্বর তৈরি করেছে। তার কবিতায় নারীর উপর নিপীড়ন, তাদের শোষণ এবং আত্মপরিচয়ের প্রতি টান অনুভূত হয়।উদাহরণ:
“আমাদের শরীর, আমাদের অস্তিত্ব,
আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের অধিকার।
আমাদের জীবনে সন্ত্রাসী শাসক নয়,
আমরা মুক্তির জন্য সৃষ্টি।”
এই কবিতায় তিনি নারীর আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের পক্ষে কথা বলেছেন, যা আফগানিস্তানের কঠিন পরিস্থিতিতে নারীদের অবস্থান তুলে ধরছে।

২.আফসানা ওয়াজির (Afsana Wazir) একজন গুরুত্বপূর্ণ আফগান কবি, যার কবিতা নারীর অধিকার, স্বাধীনতা এবং আফগান সমাজের অসংগতি নিয়ে গভীর আলোচনা করে। আফগানিস্তানে নারীদের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা চ্যালেঞ্জিং এবং আফসানা ওয়াজির তার কবিতার মাধ্যমে নারীদের প্রতি নির্যাতন, দমন, এবং বৈষম্যকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তার কবিতায় আমরা দেখতে পাই, নারীদের স্বাধীনতা এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন। তিনি নারীর জন্য একটি স্বাধীন, শক্তিশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান চান। উদাহরণ:
“আমরা সেই নারী, যাদের গলা চেপে ধরেছিলো সমাজ, কিন্তু এখন আমরা আমাদের কণ্ঠস্বর উদ্ধার করবো, মুক্তির সুর শোনাবো, দমবন্ধ সঙ্গীতের মতো!”
এখানে তিনি নারীদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম এবং নিজেদের কণ্ঠস্বর পুনরুদ্ধার করার কথা বলেছেন।

৩.রোখশানা নূরী ( Afsana Nori; ১৯৫০-২০০৫ ) আফগানিস্তানের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, যিনি মূলত নারী অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি তার আগ্রহের জন্য পরিচিত। তার কবিতা সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে তুলে ধরে, বিশেষত নারীদের প্রতি বৈষম্য ও তাদের স্বাধীনতার অধিকার প্রসঙ্গ। তিনি কবিতায় নারীদের শোষণ, কষ্ট এবং প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। তার কবিতায় নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্বাধীনতার প্রতি গভীর এক ভালোবাসা ও উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নারীদের প্রতি সহিংসতা, অসাম্য এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং নারীদের প্রতি সামাজিক এবং রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। উদাহরণ:
“বিরুদ্ধ সমাজে, আমি একা
যেখানে চোখে চোখে থাকে দৃষ্টি,
মুখে মুখে কথা বলা দুষ্কর,
আমি তখন চুপ থাকা শিখি।”
এই কবিতার মাধ্যমে তিনি নারীদের মুখ বন্ধ রাখার এবং তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সমাজের অপসংস্কৃতি সম্পর্কে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।

৪.ফাহিমা রাহমানি (Farima Rahmani; জন্ম:১৯৫৫)আফগানিস্তানের একজন প্রখ্যাত কবি, যিনি নারী অধিকার, স্বাধীনতা ও আফগান সমাজের বাস্তবতার বিষয়ে তাঁর কবিতায় গভীর উচ্চারণ করেছেন। তিনি তাঁর কবিতায় নারীর অবস্থান এবং অধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন সামাজিক অসাম্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। উদাহরণ:
“আমার শরীর আমার,
আমার মন আমার,
আমি যদি চাই, আমি গাইতে পারি,
আমি যদি চাই, আমি সংগ্রাম করতে পারি,
কারণ আমি একজন নারী, এবং আমি স্বাধীন।”
এই কবিতায় তিনি নারীর আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের কথা বলেছেন, যা নারীদের সমাজে প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের অধিকার আদায়ের জন্য অনুপ্রাণিত করে।তিনি কবিতায় নারী অধিকারকে কেন্দ্র করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে। তিনি নারীদের প্রতিবাদী ভূমিকা, আত্মসম্মান ও আত্মনির্ভরশীলতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

৫.মাহবুবা সিদ্দিকি (Mahbuba Siddiqi; জন্ম:১৯৫০) আফগানিস্তানের একজন প্রখ্যাত কবি। তাঁর কবিতার মাধ্যমে তিনি নারী অধিকার, সামাজিক ন্যায় এবং আফগান নারীদের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি আফগানিস্তানের আধুনিক কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারী কণ্ঠস্বর। তিনি নারীদের প্রতিদিনের সংগ্রাম এবং তাদের প্রতি যে সামাজিক অসম্মান তা তুলে ধরেছেন। তার কবিতায় নারীদের বঞ্চনা, কুসংস্কার এবং পুরুষশাসিত সমাজের মধ্যে তাদের অবস্থানকে তিনি খোলাখুলি ভাবে চিত্রিত করেছেন। উদাহরণ:
“আমি একজন নারী,
আমাকে মালামাল হিসেবে ভাববেন না,
বেচাকেনার বস্তু হিসেবে দেখবেন না,
সমাজের কোণায় লুকিয়ে রাখা ছায়া হিসেবেও
আমাকে দেখবেন না।”
এই কবিতাটি নারীর স্বাধীনতা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদকে প্রকাশ করে। এই কবিতায় নারীর অধিকার, মর্যাদা, এবং আত্মসম্মান নিয়ে তার গভীর অনুভূতি ফুটে উঠেছে।
৬.নার্গিস মুসাভি (Nargis Musavi; জন্ম: ১৯৫৫) আফগানিস্তানের প্রখ্যাত কবি এবং লেখিকা, যিনি আফগান নারীদের অধিকার এবং মুক্তির বিষয়ে তার কবিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি আফগান সমাজের নিপীড়িত নারীদের কথা বলেছেন, এবং বিশেষ করে তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য কণ্ঠস্বর উত্থাপন করেছেন।উদাহরণস্বরূপ, তার একটি কবিতার একটি অংশ লক্ষণীয়:
“তুমি আমাকে বলো না,
যে আমি কোথায় যাব,
আমাকে শুধু বলো, যে আমি কীভাবে আমার আত্মমর্যাদাকে ফিরিয়ে পাবো?”
এখানে কবি নারীর আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা আফগান সমাজের নারীদের অবস্থা ও তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি তুলে ধরে।
নার্গিস মুসাভির কবিতার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তিনি একদিকে যেমন নারীদের শিক্ষা, স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে আফগান সমাজের পুরনো ও রক্ষণশীল ধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন।
আফগান নারী কবিরা তাদের কবিতার মাধ্যমে শুধু সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ জানাচ্ছেন না, বরং নারীদের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করছেন। তাদের কবিতায় নারীর প্রতিরোধ, শক্তি এবং অদম্য মনোবল ফুটে উঠেছে। যদিও আফগানিস্তানে নারীদের অবস্থান খুব দৃঢ় নয়, তবুও এই কবিরা তাদের সৃজনশীলতা এবং সাহসিকতার মাধ্যমে আফগান সমাজে নারীদের ভূমিকা এবং অবস্থান পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করছেন।
আফগান কবিরা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ও আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে পাহাড়, নদী, মরুভূমি এবং জীবন ও মৃত্যুর ভাবনা দিয়ে বিশ্ব কবিতায় তাদের ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করেছিলেন।এই ধারায় ঐতিহ্যবাহী আফগান কবিতায় ফেরদৌসী,রুমি,জামির নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁদের উত্তরসূরী হিসেবে সমকালীন আফগান কবিগণ আর্থ-সামাজিক- রাজনৈতিক বাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও কবিতায় তাঁদের নিজস্ব স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।

[ সমাপ্ত ]

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. অত্যন্ত গভীর বোধের দ্বারা চিত্রিত হয়েছে এই আলেখ্যটি। এটি একটি অসাধারণ উপস্থাপন। গবেষণাধর্মী এমন বিষয়ের ওপর নিবিড় আলোকপাত আমাদেরকে ঋব্ধ করে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় এসব সংস্কৃতির প্রাণবন্ত আলোচনা বা বিশ্লেষণ আগামী প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে সন্দেহ নেই—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প
নয়ন আহমেদ on যুদ্ধশিল্প
কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন