আমিনুল ইসলাম
শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি,
কিন্তু তাই বলে অকৃতজ্ঞ নই;
তোমার আন্তরিকতার কথা অস্বীকার করবো না কোনোদিনও।
এই তো সেদিন আমার বোতামখোলা বুক দেখে
তুমি বলেছিলে, ও মাই গড,
কী চওড়া তোমার বুকখান! আর কত্ত লোম!
মনে হচ্ছে অমিতাভ বচ্চনের বুকের ফটোকপি!
হায়, কোথায় রেখাজীর ড্যাসিং হিরো অমিত
আর কোথায় আমি এক গৃহপ্রেমী আমিন!
তবুও সেদিন আমি খুশিই হয়েছিলাম।
রায় সরিষার দেশের মানুষ তো!
কিন্তু আগে থেকেই সেই বুকে আঁকা লীনার নামের উলকি,
কেন যে একটিবারও তোমার চোখে পড়েনি, এখন
সেকথা ভেবে কূলকিনারা পাই না আজকের এই আমি।
তুমি তড়িঘড়ি আমার নামে দুরন্ত প্রেমিকের প্রশংসাপত্র সই করে
টাঙিয়ে দিয়েছিলে শাহবাগ মোড়ে;
চাটুকার হাওয়ার বিকেলে আমারও খারাপ লাগেনি,
কিন্তু সেই সার্টিফিকেট যে কখনো কোনো কাজে আসবে না,
সেটা বোঝার মতো ম্যাচুরিটি আরও
দশবছর আগেই ঢুকেছিল আমার বাম পাশের হিপ পকেটে।
তোমার গৃহবিভেদী পরকীয়া প্রেমের সমর্থক হতে পারছি না বলে তুমি
এখন আমাকে যখন ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে
যত ইচ্ছে গালি দিচ্ছো,
আমার নামে বদনাম রটাচ্ছো
এক গেলাসের ইয়ারদের আড্ডায়,
সুযোগ পেলেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বসে
উদ্ধার করছো আমার চৌদ্দগোষ্ঠী;
তো তুমি যা-ই করো না কেন, আমি কারো কাছেই দাখিল করতে
যাবো না এই হাতে থাকা অকাট্য সাফাই সাক্ষ্য,
আমার তরফ থেকে কেউ জানবে না
কানা ছেলের পদ্মলোচন নামের মতন তোমার স্ববিরোধী নামটিও।
শুধু তুমি জেনে রাখো, অত সস্তা জিনিস কেন,
তোমার কাকা ভাইজানকে বলে যদি আমাকে
প্রেম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও বানিয়ে দাও,
আমি বেঈমানী করতে পারবো না লীনার গৌড়ীয় ভালোবাসার সাথে।
পশম ভরতি এই দোআঁশ বুক,
কবিতার লালায় সচ্ছল এই ওমর খৈয়াম ঠোঁট,
সীমান্ত পেরিয়ে দেখার এই ঈসা খাঁ দৃষ্টি—
এসবই শুধু লীনার জন্য মজুদ ছিল, লীনারই আছে,
এমনকি জান্নাতেও এসবের দখল নিতে পারবে না
লাস্যময়ী হুরগণ।
প্রেম বলতে কী বোঝো তুমি, জানি না,
শুধু এটা জেনে রেখো—
বিবাহিত ভালোবাসা আর স্বদেশের সার্বভৌমত্ব—
কোনোটারই একরাত ভাগ দেওয়া চলে না ৷
শুনতে চাও লীনাকে এতবেশি ভালোবাসি কেন?
কারণ তার চোখের আগুনে পুড়ে যায়
লম্পটের লোভ—
সিঁধেল চোরের অন্ধকার,
কারণ তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় পায়
খুনি লুটেরার প্রভুভক্ত চেলা,
কারণ আমার গোপন ভ্রান্তির কৃষ্ণপক্ষে তার সেই চোখই
হয়ে ওঠে তিন ব্যাটারির টর্চলাইট;
আর তার দুলাব গ্রাম অধরের আঙুর চুম্বন
ইফতারির পেয়ালা হয়ে
ভরিয়ে দেয় আমার অভিমানের উপবাসী প্রাণ।
না, না, একদম ভুলিনি! আ রে অস্বীকার করব কেন?
তোমার খোলা চুলের মনখোলা প্রশংসা করেছিলাম;
বন্দনা করেছিলাম তোমার বাকুম আপার ঈগল চোখেরও।
তোমার আপার বকবকানি কোনোদিনও বিশ্বাস করতাম না,
তবে তার অনায়াস মিথ্যা বলার সাবলীলতা
দিনেদিনে আমাকে মুগ্ধশ্রোতায় পরিণত করেছিল।
আর কবিরা যা লেখে তা তো মিথ্যারই মোহনীয় শিল্পরূপ।
তাই না?
কিন্তু প্রশংসা মানেই তো লাইলি-মজনু প্রেম নয়,—
যেমন ভোট দেওয়া মানেই নয়—
মাননীয়দের খুন-ডাকাতিরও পক্ষে থাকার ওয়ারেন্টি;
যুক্তিবিজ্ঞান থেকে ধার নিয়ে বলছি,
প্রশংসাকারী কিংবা সমর্থক যদি র্যাশনাল বিয়িং হয়,
সে কারুরই আমরণ ক্রীতদাস হয়ে থাকবে না।
থাকতে পারে না।
এমনকি দলান্ধ অধ্যাপকের লেখা ইতিহাস পড়ে দ্যাখো,
সোনালি আঁশের মধ্যাহ্নে যারা একদিন
চাঁদতারার নিচে ছিল,
কিছুদিন যেতে না যেতে একসন্ধ্যায় তারাই কি
নৌকার যাত্রী ও মাঝিমাল্লা হয়ে উঠেনি?
উজানের বন্ধুত্বে নদী শুকিয়ে গেলেও নৌকা তো আছেই
জাতীয় জাদুঘরে জায়গা দখলের অপেক্ষায়;
হ্যাঁ, তুমিও কবি; কিন্তু ইতিহাস পড়ো না তুমি—
এমনটা বিশ্বাস করব কোন্ যুক্তিতে!
হয়তো মহামতি কার্ল মার্কসের সেই উক্তিকে
সত্য করে তুলেছো তুমি নিজের জীবনেও।
গাজায় গণধর্ষণের উৎসবে যারা শিশ্নজোটের অংশীদার হয়,
যারা ছুরি হয় শিশুহত্যার উল্লাসে
যারা উড়িয়ে দেয় ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখরিত লাইলির কবর,
আর টুঁটি টিপে ধরে দারবিশের কবিতার
অথবা যারা গুড়িয়ে দেয় আনারকলির অভিসারের উঠোন
কিংবা রশি লাগিয়ে দেয়
প্রেম-দেওয়ানা গালিবের গজলের গলায়,
তাদের সাথে তোমার পরকীয়া তুমিই বলো
কীভাবে প্রেমের পক্ষে যায়?
ধর্ষণ-খুন-লুণ্ঠন-স্বৈরাচার-সাম্রাজ্যবাদ এসবের বুদ্ধিবৃত্তিক দোসর
শুধু পুরুষরাই—
এতদিন যাবৎ এমনটাই জেনে এসেছি আমি,
তুমি কেন যে আমার এই মধুর ভুল ভাঙিয়ে দিলে!
লীনার প্রতি আমার নিশ্ছিদ্র ভালোবাসায় ফাটল ধরবে না তো?
বাকুম আপার জন্য তোমার ভাঁজখোলা ভালোবাসা
খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার,
কিন্তু তিনি যখন ধর্ষককে বন্ধু বানালেন,
আর চামচার প্রাণে সেটা সমর্থন করলে তুমিও,
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম লম্পট চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার।
আমি নজরুল কিংবা সুকান্ত নই বটে,
কিন্তু একটা ধর্ষকমুক্ত সমাজ রেখে যেতে চাই
আমার মেয়ের জন্য;
অতএব আমার ছেলেকেও দিতে চাই লাম্পট্য বিরোধী পাঠ।
হায়, মৌসুমি হাওয়ার একটিমাত্র ঝাপটা এসে
উদোম করে দিয়েছে অনেকের সাথে তোমারো
বিউটি পার্লার মনের ভেতরের রং!
অ্যারিস্টটলের সাদা সংজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
তুমি আসলে হলুদ ব্যতিক্রম;
তোমার অন্ধত্ব মীরজাফরের কালো রাত,
আর আমার অন্ধত্ব সিরাজের তপ্ত মধ্যাহ্ন,
দুটো ভিন্ন জিনিস।
চশমা পরা চোখে তুমি তোমার বাকুম আপার
কাছ থেকে পাওয়া
ডাবল স্টান্ডার্ড পিরিতির পক্ষে দিনকানা,
ছয় বাই ছয় চোখ নিয়ে আমি ষোলো আনা অন্ধ
ঘরপ্রেমী লীনার ভালোবাসার ।
তাই তো লাভ-জিহাদের নামে খোড়া অজুহাতে
প্রণীত আইনের চোখে
বৃদ্ধাঙ্গুলি ঝুলিয়ে সোনাক্ষী-জহিরের বিয়ে হলেও
তোমার আমার অন্ধত্বের ভাগ্যে
কোনো কাবিননামা ছিল না। নেই।
নিপাতনে সিদ্ধ হওয়ার সূত্রও কাজ করেনি এতটুকু।
করবেও না।
তোমার আমার জন্য বিধাতার সাপ্লাই রেজিস্টারে বরাদ্দ
সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থের পুরাতন ফয়সালা,
‘লাকুম দিনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন।’
কিন্তু তাই বলে কেন আজ হাহুতাশ করছো,– এত এত?
সব পুরুষ তো সব শেয়ালের এক রা হয় না
যেমন সব নারী হয় না এক গোয়ালের গাভি;
পাশাপাশি আপিল বিভাগের বেঞ্চে বসেও
সব বিচারক কি সবক্ষেত্রেই অভিন্ন মতের হউন?
তোমাকে তো বদলাতেও বলিনি আমি!
আল্লাহর কসম, তোমার দেওয়া সেই সার্টিফিকেটের
কোনো ফটোকপিও নেই আমার কাছে;
আর অন্ধকার প্রযোজিত এত এত আন্দোলনের ঝড়ে
নিশ্চয় শাহবাগ মোড়েও তার অস্তিত্ব নেই আজ;
বিশ্বাস না হয় রাতকে খোঁপায় বাঁধা রাখিকে জিজ্ঞাসা করো!
অফিস কপির চিন্তা? ডিলিট বাটনে ক্লিক করো!
অতঃপর জুকারবার্গের রিসাইকেল বিনের ঝুড়ি থেকে
ফেলে দাও ঝাটা দিয়ে মাউসের। বাস, ঝামেলা শেষ!
তুমি তো জানো, আমার প্রেম ও সংসার নিয়ে প্রতিবেদনের
সেঞ্চুরি হয়ে গেছে এই বেহুলা লখিন্দরের দেশে;
গুগলের পাতা উল্টালে শরমিন্দা হয়ে ওঠে লীনাও।
তো তোমার সেটা আছে না নেই,
তা নিয়ে ভেবে দেখার সময় হবে না
উজান প্রযোজিত গুজবের স্রোতে ভেসে চলা
কোনো দিন বা রাতের।
আচ্ছা ভালো কথা,
এত কম দামে যদি পুরুষদের কেনাই যায়,
চিন্তা কীসের!
লুট হতে থাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশেপাশে গিয়ে
লাইন থেকে ইচ্ছেমতো কিনে নাও–এক, দুই, তিন…
তারা বলে উঠবে,
আহা রে আমাদের সার্টিফিকেটের দোকানওয়ালী!
অবশ্য চাইলে তুমি আমাকে হত্যাও করতে পারো,
চারপাশে কত ভাড়াটিয়া খুনী!
তারা তো প্রায় সবাই তোমার কাকা ভাইজানের লোক;
কিন্তু তোমার মতো মানুষ চাইলে তাদেরকে টাকা ছাড়াই
ব্যবহার করতে পারবে। ওরাও তো পুরুষ।
তোমার আলো আলো আলখেল্লার নিচে ঘুমায় কত হন্তারক আন্ধকার!
কিউপিডের প্রেমবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রধান তদন্তকারী
কর্মকর্তা না জানুক, সন্ধ্যাতারা-শুকতারা জানে,
জানে রাজধানীর রাতজাগা হাওয়া,
তুমি তো তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকাদের খুনীরই বুদ্ধিবৃত্তিক আস্তানা।
তোমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আমাকে মধ্যযুগীয় পুরুষ বলে গালি দিয়েছো,
বিশ্বাস করো, একবিন্দুও খারাপ লাগছে না আমার,
চণ্ডীদাস কিন্তু মধ্যযুগেরই প্রেমিক পুরুষ ছিলেন,
রজকিনীও মানুষ সেই একই দিনরাত্রির;
আর মজনু- ফরহাদ- রোমিও,–এদের সবাই
আরও অনেক অনেক আগের, তাই না!
তোমার আধুনিক–উত্তরাধুনিক পরকীয়া বন্ধুদের সময়ে
জন্মগ্রহণ করলেও আমি কিন্তু আরো পুরোনো; আরও।
কাপড় আবিস্কৃত না হওয়ায় আদম এবং ইভ তখন
গাছের পাতা দিয়ে আবৃত করে রাখতেন
নিজনিজ নাভির নিম্নভাগ,
হাওয়ার ঝাপটা এলে চেপে ধরতেন তটস্থ হাত;
গন্দম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য
শয়তান ও সাপের সাথে চেয়ে চেয়ে দেখেতাম আমিও।
তো এই আমাকে বরং সেই আদিম যুগের পুরুষ বলতে পারো—
যখন বালিশ ব্যবসায়ী চাঁদ উঁকিঝুঁকি দিতে আসতো না
তোমার অতি আধুনিক সন্ধ্যায়
কিংবা সৃজিত হয়নি সচিবালয় সুন্দরীদের গ্রেড ওয়ান পদ।
তুমি তোমার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে যত বেশিবেশি বদনাম রটিয়ে যাবে
আমার,—- লাইলি-রজকিনীর ভালোবাসা নিয়ে বুকে,—
লীনা তত বেশি বেশি জড়িয়ে ধরবে সেই আমাকে:
“মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম..ছিলাম নদীর চরে… “
—০০০—
অবশ্য চাইলে তুমি আমাকে হত্যাও করতে পারো,
চারপাশে কত ভাড়াটিয়া খুনী!
তারা তো প্রায় সবাই তোমার কাকা ভাইজানের লোক;
কিন্তু তোমার মতো মানুষ চাইলে তাদেরকে টাকা ছাড়াই
ব্যবহার করতে পারবে। ওরাও তো পুরুষ।
তোমার আলো আলো আলখেল্লার নিচে ঘুমায় কত হন্তারক আন্ধকার!
কবিতাটি পড়ে সেখান থেকে আপনার ভালো লাগা অংশ উদ্ধৃতকরার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। এবং শুভকামনা।
হাহাহা… প্রেম!৷ ‘আমি বেঈমানী করতে পারবো না লীনার গৌড়ীয় ভালোবাসার সাথে’…. সত্যিই তাই। কারণ ‘বিবাহিত ভালোবাসা আর স্বদেশের সার্বভৌত্ব— কোনোটারই একরাত ভাগ দেওয়া চলে না’। হ্যাঁ কথাটির অন্তর্সত্য মেনে নিতেই হবে। কবি আরও অনুভব করতে পারেন, কারও ‘অন্ধত্ব মীরজাফরের কালো রাত’ আর কবির ‘অন্ধত্ব সিরাজের তপ্ত মধ্যাহ্ন।’
তাই তো লীনাভাবিকে জড়িয়ে ধরে কবি উচ্চারণ করেন, ‘মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম…’
একটি মনকাড়া প্রেমের কবিতা।
প্রিয় কবিকে প্রীতিপূর্ণ শুভকামনা আর অভিনন্দন জানাই।
‘
এটি একটি কবিতা হলেও রোমান্টিক ও নান্দনিক ক্লাইমেক্সের সংমিশ্রণ উপাখ্যানের বৈশিষ্ট্যকে স্পর্শ করতে পেরেছে। যা মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যানের সমগোত্র না হলেও ওই মর্যাদায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। আত্মজৈবনিক প্রেমের কবিতা হলেও এর অন্তরালে এক ফেমিনিজমকে দৃশ্যত দেখতে পাওয়া যায়। ফেমিনিজমের দৃশত চিত্র কবিতার সারকথায় উল্লম্ফিত হয়েছে। যেখানে রূপকল্প ও চিত্রকল্প উপমান ও উপমেয় হিসেবে আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যে যুগের বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হয়। বহমান জীবন নদীর চিত্রই যেন তরঙ্গ ধ্বনির প্রতীক প্রবাহমান রূপ নিয়েছে। অতীতের রোমান্টিক স্মৃতি বর্তমানে এসে একটি স্থান করে নিয়েছে। এইতো জীবন। যেখানে তাকালেই অনন্ত অতীত তার বর্তমানকে দেখতে পায়।
আহ! রোমান্টিকতার আড়ালেও যে কত কিছু বলেছেন । এত বৃহৎ কবিতা,তবুও একটুও বিচ্যুতি ঘটে নি। মুগ্ধ নয়নে পড়ে ফেললাম বার দুয়েক । কবিতা রচনায় আপনার মুন্সিয়ানা তো এখানেই ।