শাহানারা স্বপ্না
দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মদান করেছে দেশপ্রেমিক তরুণরাই। যুগে যুগে বিপ্লবী বীর তরুনদের খুন-রাঙা পথ বেয়েই অর্জিত হয়েছে দেশের মুক্তি। উপনিবেশিক যুগে অত্যাচারী বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল মুজাহিদ দলের বিপ্লবী দুই তরুণ — মুহম্মদ আবদুল্লাহ ও শের আলি।
১৮৭১ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর বীর মুজাহিদ মুহম্মদ আদুল্লাাহ অত্যাচারী বৃটিশ বিচারপতি মি : নরম্যানকে হত্যা করে এবং ১৮৭২ সালে ৮ই ফেব্রুয়ারী শর আলি, বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড মেয়োকে হত্যার মাধ্যমে টালমাটাল করে দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশদের মসনদ। তাদেরই গর্বিত উত্তরসূরী রংপুরের অসীম সাহসী আবু সাঈদসহ আত্ম-ত্যাগকারি জুলাই ২০২৪ এর বাাংলার বিপ্লবী তরুণ সমাজ, ১৫৩ বছর পর আবার জুলুমশাহী ফ্যাসিবাদীর ভিত নাড়িয়ে দিল।
প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের বুনিয়াদ গড়ে ওঠে রক্তের ঋণের ওপর। ভারতের স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনাতাকামী লক্ষ লক্ষ বীর মুজাহিদ জীবন দিয়েছেন, ফাঁসিতে ঝুলেছেন, আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছেন, অবর্ণনীয় দু:খকষ্ট সয়েছেন, অমানুষিক নির্যাতনে মৃত্যুবরন করেছেন। দেড়শো বছর ধরে অকাতরে রক্ত ঝরিয়ে তৈরী করেছেন স্বাধীনতা অর্জনের রক্ত-পিচ্ছিল পথের সোপান। বাংলাদেশের একাত্তরের স্বাধীনতার আন্দোলনেও রক্ত ঝরিয়েছেন সাধারন মানুষ। কোটি মানুষের জীবন পর্যুদস্থ, ছিন্নভিন্ন হয়েছে। মৃত্যুর ভয়াল উপত্যকা পেরিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা, অথচ মেলেনি মুক্তি। স্বাধীন, সুন্দর জীবনের আকাঙ্খায় মানুষ বিস্ফোরিত হয়, যুদ্ধ করে, আবিষ্কার করে রক্তস্নাত দেশ। কিন্তু বার বারই তা রাজনৈতিক দস্যুরা কুক্ষিগত করে নেয়। নান্দনিক শ্লোগানের বাতাবরনে শাসন-শোষনের নতুন জাল বিছিয়ে টুঁটি চেপে ধরে গনমানুষের।
বাংলাদেশে গত পনের বছর ধরে মানুষের বুকের ওপর ফ্যাসিবাদীশক্তি পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল। কেড়ে নিয়েছিল সব রকম ম্বাধীনতা ও কথা বলার শক্তি। মহান রব ২০২৪ সালের জুলাইকে বানিয়েছেন জুলুমশাহী পদানত করার হাতিয়ার ! জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই ৩৬টি দিন ছিল শ্বাসরুদ্ধকর, অবর্ননীয় হত্যালীলা ও অত্যাচারের আলেখ্য। নিকৃষ্ট স্বৈরাচারের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছিল। ’হয় মরবো নয় মারবো’– এ অগ্নিমন্ত্রে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল প্রতিটি হৃদয়। এর বাইরে বাঁচার আর কোন উপায় ছিল না।
জুলাইয়ের প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন করছিল। সরকার চাইলে আলাপ আলোচনা করে খুব সহজেই তাদের ক্ষোভ মিটিয়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু জুলুমবাজরা মানুষের ওপর অত্যাচারের স্টিম-রোলার চালাতেই অভ্যস্থ। তারা মানুষের অধিকার কেড়েই থেমে থাকেনি, সামান্যতেই দমন পীড়নে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। সারাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি জারী করে মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছিল। সীমাহীন ক্ষমতা হাতে পেয়ে তাদেরকে পেয়ে বসেছিল ইবলিশের উম্মত্ত অহংকার ও পৈচাশিক আনন্দের পাশবিকতা। ইচ্ছেমত ধরে নিয়ে হাজারো আয়না ঘরে মানুষকে বন্দি করে চালায় তারা নৃশংস নির্যাতন। খুন, গুম, জখম-নির্যাতন, দখল, ধর্ষণসহ যাবতীয় কূ-কর্মে বিষিয়ে তুলেছিল জনমানুষের জীবন। বিরোধী মত নির্মূল, মানুষকে সর্বহারা ও বঞ্চিত করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ব্যাংক লুট, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, গনমাধ্যম ধ্বংস, নানারকম কালা-কানুন জারী, ভারতীয় আধিপত্যবাদী প্রতিষ্ঠা, ইসলামের কন্ঠরোধ, খুনী সন্ত্রাসীর রাজত্ব কায়েম করেছিল সারা দেশ জুড়ে। একের পর এক তেল,গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মানুষের নাভিশ্বাস তুলে নিজেরা টাকা পাচার করছিল দেশে বিদেশে। রাষ্ট্রে কেবলমাত্র একটি পরিবারই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে দানবে পরিনত হয়েছিল। দেশের সবক’টি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গড়ে তোলে চাটুকার সংস্কৃতি। চলছিল পলাশী-প্রহসনের মতো দেশের সার্বভৌমত্ব বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার পায়ঁতারা।
তাই চরম অবজ্ঞা ভরে ন্যায্য দাবী চাওয়া ছাত্র-তরুণদের তকমা দেয় ‘রাজাকার’ বলে। আর এতেই ক্ষোভের শুকনো খডে জ¦লে ওঠে দাবানল। মূহুর্তে বিক্ষুদ্ধ, অপমানিত তরুণরা বিষ্ফোরিত হয় তুমুল প্রতিবাদে। তারা প্রবল পরাক্রমে গর্জে ওঠে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। অগ্নিগর্ভে পরিনত হওয়া সারা দেশের ছাত্র সমাজ একযোগে মুখরিত হয়। ৬ই জুলাই থেকে আন্দোলন নতুনতর দিকে মোড় নিতে শুরু করে। একদফা দাবী নিয়ে তারা অগ্রসর হয়। সরকার প্রধানের দেয়া ‘গালি’ নানা রকমভাবে ছন্দোবদ্ধ গানে পরিণত করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারন ছাত্ররা সারা শহরময় ছড়িয়ে পড়ে। সবকটি রাস্তা জুড়ে তারা গাইতে থাকে —
’তুমি কে আমি কে ?
রাজাকার রাজাকার!
কে বলেছে কে বলেছে ?
স্বৈরাচার স্বৈরাচার!”
সাধারন মানুষ চমকে ওঠে নিষিদ্ধ শব্দের সশব্দ কোরাস শুনে! মানুষের মনে জাগে আশা। ফ্যাসিবাদকে ভয় না পেয়ে পাল্টা জবাব দিতে পারছে আমাদের তরুণরা, আর ভয় কি? আমজনতা মহা উৎসাহে ছাত্রদরে পাশে এসে দাঁড়ায়। ’কান্ডারী এ তরনীর’ ছাত্ররাই!
ফ্যাসিস্ট সরকার শতাব্দীর নির্মম নিষ্ঠুরতায় আন্দোলনকারিদের ওপর লেলিয়ে দেয় খুনি গুন্ডা বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী। এমনকি ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে আসে স্নাইপারের দল। নির্বিচারে মারতে থাকে ছাত্র-শিশু-জনতা। আবু সাইদ, মুগ্ধ, তানিম, দীর্ঘ হতে থাকে মৃত্যর মিছিল। সশস্ত্র অস্ত্রের মুখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অগনিত মানুষ। কিন্তু জীবন মরন পণ করে বাংলাদেশের মানুষ নেমেছে স্বৈরাচারের কৃপাণতল থেকে মুক্তির আন্দোলনে।
মুক্তির গান গেয়ে মৃত্যুর মুখে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে তারা। এ মুক্তির জোয়ার রোধ করা কোন বোমা, গুলি, ট্যাংকের সাধ্য নেই। জাতীয় কবি নজরুল এ আন্দোলনে মিলে মিশে একাকার। তাঁর প্রেরনাদীপ্ত বাণী হাজার কন্ঠে ঝংকৃত হয়ে প্রকম্পিত করে রাজপথ। দ্রোহে, অধিকার আদায়ে, ভেঙ্গেচুরে নতুন করে গড়তে কবি নজরুলের গানই আজও তরুণদের হাতিয়ার। ’-কে আছো জওয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত!’ ’নব জীবনের গাহিয়া গান, সজীব করিব গোরস্তান, আমরা আনিব নতুন প্রাণ বাহুতে নবীন বল!” অনেক কবি-শিল্পী নিত্য নতুন গান, র্যাপগান, ছড়া, কবিতা লিখে আন্দোলন চাঙ্গা করে রাখেন।
তারুণ্যের জ্বলন্ত আগুন চারদিকে লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ে। দুশমনরা যতই দমন পীড়নের কৌশল করুক তরুন সমাজ কোন কিছুরই পরোয়া করছে না। ৫ই আগস্ট ছাত্ররা গনভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিলে কারফিউ জারী করা হয়। কিন্তু কারফিউ অমান্য করে দলে দলে তরুণদল জীবনের মায়া ছেড়ে শহীদী তামান্নায় ছুটতে থাকে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’র দিকে। তারা কন্ঠে গান অন্তরে দুর্বার শক্তি-স্রোত নিয়ে উজিয়ে আসে। এ স্রোত ভাঙ্গনের, প্রতিরোধের নয়। ।
অবশেষে দেশব্যাপী ছাত্রদের বেপরোয়া আন্দোলনে ভয় পেতে শুরু করে ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী। দলের কাউকে কিছু না জানিয়ে আচমকা নিজের আত্মীয়দের নিয়ে শেখ হাসিনা পালায় ভারতে। পেছনে রেখে যায় রক্তাক্ত রাজপথ, মরণাহত মানুষের সারি, আর্তনাদ, আহাজারি। বুলেটবিদ্ধ তরুন-যুবা-শিশু-কিশোরের জর্জরিত দেহ। বিষাক্ত ধোঁয়ায় হাজার হাজার ছেলেদের চোখ নষ্ট। এত দু:খকষ্টের পরও মানুষের মুখে মুক্তি ও স্বস্তির হাসি। জনতা ছুটে যায় গণভবনে। মিষ্টি মুখ করে এক অপরকে।
বাংলাদেশের তারুণ্য-শক্তির এ অসাধারন আন্দোলন বিশ্বে অনন্য এক সম্মানের মর্যাদা পেয়েছে, আর পতিত স্বৈরাচার ঘৃণা কুড়িয়েছে। আমাদের তরুণরা অনেক ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ। ধ্বংসস্তুপ থেকে তারাই গড়তে পারবে নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশ। দেশকে অত্যাচারীর হাত থেকে মুক্ত করতে তরুণদেরকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু তারা জানতো এই পরিণতির কথা, হৃদয়ে মুদ্রিত আলেকজান্ডার পুশকিনের দু’টি ছত্র–
.. “আমি জানি ধ্বংস তার জন্য অপেক্ষা করছে–
অত্যাচারীর জোয়াল ঠেলে যে উঠে দাঁড়ায়।
কিন্তু আমাকে বল,
ক্ষতি না মেনে কবে কোথায়, কে স্বাধীনতা পেয়েছে ? “
………..
আইনজীবি ও কথাশিল্পী