spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েজুলাই বিপ্লব, কবিতা, বিজয় ও মিছিলের কথা

লিখেছেন : তাজ ইসলাম

জুলাই বিপ্লব, কবিতা, বিজয় ও মিছিলের কথা


তাজ ইসলাম

বইয়ে মুদ্রিত কবিতার প্রথমটি রচনার সময়কাল : ১৫.৭.২৪ আর সবশেষ কবিতাটির লেখার সময়কাল : ১২.৮.২৪।
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের উত্তপ্ত সময় শুরু মধ্য জুলাইয়ে। চূড়ান্ত ফলাফল প্রাপ্তি আসে ৫ আগস্ট সদলবলে হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে। শুরুর সময়কালে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা নিরাপদ ছিল না। দেশে বিদেশে যারাই কথা বলেছে তারাই সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছে বিভিন্ন হুমকি। সাজ্জাদ বিপ্লব সেই ভয়ংকর প্রতিকূল পরিবেশকে তোয়াক্কা না করে কবিতা, কথায় সমর্থন দিয়ে গেছেন আন্দোলনকারীদের। সম্প্রতি প্রকাশিত তার কবিতার বইটি সেই সময় ও এই বিষয়কে ধারণ করা চিন্তা চেতনা সংবলিত কবিতা দিয়েই গ্রন্থিত একটি কবিতার বই।
বিপ্লব স্বার্থক হয়েছে। বিপ্লবীরা হয়েছেন বিজয়ী। এই বিজয় অর্জনে আন্দোলনরত সংগ্রামী মিছিলে থাকা গর্বের কথা।
একদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে এই মিছিলের কথা। কবি এ কথা ভেবেই পুলকিত হন। আর গর্ব ভরে বলেন ‘এ মিছিলে আমিও ছিলাম’।
হাসিনা বাংলাদেশে খুন গুমে ইতিহাসের খলনায়ক হয়ে যাচ্ছিলেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারে পরিণত হচ্ছিলেন। ভোট ডাকাতিতে হচ্ছিলেন পৃথিবীর কুখ্যাতদের একজন। দেশে আম জনতা দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে গড়ে তুলছিলেন আন্দোলন। জুলাইয়ে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল। মধ্য জুলাইয়ের স্মৃতি দিয়ে শুরু করছেন সাজ্জাদ বিপ্লব। তিনি কবি ও সচেতন নাগরিক। এখনও তার সচেতন যাত্রা জারি আছে। বইয়ে মুদ্রিত সবশেষ কবিতাটির রচনাকাল ১২.৮.২৪।

সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতার ভাষা সহজলভ্য। সরল শব্দে প্রকাশ করেন নিজের বক্তব্য। কবিতা তার জনগণ লগ্ন। তার কবিতা জনতার জন্য নির্মিত।জন ভাষায় সরল টানে বলেন,

‘তবু আমি স্বপ্ন দেখি/ তুমি স্বপ্ন দেখো,
আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি/
নরকে, আশার ফুল, ফোটাতেই হবে(স্বপ্ন)।

আচ্ছা এই শেষ বাক্যে নরকে(,) আশার ফুল(,) এই দুটো কমার কী খুব প্রয়োজন ছিল?

‘নরকে আশার ফুল ফোটাতেই হবে।’ এভাবেই একটি অর্থ প্রকাশক বাক্য সমাপ্ত হতে পারে।
তাহলে কি কমা দেওয়া ভুল হয়েছে? প্রশ্নটা ব্যাকরণের। কবিতার কথা হল ‘ নরকে, কমা দিয়ে থেমে নির্দিষ্ট করা হয়েছে নরকে, এই নরকে, কবির উদ্দেশিত নরক হাসিনা শাসিত নরকে ‘আশার ফুল’ বিজয় ও সম্ভাবনার ফুল, ফোটাতেই হবে। সরল কথা, সহজ বাক্যে কাব্য দেহ এভাবেই বিনির্মাণ করেন সাজ্জাদ বিপ্লবের মতো গণমানুষের কবিরা।

‘ তোমার হাতে আবু সাঈদের রক্তের দাগ/ কোথায় পালাবে তুমি?
জুলাই ২১,২০২৪।

শেষ পর্যন্ত পালাতে পেরেছে হাসিনার মানসপুত্রদের সহযোগিতায়। পালিয়ে বেঁচে গেছে ফ্যাসিস্ট।
পলাতক হাসিনার কথা এখন ইতিহাস। হাসিনা ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট হাসিনা। ইতিহাস রচয়িতারা লিখবেন তাকে তাড়ানো সংগ্রামীদের নাম। লিখবেন সংগ্রামের কথা, সংগ্রামময় উত্তপ্ত মিছিলের কথা। কবিরাও লিখবেন কবিতায় কবিতায় সেসব বীরত্বগাঁথা। আর সে কবি যদি হন সংগ্রামের সরাসরি অংশীদার তাহলে তার রচিত পঙক্তি হবে,

‘ এ মিছিলে আমিও ছিলাম/আমিও হেঁটেছি পথে, দিয়েছি স্লোগান (এ মিছিলে আমিও ছিলাম)।’

সাজ্জাদ বিপ্লবের প্রকাশিত কবিতার বইয়ের নামই ‘এ মিছিলে আমিও ছিলাম’।

ছোট ছোট কবিতা, ছোট ছোট বাক্য, সহজ সরল শব্দে নির্মিত ইতিহাসকে ধারণ করা কবিতা ও কবিতার বই।
আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে কবি হয়েছেন নতুন দেশ নির্মাণের সংগ্রামী যোদ্ধা আবার কবিতা ও কবিতার বই প্রকাশ করেও হলেন পরবর্তী গবেষকদের গবেষণার উপকরণ। কাজটি প্রশংসনীয়।
ইতিহাস নিজেদের লিখতে হয়। লেখালেখির এই কাজ নিজ নিজ জায়গা থেকে, সক্ষমতা থেকে আঞ্জাম দিয়ে যেতে হয়। নতুবা সমূহ সম্ভাবনা থাকে ইতিহাস বিকৃতির। তথ্য প্রযুক্তির যুগে পরাজিত পক্ষ আশ্রয় নেয় অবাধ প্রপাগান্ডার। আওয়ামী দোসরেরা ইতোমধ্যে বহুবিধ প্রপাগাণ্ডায় ব্যতিব্যস্ত। এই সময়ে সাজ্জাদ বিপ্লবের এমন মৌলিক একটি কাজ সাহসী ও যুগোপযোগী। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এটি বিপ্লব সংশ্লিষ্ট প্রথম কবিতা প্রকাশনা।

পুনরুত্থান আর পুণর্জন্ম সাদা চোখে প্রায় কাছাকাছি মনে হলেও বিশ্বাসগতভাবে পার্থক্য আছে। পুনরুত্থান শব্দের প্রায় ভাবার্থ হল একই প্রাণ আবার জেগে ওঠা। মৃত্যু ও চেতনাহীনের প্রাথমিক অবস্থা একই। কিন্তু চেতনাহীন দেহ একটু পর আবার জেগে ওঠে। মৃত্য দেহ আর জাগে না। পুণর্জনমের ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস মতে একই আত্মা একবার মৃত্যু বরণ করার পর এই পৃথিবীতে ফিরে আসে তার কর্মফল অনুসারে অন্য অবয়বে।একবার মরে আবার জন্ম নেয়, এটাই পুণর্জন্ম।

পুনরুত্থান হল একই আত্মা আবার জেগে ওঠা। ইসলাম তাই বলে। এই উত্থান শুরু হয় কবর থেকেই। কবরে মৃত ব্যক্তির জন্ম গ্রহণ করে না, উত্থান ঘটে। পরিপূর্ণ উত্থান ঘটবে কেয়ামতের পর। হাশরের মাঠে। তখন শুরু হবে বিচার। শব্দ সম্ভবত এভাবেই বহন করে একটি বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের ধারা।
কবি শুধু শব্দের মিলনে নিজের চিন্তা বা বক্তব্যই প্রকাশ করেন না। হয়তো করেন, যদি তিনি হন অতি সাধারণ চিন্তার কবি।
কিন্তু তিনি যদি ধারণ করেন বিশ্বাস, লালন করেন ঐতিহ্য, প্রতিনিধিত্ব করেন নিজের কওমের তখন শব্দ প্রয়োগে সতর্ক হওয়া তার আবশ্যিক কর্তব্য। সচেতন কবিরা শব্দের অপপ্রয়োগ করেন না, হয়তো অসতর্ক প্রয়োগে বুনন করেন কবিতার বাক্য। অথবা নিহিত থাকে অন্য উদ্দেশ্য।
চব্বিশের জুলাইয়ের পরিবেশ,পরিস্থিতি কবিতায় চিত্রায়ণে লিখেন,
‘ সামনে যাওয়া ছাড়া / ফেরার কোনো পথই আর খোলা নেই/’

জালেমশাহী হাসিনার জুলুমের ভয়াবহতা এমনই ছিল বিপ্লবীদের সামনে। মৃত্যু কিংবা মুক্তি। তা বুঝাতেই সাজ্জাদ বিপ্লব লিখেছেন কবিতা। কবিতার এই দুই লাইনের ব্যাখ্যা বা এই বক্তব্যের গন্তব্য নিশ্চিত করেছেন

‘ হোক তা মৃত্যু বা পুণর্জন্ম’।

কথা স্পষ্ট হয় যখন তিনি লেখেন,

‘ একজনমে যতটা পথ হাঁটা যায়/ আমরা তার বেশি-ই যেনো হেঁটেছি এ পথে/

তিনি বিশ্বাস কি করেন এটা আলোচ্য বিষয় নয়, তিনি শব্দকে কোন অর্থে প্রয়োগ করেছেন আমরা আলোচনা করছি সে বিষয়টিই। কবিতার শব্দে তিনি আরেকটা জন্মকেই ধারণ বা প্রতিস্থাপন করেছেন। আন্দোলনের ব্যাপ্তি বা আন্দোলনকারীদের দৃঢ়তা বুঝাতে কবি এমন প্রায়োগিক বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন।
ফ্যাসিবাদ উৎখাতে প্রয়োজনে লড়াই চলবে অনন্তকাল।

তবে প্রত্যেক সচেতন ঐতিহ্যবাদী কবির উচিৎ তার কবিতায়, সৃষ্টিতে নিজের বিশ্বাস, চিন্তা, আদর্শের সমন্বয় বজায় রাখা।
এতে সাহিত্য চর্চার সাথে শব্দ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের কাজটাও আঞ্জাম দেওয়া হয়।

ফ্যাসিস্ট তাড়ানো ছিল যুদ্ধ, লড়াইয়ের সফল সমাপ্তির লক্ষ। সে লক্ষ পূরণ হয়েছে। দীর্ঘদিনের গণশত্রু পরাজিত হয়েছে, পালিয়েছে। দেশের ভেতরে পলাতক অনুগত, অনুসারীরা আছে আত্মগোপনে। তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চালিয়েছে নানা অপতৎপরতা। সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ রাখছে জারি। প্রকাশ্যে তারা নাই, আছে কুটিল পথে। আছে গভীরে, গহীনের সুক্ষ্ম শয়তান হিসেবে। সংগ্রামীদের থাকতে হবে সজাগ সদা অতন্ত্রপ্রহরীর মতো। দেশ বিনির্মাণে সংগ্রামীদের যুদ্ধ থামে না। এ কথা মনে রাখতে হয়। কবি মনে রেখেছেন। সতর্ক করেছেন কবিতায়। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন,

‘যুদ্ধ কখনোই থামে না। থামেনি এ যুদ্ধ। /চলছে এ যুদ্ধ। চলবে আজীবন– মরণ।/ আমরাও জনযোদ্ধা। যুদ্ধে আছি। যুদ্ধে থাকি।/ দোলনা থেকে কবর।( যুদ্ধ)। ‘

সাজ্জাদ বিপ্লব নব্বইয়ের দশকের আলোচিত কবি। লিটলম্যাগ আন্দোলনের সরব কর্মপুরুষ। তিনি বর্তমানে প্রবাস জীবন যাপন করছেন।প্রবাসে থেকেও অন্যান্য শিল্পী সাহিত্যিকদের মতো স্বৈর হাসিনার বিরুদ্ধে লেখালেখির মাধ্যমে ছিলেন তৎপর যোদ্ধা। লেখায় প্রকাশ করেছেন মতামত। উৎসাহ দিয়েছেন মাঠের যোদ্ধাদের। তার সম্পাদিত বহুল আলোচিত ‘বাংলা রিভউ’ ওয়েবজিন জুলাই-আগস্টে ব্যাপক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। কবিতাতেও সাজ্জাদ বিপ্লব ছিলেন তুমুল সক্রিয়। কবিতার বইটির কলেবর আরও বড় হতে পারতো। সুন্দর ছাপা ও ঝকঝকে কাগজে মনোরম প্রচ্ছদের বইটি প্রকাশ করেছে রহমান তাওহিদ। জুলাইয়ের দেওয়াল লিখন আর শিল্পী সোহানুর রহমান অনন্ত’র তুলির আঁচড়ে অঙ্কিত হয়েছে প্রচ্ছদ। বিনিময় মূল্য ১৬০ টাকা।

এ মিছিলে আমিও ছিলাম
সাজ্জাদ বিপ্লব
বাংলা রিভিউ প্রকাশন
প্রকাশকাল : অক্টোবর ২০২৪

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. ‘এ মিছিলে আমিও ছিলাম’ এ নাম ও কবিতার লাইনটি মনে হয় কালের কলেবরে খোদাই হয়ে থাকবে! প্রথম যখন এ পংক্তিটি আমি দেখি—কিছুখন তাকিয়ে ছিলাম! বুকের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠলো—হঁ‍্যা আমিও তো ছিলাম, মিছিলে না হোক মাহফিলে।
    তাজ ইসলাম বরাবরই ভালো রিভিউ করতে পারেন। কবিতার কল-কব্জা নেড়ে সঠিক বক্তব‍্যটি ঠিকঠাক বের করে নিবেনই । কবিতার হৃদয় খুঁড়ে অমৃতগন্ধী শব্দাবলীর সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
    চমৎকার তুলে ধরেছেন কবির মনস্তত্ত্ব । দ্রোহের কথা, বিপ্লবের কথা বুকে ধারন করে সময়ের এ আলেখ‍্য থাকুক জুলাইয়ের স্মারক হয়ে।

  2. ধন্যবাদ গুণী কথাসাহিত্যিক শাহানারা স্বপ্না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি
কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা