spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাজিল্লুর রহমান শুভ্র এর কবিতা

লিখেছেন : জিল্লুর রহমান শুভ্র

জিল্লুর রহমান শুভ্র এর কবিতা

..……..
মথুরা
……….

তোমার দু’গালে দেখেছিলাম দুটি চাঁদ; খেলা করে অদ্ভুত মায়ার ফণা তুলে
নীল বিষের সমুদ্র-অভিযান শেষে, হায় মথুরা, হাত দিই তোমার চুলে।
চুল তো নয় যেন ঈশানের বিম্বিত মেঘ, কূটাভাসে কথা বলে
হারাই কোথাকার এক মগধে! আবার ফিরে আসি মগজে, খেলার ছলে
পূর্বাষাড়া যখন ভিড় করে আকাশের সুদূরতম বন্দরে। নতজানু হয়ে
অপৌরষেয় সুখের পালক ছড়াই তোমার কটিদেশে; তক্ষকের চোখ ক্ষয়ে
ক্ষয়ে তখন অন্ধ কুনোমাতাল ডুমুর
পরাস্ত সহিসের রাত অবিরাম ড্যাশচিহ্ন আঁকে যদি বাজে বেদনার ঘুঙুর!
উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, জিঘাংসার ত্রিসঙ্গম ছেড়ে ঐকতানের চারটি পাখি
কালের ডানায় উড়ছিল, উড়ছে, উড়বে আরও; তাদেরকেও দেয়নি ফাঁকি,
যাদের দেহ স্থবির হয়ে আছে কুয়াশার গভীর ঘুমে। রাতচিল জেগে থাকে,
ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আর্কিমিডিস নীলাভ সমুদ্রে নুনের বিষাদ মাপে, মোহনার বাঁকে
জলের কোলাহলে গভীর গোপন একজন ফেলে গেছে তার মনোভূমি;
আর যেন দম নিয়ে বলতে না হয়, –মথুরা, কেমন আছ তুমি?

…………..
ভালোবাসা
…………..

কখনও ভালোবাসা পায়নি সে। তার হতাশা ঘিরে প্রাচীন অন্ধকার
ধনুকের ছিলার মতো কেঁপে ওঠে। স্থান থেকে স্থানচ্যুত হয় বারবার
মরীচিকার টানে।
বালিঘড়ি দেখে না বালক। পূর্বাপর নক্ষত্রের পানে চেয়ে থাকে সে।
সুপ্ত বাসনার গূঢ় আলো অন্তর্বাস খুলে বালিকার রমণীয় গ্রীবা বেয়ে
কখন আসবে, –অন্তরঙ্গ আশ্লেষে বিপুল সংহারে!
আসমুদ্র বেদনার অবিনাশী আয়োজন করে যে নীলকণ্ঠ;
তার নাভিমূলের সৌরঝড় থেমে গেছে, তার কথা ভেবে
ওঠে আবারও। আকাশে ওড়ে বিজলির পালক;
বাস্তুচ্যুত পুরুষপাখি ফিরে পায় তার সমুদ্রপথ;
তবুও তার ভালোবাসা হীন্মন্যতার দমবন্ধ ঘরে
মকশো করে মায়াকোভস্কির নিখাদ অন্তর্দহনের
জটিল বয়ন।
প্রতীক্ষার কোনও এক রাতে
ঝলমল তারাদের বৈঠকি অভিসারে
সনাতন তারারা হয়ত ফিরবে ভদ্রাসন ছেড়ে
পানপাত্র হাতে আওয়াজ তুলবে ঐহিক বিভ্রমে–
বালক, অধরা ভালোবাসার মরূদ্যানে ফুল ফোটাতে চাও
করো খুনের মতো নিখুঁত পরিকল্পনা!

………
ভোর
………..

সারারাত ধরে জালটানা মাঝিদের নৌকোয় স্বপ্নের স্তুপ
লাল-নীল ভোর জেগে ওঠার আগে যখন বাতাস নিশ্চুপ
শাড়ি পরা মেয়ে এসো এখানে; ইশারায় কথা বলি দুজনে
কালচিটে মেঘেরা জেনে যাক আমাদের যা ছিল গোপনে।

নক্ষত্রের পানে চেয়ে রাতের শিরদাঁড়া ধরে হেঁটেছি
অসম্ভব অহংকারের মুদ্রা পড়ে ছিল ফারাওদের কোষাগারে
অভিশপ্ত ঘ্রাণ ভেবে সেসব ফেলে ফিরে এসেছি
অপরূপ রূপের টানে ঢেউ ভাঙা ঢেউ নদীর পাড়ে।

কোথাও চুম্বনদৃশ্য নেই; তবুও জলঠোঁটে থিরথিরে কম্পন
হেমন্তের কুয়াশারা ঝাঁক বেঁধে নামে বাড়াতে গভীর বন্ধন
মাঠের পর মাঠ, মেঘ ছুঁয়েছে আকাশ, সম্প্রীতির বিস্তীর্ণ ভূমি
আমার বুকে উন্মাদের খড়ম পরে হাঁটো সেই বাংলাদেশ তুমি!

…………..
কেবলই বিষণ্ণতা
………….

ঘুরেফিরে আসে কী এক অপ্রসন্ন বিষণ্ণতা!
ধুলো ঝেড়ে উঠি আবার ধুলোতেই বসি।
সাপেদের মতো জড়াজড়ি করে নক্ষত্ররা যখন ফিরছিল ঘরে
ভুল সঙ্কেতে কড়া নেড়েছিলাম তার দরজায়
ফলে ফিরে আসতে হয়েছে হাঁটু গেড়ে
শুনতে হয়েছে নাগলিঙ্গমের বেবন্দোবস্ত কথা–
বুড়ো ভাম! এ বয়সে প্রেম?
দুধশাদা স্তনের পাশে মুখ থুবড়ে পড়েছিল যে যুবক
তাকে সরিয়ে দিয়ে ভাবি,
আমাকে আধেক বোঝে আধেক বোঝে না সে
সম্পূর্ণ বোঝে কেবলই বিষণ্ণতা।

…………..
আমি আমার মতো
………….

তোমার ভয়শাসনের পানশালায় যখন বসো
আমার হৃদয়ক্ষরণের রক্ত না হলে তোমার পেয়ালা ভরে না
শাস্ত্রবিহিত কাল পান করো
সুড়ৎ সুড়ৎ শব্দ করো
বহুগন্ধার ঝাঁঝ চোখে তাকিয়ে থাকো
বর্ষার রাতে কবে পড়ে থাকবে আমার গলাকাটা লাশ!
ধর্মের টুপি পরিনি
দর্শনের কচকচানি থেকে অতিদূরে অন্তঃসলিলা আমি
নিজস্ব ভুবনে খরতোয়া কিংবা বসন্তকোকিল।
আমি কারও উপদেশের ধার ধারি না;
হেঁটে চলি চৈত্রের মধ্যাহ্নে পাক খেয়ে খেয়ে পথচলা
ধুলোবালির ঋষির মতো।
আমি যুধিষ্ঠির বা দধীচি হতে আসিনি
হসন্তবনে বজ্রাসন পেতে
নিজেরই চিতাভস্মের ধ্যান করি!
উত্থান ও ধ্বংসের মাঝে
আমি শব্দসন্ধানী এক বর্ণিল মায়েস্ত্র!
তুমি কে হে বাপু! আমাকে ভয় দেখাও!
বত্রিশপাটি দাঁত শক্ত করে বলব
তোমাকে থোড়াইকেয়ার করি!
আমি নই ব্যাবিলনের হাম্মুরাবি
স্বার্থচিন্তা আমার পরম ধ্যান
লিখি নিজের আনন্দে
কর্ম করি নিজের প্রয়োজনে।
জানি না যন্ত্রকৌশল
যতটা চাণক্যনীতি বুঝি
তার চে’ বেশি বুঝি নারীবৃক্ষ;
তাদের বাকল খুবলে খুবলে খাই।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
অবহেলার শিরস্ত্রাণ আমার মস্তকে
তাতে কী!
দেরিতে হলেও একদিন ছ’রা নাজিল হবে
জলরঙে লেখা থাকবে
আমার নাম ও বংশের ঠিকুজি,
–সুভাষণের পাখিরা হবে তর্কবাগিস।

………
স্নানঘাট
……….

রেবতী-রমণ সেরাতে বন্ধ রেখেছিল দুয়ার
মেঘেদের জাল ছিঁড়ে মাছবৃষ্টি নামবে
এরকম পূর্বাভাস ছিল গতজনমে।
জাতিস্মরদের স্নানঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম একাকী
তোমার উলঙ্গস্নান দেখব বলে।
তিরপল রং অন্ধকারে যারা উল্লাস করে,
তাদের কেউ বাজাচ্ছিল সম্মোহনী বাঁশি
যৌন সুড়সুড়ি নিতে
পা টিপে টিপে তুমি চলে গেছ ভুল ঘাটে।
মাছবৃষ্টি নামেনি
তোমার কার্পাস দেহে
নাংচোরার আঙুলে রিরংসার ঝাঁপতাল
হে প্রেম তুমি এখন নিশিকুটুম।

……….
কড়া
………..

এই শহরের পানশালাগুলো কালো চিতার মুখ
ভয় করে, কাছে যেতে ইচ্ছে করে না;
বরং চলো স্টেশন থেকে দূরে
নক্ষত্রের দেহ তার রং বদলানোর আগে
স্বপ্নলোকের বাড়ি;
বাড়ির সামনে জোছনাভুখ চিরল পাতার ছায়াসমুদ্র,
গা ছমছমে ভয়ের পাপেট, আরও কত কিছু!
জংধরা কড়া নেড়ে ডাকি তাকে–
’স্বপ্ন, বাড়ি আছ নাকি?’
কেউ দেবে না সাড়া
দরজা খুলে বলবে না ’স্লামালেকম’
শুনতে পাব না বৃদ্ধার বাতবেদনার আহাজারি
বৃদ্ধের সুড়ৎ সুড়ৎ করে চা খাওয়ার শব্দ।
দেখব না কিপটে আলোয় রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখ,
বেণী করে চুলবাঁধা কিশোরীর উঁকি
গবাদিপশুর লেজ নাড়ানো;
তবুও আমরা কড়া নেড়ে যাব–
সেকেন্ডে সেকেন্ডে
মিনিটে মিনিটে
ঘণ্টায় ঘণ্টায়
অনন্তকাল…

…………..
তোমার কাছে বারবার
…………..

বাণকাড়া দুধের মতো ঘ্রাণ তোমার শরীরে
নিষঙ্গ থেকে যতই বাণ ছুটে আসুক আমার দিকে;
তবুও ছুটে যাব তোমার কাছে।
তুমি ফিরিয়ে নিও না মুখ
ভয় পেয়ো না
অগ্নিগর্ভ থেকে আসিনি আমি;
এসেছি কোমল গান্ধার থেকে
জলাভূমির পাশে
থিতু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ’শেখ ফরিদ’ এর কাছ থেকে।
আমি এক নিঃসঙ্গ কবি
নিচু স্বরে বাতাসের মতো ফিসফিস করি;
গুটিকতক কবিতা গুঁজে দিতে চাই তোমার হাতে।
কাড়াকাড়ি করব না, শাড়ির ভাঁজ ভাঙব না
দূরত্ব বজায় রেখে চাইব একটু প্রাণিত হাসি।
তোমার টোলপড়া গালে সংগোপিত নক্ষত্র থেকে
জলের ঘূর্ণির মতো বাঁক খেয়ে খেয়ে নামে দীপ্তিময় আভা;
তেমনি বাঁক খেয়ে খেয়ে
আমিও নামতে চাই তোমার গভীরে।

………….
অ্যাগোরাফোবিয়া
…………..

যে দুপুর লাঠিখেলা দেখে মহরমের
জন্ম নিক আমার কবিতা তার ঔরসে
সংকেতের পামরি পরে শব্দরা নিরেট নিশ্চুপ
খুঁজব তাদের বর্ষায় না হয় পৌষে।

লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি
লিখি না কোনও প্রাপ্তির আশায়
কবিতায় সেই প্রেম চাই
যে প্রেম কথা বলে চোখের ভাষায়।

রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে চাই না আমি
শাদা বরফের নিচে যেমন অণুজীব
কত কাক ঝরে পড়ে! থাকে শুধু
সে-ই প্রচারবিমুখ চিরকাল সজীব।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. জিল্লুর রহমান শুভ্র এর কবিতাগুলো অনেক ভালো লাগলো। অভিনন্দন জিল্লুর ভাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প