মাহমুদ নোমান
একটি কবিতা যখন পাঠককে পূর্ণ তৃপ্তিতে ভরিয়ে দেয়,তখন সে কবিতাটি নিয়ে মুখে কিছু বলবার, কলমে কিছু লেখবার থাকে না। কেবল আত্মার নড়নচড়ন শুরু হয়,পরাণে বিড়বিড় করে ; মানুষ না জানে, না শুনে এমনকিছু ধ্বনিত হয় ; সালেহীন শিপ্রার কয়েকটি কবিতা পড়ে আমার তেমন ভাবনা আসে,অদেখা মনের আষ্টেপৃষ্টে জড়াজড়ি করে থাকে। অথচ লেখবার বা বলবার যুৎসই ভাষা খুঁজে পাইনি।
আদতে কবিতা লেখা যায় না,কবিতা লেখা হয়ে যায়। কবিতাকে আবিষ্কার করতে হয়, তবুও আবিষ্কৃত হয় না। যেমন একজন মানুষের সৌন্দর্য কী পোশাকে ?
রহস্য উদ্ঘাটনে,রূপপরিচয় পেতে পেতে হঠাৎ আপনার মুখ দিয়ে আচমকা বের হয়ে যাবে, এইতো — ক বি তা…
তবুও কবিতার ইতিবৃত্তান্ত প্রকাশ্যে আসে না । কেননা কবিতা বলতে নিজের অনুভবের ধারণাকে ঐশ্বরিক চেতনায় তুলে ধরার চেষ্টা। বোধের ঘোরে কবিতার রাজত্ব। তাই সালেহীন শিপ্রা নিজেকে আর কবিতার পরিচয়দানে প্রথম ও একমাত্র কবিতা বইয়ের নাম রাখলেন ‘প্রকাশ্য হওয়ার আগে’….
প্রকাশ্য হওয়ার আগে একথাটা বলে পাঠককে আরো রহস্যে ধাবিত করেছেন,এটা সুনিশ্চিত; এবং পাঠককে ধাবিত না শুধু নিপতিত করেছেন নিজস্ব ভাবজগতের মোহাবিষ্টতার ঘোরে। সেখানে কেবল সৌন্দর্যবোধে আত্মজিজ্ঞাসা : সবসময় জপনা করো,আমি কে…?
এ আত্মজিজ্ঞাসা সালেহীন শিপ্রার কবিতাকে আধ্যাত্মবাদে দীক্ষিত করেছে। সমকালীন কবিতার মধ্যে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। কেননা সালেহীন শিপ্রার দেখার মাহাত্ম্য সুগভীর আর যখন নিজে কবিতায় বলেন —
কসাইয়ের মুখ দেখে মনে পড়ল
কীভাবে তোমার ক্রোধ
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলো
কোপাতে কোপাতে বাড়ে।
রাগে ও ঘৃণায় কেঁপে উঠে
ফের তাকাতেই
কসাইয়ের মুখটিও ভালো লেগে গেল।
- দেখা ; ৪৫ পৃ.)
উপরোক্ত অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতার মধ্যে সালেহীন শিপ্রা তাঁর দেখাটা সহজে বললেও এ দেখা সে দেখা নয়; খুব গভীরে নিয়ে যাবে পাঠককে,পাঠকের অজান্তেই। মাংস কাটার সময় কসাইয়ের ক্রোধের মুখ দেখে চোখে ভেসে এলো শত্রুর ক্রোধান্বিত মুখ। অথচ ফের দেখায় শত্রুর ক্রোধান্বিত অসুন্দর বিশ্রী মুখের কাছে কসাইয়ের মুখটিও ভালো লেগে গেল। কী এক অদ্ভূত ব্যাকরণাদি ! এই হলো সালেহীন শিপ্রার দেখা। আবার এটাকে অনেকে খারিজ করে দিতে পারেন। কেননা কবির দেখা আর পাঠকের দেখা এক নাও হতে পারে। আবার রহস্য বাঁধে, আবার খুলে, এভাবে একটি কবিতা পুনঃ পুনঃ আবিষ্কৃত হয়। তবুও ধরা দেয় না,ছোঁয়াও যায় না…
আবার ‘প্রকাশ্য হওয়ার আগে’ বইটিতে স্বরবৃত্ত ছন্দোবদ্ধ অন্ত্যমিলের কবিতায় যখন বলছেন —
আমি এক পদ্মপুকুর,আমিই এখন জল
আমার বুকে বৃষ্টি, আমি বৃষ্টিতে টলোমল
বৃষ্টিতে ধুই তেতর বাহির,বৃষ্টিতে সুখ ধুই
বৃষ্টিধোয়া পদ্মপাতা আলতো ঠোঁটে ছুঁই।
- পদ্মপাতায় রাত্রিদুপুর ; ১৫ পৃ.)
উপরোক্ত কবিতায় পাঠকমাত্র খেই হারাবে। হয়তো অন্ত্যমিলের ঝংকারে বা হৃদয়াবেশে; চিত্রকল্পের মিষ্টিমধুর উপস্থাপনে পাঠক কবিতাটির ঘোরে নিপতিত হয়ে থাকবে। আশেক ও মাশুক একে অপরের মাঝে হারিয়ে খোঁজা, একে অপরের মাঝে বসবাস; একে অপরের মাঝেই সমাপ্তি। অতঃপর আধ্যাত্মবাদে পরস্পরের মিলন। অথচ বিরহে বিবাগে কাতর বুকে উচ্চারণ করেন —
দিগন্ত ধুতে ধুতে দাঁড়িয়ে গেছি,নতজানু তোমার সম্মুখে
হাঁসরঙা মেঘের কেলি মুছে গেলে
সঙ্গী হলো অভিশাপ — ‘ মনে পড়বেই।’
সেই থেকে ধ্যানের শুরু — ‘ ভুলে যাব’।
- মনে পড়বেই; ১৩ পৃ.)
মনের মানুষকে কাছে পাবার জন্য কাকুতিমিনতি, কঠিন সাধনাব্রতে একসময় হতাশ হয়ে যাওয়া। তবুও তো ভুলে থাকা যায় না, হারহামেশা মনে পড়া যেন অভিশাপ হয়ে সঙ্গী হয়। এরপরে ভুলে যাওয়ার ধ্যানের শুরু। তবুও ভুলে থাকা যায় না —
কখন যে মৃত্যু এল,আর চলেও গেল। মৃত একা
অপেক্ষা করছে জীবিতের।
- শহর ; ১২ পৃ.)
উপরোক্ত কবিতায় অতৃপ্ত আত্মার কথা বলা হয়েছে। এবং এখানে আধ্যাত্মিকতার ভাবধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করছে। মৃত মানুষ অপেক্ষা করে একই সাথে দুনিয়াদারি করা জীবিত মানুষদের জন্য। এখানেই সালেহীন শিপ্রার বিশিষ্টতা। সমকালীন বা এর আগে যেসব নারীরা কবিতা লিখেছেন প্রায় গৎবাঁধা,প্রচলিত ভাবধারায় এগিয়েছেন সেখানে সালেহীন শিপ্রা নিজের মতো কবিতার মধ্যে স্বর এনেছেন আর সে স্বরে আধ্যাত্মিকতার বীজ রোপণ করেছেন। আধ্যাত্মিকতার বলয়ে নিজেকে পরিবেষ্টিত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। অন্তত এটা এদেশের সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দিকে তাকালেই অনুমেয়; তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সালেহীন শিপ্রা মাদারজাদ কবি নয়তো এমন শেকল ভাঙলো কীভাবে….?
দুই .
এখনকার কবিতায় একটু আড়াল রাখা পছন্দ করেন কবিরা। গন্তব্য নির্দিষ্ট থাকুক,রাস্তাটা যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তৈরি করা হয়,মোড় যেন বেশি থাকে; এক সত্যকে অন্য সত্যের প্রলেপনে কবিতার বক্তব্য চালান করা হয়। অর্থ্যাৎ সুয়ারিয়ালিজমে দ্বারস্থ হয়ে কবিতার মধ্যে ব্যঞ্জনা নিরূপিত করে। তবে সালেহীন শিপ্রার কবিতা এই সুয়ারিয়ালিজমের আভ্যন্তরে আধ্যাত্মবাদের স্বরূপ উন্মোচন করে স্বতঃসিদ্ধভাবে। এর সাথে সাথে মায়াবী চিত্রকল্পের ব্যবহারের যথার্থতা কবিতার সৌন্দর্যবোধ ও মাহাত্ম্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। নিজ থেকে এসে প্রকৃতি ধরা দেয় সালেহীন শিপ্রার কবিতায়। চিত্রকল্প,উপমা আর ইতিহাস – ঐতিহ্যের চেতনা সালেহীন শিপ্রার কবিতায় স্বপ্রনোদিত হয়ে আসে। কোনো জোড়াজুড়ি বা আলগা ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় না। সালেহীন শিপ্রার কবিতার রহস্যভেদ নিয়ে বলা শুরু করা যাবে,শেষ হবার উপক্রম হবে না। তাই ‘প্রকাশ্য হওয়ার আগে’ বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া স্বস্তিদায়ক এইমুহূর্তে —
ক.
প্রথম রেখাটি প্রথম সে ঋতুস্রাব
প্রথম প্রেমের মতো গাঢ় তার ব্যথা।
- জন্ম; ৪৬ পৃ.)
খ.
তার কান্নার আলোতে/ ভাঁটফুলগাছে ফোটে বর্ণহীন ফুল — চুক্তিহীন,যুক্তিহীন / তোমাকে চাওয়া…
- কান্নার আলো ;২৩ পৃ.)
গ.
জানি,ফেরাবার শক্তি ছিল,ইচ্ছে করেনি। কারও
কারও চলে/ যাওয়া দেখতেই ভালো লাগে।
- জানালা; ১৬ পৃ.)
ঘ.
ছায়ার ওপর থেকে ছায়া সরে গেলে
দৃশ্যত হেরফের নাই।
জুবুথবু রোদের ভেতর তোমাদের কেমন কেমন স্বর;
মূর্ত হয় ফণীমনসার ঝোপ,কাঁটাবিদ্ধ আলো।
- অন্য পৃথিবী; ১৪ পৃ.)
ঙ.
রাত শেষে হতে আরও দুপ্রহর বাকি
কিছু কিছু ঘর প্রতি রাতে ভীষণ একাকী।
- শিশিরে - শীৎকারে ; ২৭ পৃ.)
ভীষণরকম আত্মবেদন শুরু হয়,কখনো কখনো পুলক সঞ্চার হতে থাকে সালেহীন শিপ্রার কবিতা পাঠের পর। হাসাতে হাসাতে কাঁদাতে পারেন আবার কাঁদাতে কাঁদাতে হাসির ঝংকার তুলেন। ‘প্রকাশ হওয়ার আগে’ এতো বোধ ও রহস্যের তালবাহানা আর প্রকাশ্য হয়ে গেলে কী হবে আপাতত এই প্রশ্ন পাঠকের কাছে,সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে….